আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ প্রসঙ্গে

লেখক
আচার্য প্রসূনানন্দ অবধূত

আজ থেকে প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে মানুষ সৃষ্টির প্রথম ঊষার আলো দেখে থাকলেও মানব সভ্যতার সূত্রপাত হয়েছিল প্রায় ১৫ হাজার বছর আগে৷ বিবর্তনের পথ ধরে সভ্যতা এগিয়ে চলেছিল৷ প্রায় সাত হাজার বছর আগে প্রথম তারকব্রহ্ম সদাশিবের আবির্ভাব মানব সভ্যতার ইতিহাসে ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা৷ সেদিনের সেই প্রায় অন্ধকারে থাকা আদিম যুগের মানুষকে সদাশিবই প্রথম আলোর সন্ধান দিয়েছিলেন৷  তিনি শিখিয়েছিলেন তন্ত্র যোগ ভিত্তিক আধ্যাত্মিক সাধনা৷ প্রথম ছন্দ, সুর, তাল, লয় সমৃদ্ধ গীত বাদ্য ও সুরসপ্তকের উদ্গাতা ছিলেন তিনিই৷ সদাশিবই দিয়েছিলেন বিবাহ পদ্ধতিও৷ তার আগে সমাজে বিবাহ প্রথা ছিল না৷ সে যুগে মানব-মানবী স্বৈরী-স্বৈরিণী মত ঘুরে বেড়াত৷ জৈবিক প্রয়োজনের তাগিদে স্বৈরী-স্বৈরিণী মিলিত হলে তাদের মধ্যে যে সন্তান-সন্ততি আসত তাদের পালনের সম্পূর্ণ দায়ভার এসে পড়ত মায়ের ওপর৷ বিবাহ প্রথা না থাকার কারণে শিবের সময় বা তারও আগের যুগের মানব-মানবীদের অনেকে স্বভাবগতভাবে স্বৈরী-স্বৈরিণীর মত জীবনযাপন করত৷ তাই সন্তানের মাতৃ পরিচয় জানা গেলেও পিতৃ পরিচয় জানা যেত না৷ সন্তানেরা তাই মায়ের পরিচয়েই নিজেদের পরিচয় দিত৷ মাতৃ পরিচয়ে নিজেদের পরিচয় দেবার প্রথা আমরা মহাভারতের যুগেও দেখি৷ যেমন অর্জুনের অন্যান্য নামের মধ্যে একটি হ’ল পার্থ---(মাতা ছিল পৃথা৷ পৃথার সন্তান সেই অর্থে পার্থ), আর একটি নাম হ’ল কৌন্তেয় অর্থাৎ কুন্তীর পুত্র৷ যাইহোক সে যুগের সেই পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানদের সবসময় প্রতিকূল জীবন সংগ্রামের দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হ’ত৷ কারণ নারীর গর্ভধারণের পর থেকে সন্তানের জন্ম ও তারপর তাদের পালনের কোনও দায়ভার না নিয়ে তার পুরুষ সঙ্গীটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেটে পড়ত৷ সমাজের এই অসহনীয় পরিস্থিতি করুণাঘন সদাশিবের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করল৷ তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন সে যুগের বিশৃঙ্খল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত নরনারীদের নির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলার নীতিতে প্রথমে বাঁধতে হবে৷ তবেই আধ্যাত্মিক অনুশীলন সমৃদ্ধ শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপনই মানুষকে সার্বিক মুক্তির সোপানতলে পৌঁছে দেবে৷ সেই লক্ষ্যেই ভগবান সদাশিব প্রথম বিবাহ প্রথার সৃষ্টি করলেন৷ এই নিয়মের যথাযথ পালনের মাধ্যমে শপথবদ্ধ হয়ে একজন পুরুষ একজন নারীর সঙ্গে সারা জীবন একসঙ্গে বসবাস করবে৷ তারা পরিচিত হবে সমাজে ‘বিবাহিত দম্পতি’ হিসেবে৷ সদাশিব এই পদ্ধতির নাম দিলেন ‘বিবাহ’৷ বিবাহের পর পুরুষের সঙ্গিনী ও তাদের সন্তান-সন্ততির ভরণপোষণ সহ সমস্ত দায়িত্ব পুরুষ সঙ্গীটির৷ শিবের বিধানে সমাজে উল্লেখিত পুরুষটি তার সঙ্গিনীর ‘স্বামী’ হিসেবে পরিচিত হলেন৷ ঠিক তেমনি স্বামীর সঙ্গিনী নারীর দায়িত্ব হবে তার স্বামীর যত্ন নেওয়া ও সন্তানদের লালনপালন সহ সংসারের দেখাশোনা করা৷ শিবের বিধানে সেই নারী সমাজে তার স্বামীর ‘স্ত্রী’ বা ‘কলত্র’ ইত্যাদি নামে পরিচিত হলেন৷ গ্রাম বাঙলায় এখনও স্বামী অর্থে ‘ভাতার’ শব্দটি প্রচলিত আছে৷ যিনি স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণপোষণ করেন সেই অর্থে সংস্কৃতে ‘ভর্ত্তা’ শব্দ থেকে চলিত বাংলায় ‘ভাতার’ শব্দটি এসেছে৷

