প্রকৃত শিক্ষা মানব সমাজের মেরুদণ্ড৷ সেই শিক্ষার গুরুতর ত্রুটি আজকের সমাজের বর্তমান দুর্দশার জন্যে অনেকাংশে দায়ী৷ তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী নোতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন করেছেন৷ আনন্দমার্গের এই শিক্ষা ব্যবস্থায় মূল আদর্শ হ’ল, ‘সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে’ – যা মানুষকে স্বাত্মক মুক্তির পথে চালিত করতে পারে৷ তাই প্রকৃত বিদ্যাশিক্ষা৷ স্বাত্মক মুক্তি বলতে ভৌতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক – ত্রিস্তরীয় মুক্তির কথাই বলা হচ্ছে৷ বস্তুত মানুষের অস্তিত্বই ত্রিস্তরীয় – ভৌতিক (Physical), মানসিক (Mental) ও আধ্যাত্মিক (Spiritual)৷ তাই মানব জীবনে পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে গেলে জীবনের এই ত্রিস্তরীয় বিকাশ ঘটাতে হবে৷ এই কারণে এই তিন স্তরেরই অজ্ঞতার বন্ধন থেকে, জড়তার বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্তি পেতে হবে৷ বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আধ্যাত্মিক দিকটির প্রতি বিশেষভাবে অবহেলা করা হয়৷ আধ্যাত্মিক বিকাশ মানুষকে শুভপথে পরিচালিত করে, মানুষের অন্তর্নিহিত দিব্যশক্তির জাগরণ ঘটায়৷ এর অভাবে মানুষের জীবন চরম স্বার্থপরতায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়, মানুষ পশুতুল্য সঙ্কীর্ণ মানসিকতার গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ে৷ তখন জ্ঞান–বিজ্ঞান–প্রযুক্ প্রভূত বিকাশ হলেও তা অশুভ পথে পরিচালিত হয়৷ মনের উদারতা, সততা, ত্যাগ, চারিত্রিক দৃঢ়তা – এইসব মহৎ গুণাবলীর দারুণ অভাব দেখা দেয়৷ মানব সভ্যতা মহতী বিনষ্টির অন্ধকার গহ্বরের দিকে ধাবিত হয়৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী শিক্ষার ক্ষেত্রে তাই পাশ্চাত্ত্যের জ্ঞান–বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক শিক্ষার সমন্বয় সাধন করেছেন৷ বলা বাহুল্য, এই আধ্যাত্মিক শিক্ষার সঙ্গে কোন সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক শিক্ষার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই৷ এখানে আধ্যাত্মিক শিক্ষা বলতে বোঝাচ্ছে – সেই শিক্ষা যা স্বমানবের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত দিব্যশক্তির প্রকাশের পথ দেখায়৷
মানব জীবনের এই ত্রিস্তরীয় বিকাশের দিকে দৃষ্টি রেখেই আনন্দমার্গের শিক্ষাব্যবস্থার নীতি ও পাঠক্রম রচনা করা হয়েছে৷
এখানে ইংরাজী শিক্ষার বিষয়ে দু’চার কথা বলা বিশেষ প্রয়োজন৷ বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী ভাষা (Lingua Franka) হিসেবে বর্তমানে যেহেতু ইংরেজী স্বীকৃতি লাভ করেছে, তাই এই ভাষা–শিক্ষা শিশুদের ব্যষ্টিত্বের বিকাশের জন্যে অত্যন্ত জরুরী৷ বলা বাহুল্য, চিরকাল ইংরেজী বিশ্বভাষা থাকবে না, যখন যেটা বিশ্বভাষা হবে, সেটাকেই বিশ্বভাষা হিসেবে মেনে নিয়ে ওই ভাষা শিখতে হবে৷ আর যে কোন ভাষা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে ওই ভাষার উচ্চারণ বিধিও জেনে নিতে হবে ও তা অভ্যাস করতে হবে৷
এই সামগ্রিক নীতিকে শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিফলিত করতে হবে, তবে তা
হবে আদর্শ শিক্ষা–ব্যবস্থা৷ আর এই শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত করতে শিক্ষক নির্বাচনের দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে৷ তাই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন, ‘‘শুধুমাত্র উপযুক্ত শিক্ষাগত অভিজ্ঞানপত্র থাকলেই কাউকে শিক্ষকতা করার অধিকার দেওয়া হবে – এমন কোন কথা নেই৷ তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, ধর্মনিষ্ঠা, সমাজসেবা, পরার্থপরতা, ব্যষ্টিত্ব ও নেতৃত্বের গুণাবলীও থাকতে হবে৷’’
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী কেবল শিক্ষার এই দর্শন দিয়েই ক্ষান্ত হননি৷ তিনি এই শিক্ষানীতির ওপর ভিত্তি করে দেশে বিদেশে প্রসারিত আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের বিভিন্ন শাখা–প্রশাখার মাধ্যমে শত শত শিক্ষা কেন্দ্র – কিণ্ডার গার্টেন স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছেন৷
বর্তমানে আনন্দমার্গের Eraws শাখা (Education, Relief and Welfare Section)এই শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বের সর্বদেশে সমাজের তৃণমূল স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে৷
শিক্ষা সর্ম্পকীয় ব্যাপারে সরকারের দায়িত্ব কী হবে – এ ব্যাপারেও শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তাঁর সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন৷ তিনি বলেছেন, ‘‘শিক্ষাব্যবস্থার আর্থিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের, কিন্তু পঠন–পাঠন তথা পাঠ্য–বিষয় নির্বাচনের একছত্র অধিকার শিক্ষাব্রতীদের হাতেই থাকা উচিত৷ রাষ্ট্র এই শিক্ষাব্রতীদের পরামর্শ দিতে পারে – হুকুম করতে পারে না৷ কোনো প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্যে পাঠাতে পারে, গ্রহণ করতে চাপ দিতে পারে না৷ আর, দলীয় রাজনীতির হাত থেকেও শিক্ষা ব্যবস্থাকে সযত্নে মুক্ত রাখা দরকার৷’
- Log in to post comments