আমরা বাঙালী ও  বিচ্ছিন্ন ভাবধারা প্রসঙ্গে কিছু কথা

লেখক
মনোজ দেব

অদ্ভূত এক অন্ধগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে বাঙলার রাজনীতি৷ ক্ষমতার হাতবদল হয়,কিন্তু জনতার ভাগ্য বদল হয়না৷ কারণ ক্ষমতার হাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতার মধুচক্রের মক্ষীকারাও দল বদল করে বসে৷ এই আয়ারাম গয়ারামের রাজনীতির মাঝে বাঙলায় ছোট্ট একটি দল আছে---আমরা বাঙালী৷ দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর বাঙালীর বাঁচার নায্য দাবী নিয়ে আন্দোলন করে চলেছে৷ কিন্তু বাঙালী  জনগোষ্ঠীর সমর্থন সেভাবে পাচ্ছে না৷ অথচ দার্জিলিং গোর্র্খল্যাণ্ড, ত্রিপুরার ত্রিপ্রাল্যাণ্ড ও রাজ্যে রাজ্যে বেশ কিছু আঞ্চলিক দল প্রতিষ্ঠিত৷ কিন্তু অতিচালাক বাঙালী ও দেশভাগের বলি বাঙালীর মানসিকতার পরিবর্তন তাকে আত্মসর্বস্ব স্বার্থপর জীবে পরিণত করেছে৷ নিজেকে বাঙালী পরিচয় দিতেও কুন্ঠা বোধ করে৷

মজাটা দেখুন, তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় আসতে কোথাও অসম গণপরিষদের সঙ্গে আঁতাত করছে, কোথাও তেলেগু দেশপ্রেমের সঙ্গে আঁতাত করছে, কোথাও ডি.এমকে, এডিএমকে এর সঙ্গে আঁতাত করছে, কোথাও অকালি দলের সঙ্গে আঁতাত করছে, কোথাও গোর্খাল্যাণ্ডের সঙ্গে আঁতাত করছে, কোথাও ত্রিপুরাল্যাণ্ড এর সঙ্গে আঁতাত করছে৷ আবার এই দলগুলি ‘আমরা বাঙালী’ নামটা শুনলেই আঁতকে উঠছে---ওরে বাবা! একি বিচ্ছিন্নতাবাদ!

আচ্ছা বাঙালী বলাটা যদি বিচ্ছিন্নতাবাদ হয়, তবে অসমীয়া বলাটা, তেলেগু দেশম বলাটা, গোর্র্খল্যাণ্ড বলাটা বিচ্ছিন্নতাবাদ নয় কেন? এমনকি ভারতীয় বলাটাও তো তাহলে অবশিষ্ট পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয় কি?

আসলে এইসব রাজনৈতিক দলগুলি দেশীয় পুঁজিপতিদের কলম কাটা চারা৷ তাদের অঙ্গুলিহেলনে এরা চলে৷ ভাগ করো ও ভোগ করো---ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের এই বিভাজন নীতি আজও ভারতবর্ষে প্রচলিত আছে৷ শুধু শাসনভারটা বিদেশি ব্রিটিশ এর হাত থেকে দেশীয় পুঁজিপতিদের হাতে চলে গেছে৷ রাজনৈতিক দলগুলো এদেরই অঙ্গুলি হেলনে চলে৷ সে জাতীয়তাবাদী হোক, হিন্দুত্ববাদী হোক, আন্তর্জাতিক বাদী হোক অথবা আঞ্চলিক হোক সবারই টিকি বাঁধা আছে ওই দেশীয় পুঁজিপতিদের হাতে৷ ক্ষমতার মধু পাণ করাই ওই দলগুলির একমাত্র লক্ষ্য৷ জনগণের কল্যাণ করাটা গৌণ ব্যাপার৷

তাই গোর্র্খল্যাণ্ড, তিপরাল্যাণ্ড আন্দোলন হয়৷ তারপর একটা আপোষে চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী একটা কিছু পেয়ে কিছুদিন চুপ থাকে৷ তারপর আবার পেটে টান পড়লেই আন্দোলন শুরু করে৷ ত্রিপুরার এ.ডি.সি, অসম চুক্তি, গোর্র্খচুক্তি কোনটাতেই কোন স্থায়ী সমাধান হয়নি৷ বরং বিচ্ছিন্নতায় ইন্ধন দিচ্ছে৷

‘আমরা বাঙালী’ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সামাজিক সাংসৃকতিক একটি সংঘটন৷ যার একমাত্র লক্ষ্য জগতের কল্যাণ সাধন করতে করতে দিব্য জীবনের পথে এগিয়ে চলা৷ তাই আমরা বাঙালী কর্মীদের জীবনের ভিত্তি যেমন আধ্যাত্মিক নীতিবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত তেমনি লক্ষ্য ভৌতিক জগতে মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্য একটি দৃঢ় নিবন্ধ সমাজ ঘটন করা৷ যেখানে মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ থাকবে না, প্রতিটি মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নূ্যনতম প্রয়োজনগুলো পাওয়ার  নিশ্চিততা থাকবে৷ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ও অর্তনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমেই এটা সম্ভব৷ এরই সুস্পষ্ট পথ নির্দেশনা আছে প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্বে (প্রাউট)৷ কিন্তু তার জন্যে সামাজিক বিভাজন কেন?--- কেন আমরা বাঙালী৷

প্রাউট প্রবক্তা স্পষ্ট বলেছেন--- মানুষের সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷

প্রশ্ণ ঃ তাহলে ‘আমরা বাঙালী’ কেন?