প্রায় সাত হাজার বছর আগের সেই অনুন্নত, পিছিয়ে পড়া দিশাহীন সমাজে সদাশিব প্রবর্ত্তিত বিবাহ প্রথার প্রচলন ছিল ---সে যুগে নিঃসন্দেহে  এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ, এক সমাজ বিপ্লব৷ না, তিনি শুধু বিবাহ প্রথার প্রচলন করেই তার দায়িত্ব শেষ করেননি৷ সমাজের মাঝে সেই বিবাহ প্রথার বাস্তবায়নের দায়িত্বটিও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন৷ সদাশিবই ছিলেন সে যুগের প্রথম বিবাহিত পুরুষ৷ তিনি আর্যকন্যা পার্বতী, অনার্য কন্যা কালী ও মঙ্গোলীয় কন্যা গঙ্গাকে বিবাহ করলেন৷ বলা প্রয়োজন সে যুগে অর্থাৎ শিবের সময়ে বহিরাগত আর্যদের সঙ্গে এদেশের অনার্য অষ্ট্রিক,-দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে গোষ্ঠী সংঘর্ষ লেগেই থাকত৷ শিবই প্রথম পরস্পর বিবদমান জনগোষ্ঠীগুলির মধ্যে সংশ্লেষণ তথা ঐক্যের বীজ বপন করার চেষ্টা করেছিলেন তিন গোষ্ঠীর তিন কন্যাকে বিবাহের মাধ্যমে৷ শিব যে বিবাহ প্রথার প্রবর্তন করে সমাজ বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, হাজার হাজার বছর পরও বর্তমান সময়ে তা সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক৷ সদাশিব প্রবর্ত্তিত এই বিবাহ প্রথাকে ‘শৈব বিবাহ’ বলা হয়৷

এবার বিবাহ শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ কী তা দেখে নেওয়া যাক৷ বি-বহ্+ ঘঞ= বিবাহ৷ বহ্ ধাতুর অর্থ হ’ল বয়ে যাওয়া---প্রবাহিত হওয়া৷ বিবাহ মানে বিশেষ ধারায় বা বিশেষ ধরণে প্রবাহিত হওয়া৷ পারিবারিক দায়-দায়িত্ব নিয়ে একটি নূতন ধারায় নিজেদের জীবনকে প্রবাহিত করা৷ শিবের সময়ের পরে প্রাচীনকালে বিবাহের নানা রীতি প্রচলিত ছিল৷ মনু-র সময়ে ভারতে হিন্দুদের মধ্যে নানা ধরণের বিবাহ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল৷ সে সময় আট প্রকারের বিবাহ প্রথা ছিল৷ ---(১) ব্রাহ্ম বিবাহ (২) দৈব বিবাহ, (৩) আর্য বিবাহ, (৪) প্রাজপত্য বিবাহ, (৫) গন্ধর্ব বা গান্ধর্ব বিবাহ, (৬) আসুর বিবাহ, (৭) রাক্ষস বিবাহ, (৮) পৈশাচ বিবাহ৷ এই বিবাহগুলির মধ্যে প্রথম চারটিতে কন্যাকে পণ্যদ্রব্যের ন্যায় বরের হাতে সমর্পণ করা হয়৷ একে বলে সম্প্রদান বা কন্যা দান৷ আসুর বিবাহে জয়ী জনগোষ্ঠী পরাজিত জনগোষ্ঠীর কন্যাকে বলপূর্বক ধরে এনে বিবাহ করত৷ আর রাক্ষস ও পৈশাচ বিবাহ সভ্য সমাজের রীতির বাইরে৷

প্রচলিত গন্ধর্ব বিবাহ হিন্দু শাস্ত্র সম্মত বিবাহ, মনু এই বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছেন৷ ভারতের ন্যায়াধিকারও এই বিবাহকে স্বীকৃতি দিয়েছেন৷ এই বিবাহে বর ও কন্যা অনুরাগ বশতঃ পরস্পরকে মালাবদল বা আংটি  বদলের মাধ্যমে বিবাহ করত৷ এই বিবাহ অভিভাবকদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে অথবা তাদের অনুপস্থিতিতে অপ্রকাশ্যে হতে পারত৷ অর্থাৎ এতে সামাজিক সমর্থনের প্রয়োজনকে বড় বলে গণ্য করা হ’ত না৷ পাত্র-পাত্রীর সমর্থনই এক্ষেত্রে মুখ্য বলে বিবেচিত হ’ত৷ অতীতের বহু কাব্য ও পুরাণের গল্পেও গন্ধর্ব বিবাহের উল্লেখ আছে যেমন মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ কাব্যে উল্লেখ আছে রাজা দুষ্মন্তের সঙ্গে শকুন্তলার গন্ধর্ব মতে বিবাহ হয়েছিল৷ সাত পাক, সিঁদুর, সামাজিকতা, কন্যাদান, অগ্ণিসাক্ষী কোনকিছুই এতে নেই৷ কেবল একটি স্থায়ী সত্তার সামনে এই মালা বিনিময় অনুষ্ঠিত হ’ত৷ এই স্থায়ী সত্তা বলতে প্রাচীন কাল থেকে সূর্য, চন্দ্র, তাঁবা, তুলসী, মহাভারত ও গঙ্গোদককে বোঝানো হ’ত৷ প্রাচীন কালে পৃথিবীর নানান দেশে নানান ধরণের বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল৷ কোন দেশেই সামাজিক মতে বিবাহ বলতে যা বোঝায় তা ছিল না৷ কোন দেশে পাত্র-পাত্রী বুদ্ধমন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে মোমবাতী জ্বেলে দিয়ে আসত৷ তখন তারা বিবাহিত বলে ধরে নেওয়া হ’ত৷ নাগাল্যাণ্ডের অংশবিশেষে পাত্র-পাত্রী কিছুদিনের জন্য বাড়ী থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে অন্যত্র গিয়ে একসঙ্গে থাকত৷ ফিরে আসার পর তারা বিবাহিত বলে গণ্য হ’ত৷ জয়ী জনগোষ্ঠী পরাজিত জনগোষ্ঠীর কন্যাকে বলপূর্বক ধরে আনত৷ একেও বিবাহ বলে স্বীকার করা হ’ত৷

আনন্দমার্গের বিবাহ পদ্ধতি হিন্দু শাস্ত্রসম্মত মনুক্ত গন্ধর্ব বিবাহ৷ তবে এই বিবাহ প্রকাশ্যে অনুষ্ঠিত হয়৷ অর্থাৎ সমাজ স্বীকৃতভাবে অনুষ্ঠিত গন্ধর্ব বিবাহ এই আনন্দমার্গের বিবাহ৷ আইনের ভাষায় এটি হিন্দু বিবাহ৷ আনন্দমার্গের এই গন্ধর্ব বিবাহে সাক্ষী থাকেন বর-কনের উভয় পক্ষের মাননীয় প্রতিভূরা৷ শুধু তাই নয়, তারা ও উপস্থিত দর্শকগণ মন্ত্রপাঠ করে নিজেদের সাক্ষীত্বকে পুষ্টিকৃত করে থাকেন৷ আনন্দমার্গের গন্ধর্ব বিবাহ পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে একটি ধর্মীয়-সামাজিক অনুষ্ঠান৷