শুধু ‘আমরা বাঙালী’ নয়, সারা পৃথিবীতে এইরকম আড়াইশতর বেশি জনগোষ্ঠী আছে৷ মানুষের সমাজ একটি ফুল নয়, নানা ফুলের মালা৷

ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে যেমন বৈচিত্র্য আছে জল হাওয়ায়, ভূমির ঘটনে , তেমনি তার প্রভাবে মানুষের ভাষা কৃষ্টি, আচার-আচরণ পোশাক-পরিচ্ছদ আহার বিহারের মধ্যেও আছে বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্য৷ প্রকৃতিদত্ত এই বৈশিষ্ট্যই মানুষের মানসিক আধ্যাত্মিক বিকাশের সহায়ক৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন---‘‘এই বৃহৎ সত্ত্বার মধ্যে একটা ক্ষুদ্র সত্ত্বা আছে, তাকে বলা হয় জাতীক সত্ত্বা৷ মানুষকে মানুষ করে তুলবার ভার এই সত্ত্বার ওপর৷’’

তাই একজন প্রকৃত বাঙালী কখনোই অঙ্গিকা,মৈথিলী, ভোজপুরি, পাঞ্জাবি বিদ্বেষী হবেন না৷ যে বিদ্বেষ হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দেখা যায়, কংগ্রেস-বিজেপির মধ্যে দেখা যায়৷ এই বিদ্বেষের কারণ বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া মতবাদ৷ এই মতবাদ রাতারাতি বদলে দেওয়া যায়, তাই একজন কংগ্রেস কাল তৃণমূল পরশু বিজেপি পরের দিন সিপিএম হয়ে যেতে পারে৷ একইভাবে হিন্দু মুসলমান, মুসলমান হিন্দু হতে পারে৷ কিন্তু একজন বাঙালী সহজে পাঞ্জাবি হতে পারবে না৷ একজন পাঞ্জাবী সহজে ভোজপুরী হতে পারবেন না৷ কারণ এ তার প্রকৃতিদত্ত পরিচয়৷ এই পরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেই একজন মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে৷ আর সেই মানুষের মধ্যে যখন সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা জাগবে তখন সেই মানুষকে শোষণ করা সহজ হবে না৷ পুঁজিবাদী শোষকরা এটা জানে বলেই মানুষের এই পরিচয় মুছে দিয়ে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা থেকে দূরে সরিয়ে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতবাদে ইন্ধন দিয়ে মানুষে মানুষে সংঘাত বাধিয়ে রেখে শোষণ করে চলেছে৷ আর এই শোষণের হাতিয়ার এই রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় মতবাদের উপর গড়ে ওঠা সম্প্রদায়গুলো৷ পুঁজিপতি শোষকের হাতিয়ার এই রাজনৈতিক দল ও সম্প্রদায়গুলো৷ এই দল ও সম্প্রদায়কে হাতিয়ার করে জনগণের মধ্যে বিভাজন করে শোষণ চালিয়ে যায়৷ প্রাউট প্রবক্তা এই বিভাজনের বিনাস ঘটিয়ে ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশের তারতম্য অনুযায়ী মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলি বজায় রেখে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরী করেছে৷

তিনি সমগ্র পৃথিবীকে২৫০টিরও বেশী স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভাগ করেছেন যে বিষয়গুলি বিবেচনা করে তা হলো---সম-অর্থনৈতিক সমস্যা,সম-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা জনগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্য, সাধারণ সাংবেদনিক উত্তরাধিকার ও একই ধরণের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য৷ একইভাবে শোষণের অবসান করতে ও জনকল্যাণমূলক সমাজ সংরচনা করতে যে বিষয়গুলির ওপর নজর দেওয়া হয়েছে তা হলো--- স্থানীয় জনসাধারণের সার্বিক কর্মসংস্থান, সার্বিক শিল্পবিকাশ, বহির্পণ্যের আমদানী এড়িয়ে চলা, স্থানীয় ভাষাকে  শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ যোগাযোগের প্রাথমিক মাধ্যম হবে স্থানীয় ভাষা ও স্থানীয় সামাজিক অর্থনৈতিক দাবী৷ ‘আমরা বাঙালী’ প্রাউটের এই প্রয়োগ ভিত্তিক তত্ত্বকে বাস্তবায়িত করার জন্যেই আন্দোলন করছে, যা শুধু বাঙালীকে নয় বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীকে শোষণমুক্ত করবে৷

তাই ‘আমরা বাঙালী’ এইসব রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক মতবাদের উর্দ্ধে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের উপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক -সাংসৃকতিক আধ্যাত্মিক সংঘটন৷ যার লক্ষ্য আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা৷ তাই সারা পৃথিবীকে শোষণমুক্ত করতে,বিশ্বের নিপীড়িত নির্যাতিত নিষ্পেষিত মানুষের মুক্তির জন্য ২৫০টিরও বেশি সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে সমাজ আন্দোলন শুরু করেছে৷ এই সমাজ আন্দোলন কোন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নয়, বিশ্বের শোষিত মানুষের আর্থিক মুক্তির সংগ্রাম৷ এই সমাজ আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বাঙলা৷ তাই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংকীর্ণ চিন্তা ধারা নয়, নিপীড়িত মানুষের শোষণমুক্তির ও মনুষ্যত্ব অর্জনের  সংগ্রাম ---আমরা বাঙালীর সংগ্রাম৷