আনন্দমার্গ বৈপ্লবিক বিবাহ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য সমূহ ঃ

আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ পদ্ধতি

কেন আনন্দমার্গের বিবাহ পদ্ধতিতে বৈপ্লবিক বলা হয়? এই বিবাহ জাত-পাত, জাতি, বর্ণ ও ধর্মমতের বেড়াজালের ঊধের্ব৷ অর্থাৎ এই বিবাহকে অবশ্যই হতে হবে অসবর্ণ বিবাহ৷ পণপ্রথাহীন অসবর্ণ বিবাহকে আনন্দমার্গের সমাজশাস্ত্র চর্যাচর্য অনুযায়ী ‘বৈপ্লবিক বিবাহ’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে৷ আনন্দমার্গের বিবাহে আর্ন্তজনগোষ্ঠী, আর্ন্তপ্রাদেশিক ও আন্তর্জাতিক বিবাহকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মতানুযায়ী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে রক্তগত সংমিশ্রণের ফলে উন্নত সঙ্কর প্রজাতির প্রজন্ম সৃষ্টি হবে৷ সামাজিক সংশ্লেষণ ত্বরান্বিত হবে৷ রক্তের সংমিশ্রণের ফলশ্রুতি হিসাবে ধীরে ধীরে ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্যাভাস ইত্যাদির মেলবন্ধন হবে ও এক মানব সমাজ গঠনের ক্ষেত্র প্রস্তুত ও বাস্তবায়ন ত্বরাণ্বিত হবে৷

পণপ্রথার উচ্ছেদ

পণপ্রথা সামাজিক অবিচারের একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মতানুযায়ী এই পণপ্রথার দুটি মুখ্য কারণ---একটি হ’ল অর্থনৈতিক, অন্যটি হ’ল নারী-পুরুষের সংখ্যাগত তারতম্য৷ আর্থিক ব্যাপারে নারীর পুরুষ নির্ভরশীলতা কমে যাবার সঙ্গে সঙ্গে অথবা দেশবিশেষে পুরুষের নারী নির্ভরশীলতা কমে যাবার সাথে সাথে পণপ্রথার উগ্রতা আর থাকবে না বটে, কিন্তু এই কাজকে ত্বরাণ্বিত করার জন্যে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে উন্নত আদর্শবাদ প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে৷ আমাদের ছেলেমেয়েরা চাল-ডাল, তেল-নুন বা গোরু-ছাগল নয় যে তাদের নিয়ে হাটে-বাজারে দর-কষাকষি চলবে৷ পণপ্রথা আধুনিক সভ্য সমাজের পক্ষে সত্যিই কলঙ্কস্বরূপ৷ এই কু-প্রথার উদ্ভবের পেছনে প্রথমত রয়েছে নারী-পুরুষের আয়ের বৈষম্য৷ কেরলের নায়ার, ঈড়বা বা মেঘালয়ের খাসিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে মাতৃগত দায়াধিকার ব্যবস্থা৷ তাই সেখানে পুরুষেরা বিয়েতে যৌতুক দাবী করে না৷ যেমন মায়ানমারের মেয়েরা আর্থিক ব্যাপারে স্বাধীন তাই সেখানে পুরুষরাই মেয়েদের পণ দিয়ে বিয়ে করে৷ দ্বিতীয় কারণ সমাজে নারী-পুরুষের সংখ্যাগত তারতম্য৷ যদি কোন জনগোষ্ঠীতে পুরুষের সংখ্যা বেশী হয় তাহলে সেখানে নারীরা যৌতুক পাবে৷ আবার নারীর সংখ্যা বেশী হলে পুরুষেরা যৌতুক পাবে৷ পঞ্জাব, হরিয়ানায় তুলনামূলক ভাবে পুরুষের সংখ্যা বেশী৷ তাই সেখানে বিয়েতে নারীরা যৌতুক পায়৷ আভিজাত্যের বৃথা অহমিকাও পণপ্রথার অন্যতম কারণ৷ তথাকথিত অভিজাত পরিবারগুলো ভাবতে থাকে যে তাদের পরিবার সমাজের বনেদী পরিবার৷ তাই তাদের মোটা পণ পাবার অধিকার আছে৷

সবচেয়ে অবাক লাগে যখন দেখি আজকের জেনারেশন-ওয়াই-এর কর্পোরেট কালচার, শিক্ষা---চাকুরীতে কেতাদুরস্ত তথাকথিত স্মার্ট শিক্ষিত ছেলেদের অনেকে বিয়ের সময় একই জাতের মেয়ে খোঁজে৷ মেয়ের বাপের কাছে লক্ষ লক্ষ বা কোটি টাকার পণের দাবী করে৷ এদের অভিভাবকরা আবার সরাসরি পণের টাকার কথা না বলে  ছেলেকে আধুনিক ফ্ল্যাট, ব্র্যাণ্ডেড গাড়ী ও মেয়েকে ব্র্যাণ্ডেড দোকানের সোনা বা হীরের অলঙ্কারে যথোপযুক্ত ভাবে সাজিয়ে দিতে বলে৷ আর আধুনিক ফ্ল্যাট সাজানোর জন্য আসবাবপত্র সহ যাবতীয় উপকরণ তো দিতেই হয়৷ পণলোলুপ এইসব রক্তশোষক পিশাচ পুরুষ পুঙ্গবদের বিবেকের কাছে প্রশ্ণ করছি যারা হবু শ্বশুরবাড়ী থেকে এইভাবে পণের নামে চাপ দিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শ্বশুরকে সর্বস্বান্ত করে ফেলেন তাদের কি একবারের জন্যেও বিবেক দংশন হয় না? যাদের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক করছেন যাদের বাড়ীর মেয়েকে ধর্মপত্নী হিসেবে গ্রহণ করছেন, তাদের সঙ্গে এইরূপ কসাইয়ের মত  নিষ্ঠুর ব্যবহার করা কী সভ্য সমাজে কি শোভা পায়? শুধুমাত্র পণ ঠিকমত দিতে না পারা বা বিয়ের পর পাত্রের আরও পণের দাবী না মেটাতে পারার জন্য কত স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত জীবন আহুতি দিতে হচ্ছে বা তাদের পাত্রপক্ষ নিষ্ঠুরভাবে পুড়িয়ে মারছে তার হিসাব কে রাখে?

সম্প্রদান তথা কন্যাদান প্রথামুক্ত বিবাহ পদ্ধতি

প্রাচীনকাল থেকে শুরু হয়ে বর্তমান কালেও বিভিন্ন বিবাহের রীতিতে আছে কণেকে পিঁড়িতে সালঙ্কারা অবস্থায় বসিয়ে অভিভাবক পিঁড়ি সহ ঊধের্ব তুলে তাকে দান করবেন ও বর  তা গ্রহণ করবে৷ এই সম্প্রদান করা বিবাহ আজও তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের মধ্যে কিছুটা প্রচলিত আছে৷ বর্তমানে আধুনিক যুগে নারীর স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়ন নিয়ে লেখায় যখন দিস্তে দিস্তে কাগজ খরচ হচ্ছে, টিভি-তে রিয়েলিটি শো ও বাইরে বিভিন্ন আলোচনা ও বিতর্ক সভা হচ্ছে ও তাতে অনেক বিশিষ্ট পুরুষ ও নারীরা অংশগ্রহণ করছে৷ অথচ সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের বাড়ীর মেয়ের বিয়ের সময় কিন্তু দেখা যায় যে, পরম্পরাগত প্রথার নাম করে বত্তৃণতামঞ্চে বা বিতর্ক সভায় ভাষণ দেওয়া ব্যষ্টিরাও তাদের মেয়েদের বিয়েতে পাত্রের হাতে পাত্রীকে সম্প্রদান করছে৷ তথাকথিত আধুনিক  মনস্ক মেয়েদের মধ্যে অনেকে তাদের বিয়ের সময় নারীর প্রতি চরম অবমাননাকর তথা সম্মানহানিকর এই অমানবিক সম্প্রদান প্রথা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন৷ উল্লিখিত তথাকথিত প্রতিবাদীদের অনেকেই ছেলে বা মেয়ের বিয়ের জন্য বিজ্ঞাপন দেন---ব্রাহ্মণ পাত্র চাই বা কায়স্থ পাত্রী চাই বলে৷

আনন্দমার্গের মতে বিয়েতে সম্প্রদান একটি মানবতাবিরোধী ব্যবস্থা৷ এতে নারীকে গোরু-ছাগল, হাঁস-মুরগীর পর্যায়ভুক্ত করা হয়৷ আমাদের ঘরের মেয়েরা কি এতই সস্তা যে তাদের চাল-ডাল-তেল-নুনের মত তুলে অন্যের হাতে সমর্পণ করা হবে? মেয়েরা কি মুরগী না ঢ্যাঁড়স যে তাদের বস্তাবন্দী করে তুলে নিয়ে আর কাউকে বেচা বা দান করতে হবে! মানুষ মানুষকে দান করবে কোন্ স্পর্ধায়? নারী কি বেচাকেনার পণ্য? প্রাচীনকালে দীর্ঘদিন ধরে নারী-পুরুষকে নিয়ে হাটে-বাজারে কেনাবেচা চলত৷ ভাবতে বিশ্রী লাগলেও কথাটা সত্যি৷ তবে আজকের দিনে নারী পাচারকারীরা অসহায় নারীদের দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে তাদের অন্য রাজ্যের নিষিদ্ধ পল্লীতে বেচে দিচ্ছে! যা আধুনিক ভারতকে ধিক্কার জানাচ্ছে৷ বিশ্বের বুকে ভারতের মাথা নত হয়ে যাচ্ছে৷ নারীর প্রতি লাঞ্ছনাকর এই ব্যবস্থায় মানুষ জাতির মর্যাদাও ভুলুণ্ঠিত হয়৷ মানবতা তথা নব্যমানবতাবাদের মৌলনীতিও এতে লঙ্ঘিত হয়৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মতে মনু এই অমানবিক প্রথাকে সমর্থন করে ভাল কাজ করেননি৷

ব্রাহ্মণ পুরোহিতের পৌরোহিত্যমুক্ত বিবাহ প্রথা

‘রাঢ়ের তথাকথিত নীচু জাতের লোকেদের মধ্যে শৈব মতে বিবাহ এখনও প্রচলিত আছে৷  শৈব বিবাহ অনুযায়ী বর কণে মালাবদল হ’ল আর বর কণেকে কিছু ধান দিল৷ ধান দেবার অর্থ হ’ল বর সারা জীবন কণের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিল৷ বর কণের সিঁথিতে কিছুটা সিঁদুর ঢেলে দিল আর বলল---আজীবন ভাত কাপড়ং স্বাহা৷ এই সরল অনাড়ম্বর পরিবেশে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিয়ে হয়ে যায়৷ এখানে ব্রাহ্মণ পুরোহিত ডাকার কোনও প্রয়োজন নেই৷’ তথাকথিত উঁচু বর্ণের সমাজে বিয়েতে ব্রাহ্মণ পুরোহিত থাকা বাধ্যতামূলক৷ পৌরাণিক যুগে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা ধর্মের নাম করে সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ ও নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালিয়েছিল৷ নিজেদের কায়েমী শোষণের সাম্রাজ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নাম নিয়ে নিজেদের স্বার্থে শাস্ত্র তৈরী করে তা ঈশ্বরের বাণী বা নির্দেশ বলে প্রচার করত৷ শাস্ত্রের ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা করে নানা নিয়মনীতির শাসন সাধারণ মানুষের বুকে জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে তাদের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম করেছিল৷ এইভাবে সে যুগে তথাকথিত শাস্ত্র মানুষকে শাসনের মাধ্যমে ত্রাণের পরিবর্তে তার কবর খোঁড়ার ব্যবস্থা করেছিল৷ এমতাবস্থায় ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ধর্মের নামে সাধারণ মানুষকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাতেই নোতুন আদর্শ সমাজ গড়ার লক্ষ্যে যুগের প্রয়োজন্যেই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী আনন্দমার্গ নামে এক সর্বাত্মক জীবনাদর্শ দিয়েছেন৷ তারই অঙ্গ হিসেবে তিনি সমাজশাস্ত্র চর্যাচর্য রচনা করেছেন৷ সেই চর্যাচর্যেই মার্গীয় প্রথায় সমাজের সমস্ত অনুষ্ঠান যেমন শিলান্যাস, গৃহপ্রবেশ, শিশুর জাতকর্ম, বিবাহ, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই পুরোহিততন্ত্রকে বাতিল করে আনন্দমার্গের সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনী আচার্য-আচার্যা, গৃহী আচার্য-আচার্যা, অভাবে মার্গের প্রবীণ সদস্য-সদস্যাদের পরিচালনাতেই সমস্ত সামাজিক অনুষ্ঠান পালন করার বিধান দিয়েছেন৷ যার মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে চলা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ধর্মের নামে মানুষকে শোষণের যাঁতাকল ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাবে৷ এখানে উল্লেখ্য প্রচলিত বিবাহ প্রথায় যেখানে পুরুষ ব্রাহ্মণ দ্বারাই বিবাহ রীতি সম্পন্ন হয়৷ মহিলা ব্রাহ্মণের সেখানে কোনও ভূমিকাই থাকে না৷ আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ পদ্ধতিতে ব্রাহ্মণের পরিবর্তে শুধুমাত্র সন্ন্যাসী, গৃহী আচার্য বা মার্গী পুরুষই বিবাহে পৌরোহিত্য করেন না এখানে সন্ন্যাসিনী, গৃহী আচার্যা বা মহিলা মার্গীও বিবাহে পৌরোহিত্যের সমান অধিকারী৷ সারা পৃথিবীর সামাজিক অনুষ্ঠানের ইতিহাসে এই ব্যবস্থা নিঃসন্দেহে নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এক বড় বৈপ্লবিক পদক্ষেপ৷  আনন্দমার্গে পুরুষ ও নারীর সমানাধিকার শুধু পুঁথির পাতায় সীমাবদ্ধ নয়, তা বাস্তবের কঠোর মাটিতে রূপায়িত হয়েছে৷

অগ্ণিসাক্ষীর বদলে পরমব্রহ্মের নামে শপথ

প্রচলিত বিয়েতে স্থূল পদার্থ তথা নশ্বর অগ্ণিকে সাক্ষী রেখে বর কণে বিবাহ বদ্ধনে আবদ্ধ হন, পুরোহিত মন্ত্র পড়ান ইত্যাদি৷ অগ্ণি হ’ল পঞ্চভূতের এক ভূত তত্ত্ব৷ এটি হ’ল নশ্বর  স্থূল সত্তা৷ আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহে তাই নশ্বর বস্তুর পরিবর্তে যা অবিনশ্বর, শ্বাশ্বত, চিরন্তন সূক্ষ্মতম সত্তা সেই ‘পরমব্রহ্মের’ নামে বর-কণে শপথ গ্রহণ করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ আমাদের বিবাহ পদ্ধতির আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হ’ল বিবাহে অগ্ণিসাক্ষীর বদলে পাত্রপাত্রীর অভিভাবক, আত্মীয়বন্ধু সহ দর্শকরা সবাই এই বিবাহে সাক্ষী থাকেন৷ তারাও মন্ত্র পাঠ করে নিজেদের সাক্ষীত্বকে পুষ্টিকৃত করে থাকেন৷

পাত্র-পাত্রীর মাতৃভাষায় শপথ গ্রহণ

প্রচলিত বিবাহে দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরোহিত মন্ত্রপাঠ করেন৷ কিছুটা কনের অভিভাবক ও বর কনেকেও মন্ত্র পাঠ করান৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এরা অর্থ না বুঝে পাখী পড়ার মত মন্ত্র পাঠ করে যান৷ আনন্দমার্গের বিবাহে বিবাহ পরিচালক প্রথমে  বৈদিক মন্ত্র পাঠ করেন, পরে বর ও কনে তা অনুসরণ করেন৷ এটি সংস্কৃত মন্ত্র৷ আনন্দমার্গ এক বিশ্বস্তরীয় সংঘটন৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই আনন্দমার্গের শাখা-প্রশাখা আছে৷ তাই সব দেশের সব ভাষাভাষী বর কণেই এই এক বৈদিক সংস্কৃত মন্ত্র পাঠ করে আনন্দমার্গীয় প্রথায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন৷ অন্য ভাষাভাষীদের কাছে এই মন্ত্রের অর্থ অনুবাদ করে শোনানো হয়৷ সব থেকে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হ’ল সংস্কৃত ভাষায় মন্ত্র পাঠ করার পর বর ও কনে নিজের মাতৃভাষায় পরস্পর পরস্পরের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি বিধানের লক্ষ্যে শপথ গ্রহণ করেন৷ পরিশেষে বিবাহে উপস্থিত অভিভাবক সহ দর্শকরাও  সাক্ষী থেকে নববিবাহিত দম্পতির দাম্পত্য জীবনের সার্বিক কল্যাণের জন্যে মাতৃভাষায় শপথ গ্রহণ করেন৷ তাই আনন্দমার্গের বিবাহতে উপস্থিত দর্শকদের মন্ত্রপাঠ করে মাতৃভাষায় শপথ নিয়ে এই বিবাহে শুধু যে তারা সাক্ষীই থাকে তা নয়, পাত্রপাত্রীর নব দাম্পত্য জীবন যাতে সর্বার্থে সুখকর ও মধুময় হয়ে ওঠে সেই লক্ষ্যে তারা দায়বদ্ধ থাকে৷ সবসময় তাদের পাশে থাকার আশ্বাস দেয়৷ এটা হ’ল বিবাহে উপস্থিত দর্শক সাক্ষীদের সামাজিক দায়িত্ব৷ প্রচলিত আর কোনও বিবাহ প্রথায় বর কণে সহ উপস্থিত সকলকে মাতৃভাষায় শপথ গ্রহণের বিধান নেই৷ দর্শকদের নবদম্পতির সার্বিক কল্যাণে কোনও দায়বদ্ধতাও নেই৷

উপরে উল্লেখিত বিশেষত্ব গুলোই আনন্দমার্গ বিবাহ পদ্ধতিকে অনন্য সাধারণ করে তুলেছে৷ তাই নিঃসন্দেহে আনন্দমার্গের এই বিবাহ পদ্ধতি হ’ল বৈপ্লবিক বিবাহ পদ্ধতি৷ বর্তমান সমাজের জাত-পাত,বর্ণগত, ধর্মমতগত ও লিঙ্গ বৈষম্যগত ভেদাভেদ তথা বিশ্লেষণকামী চিন্তাধারা ও কাজের ফলে ভারত তথা বিশ্বের ঐক্য, সংহতি যখন চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন, হতাশার গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জমান, এমতাবস্থায় আনন্দমার্গের বৈপ্লবিক বিবাহ পদ্ধতি তাদের কাছে নোতুন আশার আলোর দিশারী তথা সামাজিক সংশ্লেষণের এক দৃঢ় বজ্রনির্ঘোষ৷

(তথ্যসূত্র ঃ ‘নারীর মর্যাদা’, ‘ওম্ নমঃ শিবায়’ --- শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)