আনন্দমার্গের সর্বাত্মক রেণেশাঁ কর্মসূচী

লেখক
শ্রীরবীন্দ্রনাথ সেন

বহু লক্ষ বছরের শ্রমসাধনা ও কর্মপ্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে মানুষের আজকের এই সভ্যতা৷ মানব সভ্যতার এই ইতিহাস কেবল যে ধারাবাহিক ভাবে উন্নতির পথে এগিয়েছে তা নয়, সভ্যতা এগিয়েছে নানান উত্থান–পতনের মধ্য দিয়ে৷ এগিয়ে চলতে গিয়ে নূতনকে বরণ করেছে–বিদায় দিয়েছে বহু পুরাতনকে৷ এগিয়ে চলতে চলতে সে হয়ে যায় ক্লান্ত, শ্রান্ত তখন তার গতি শ্লথ, অগ্রগতি রুদ্ধ৷ আবার সে যেন জেগে ওঠে, নূতন উদ্যমে এগিয়ে চলে, নূতন ভঙ্গীতে নূতন পথে৷ এই যে পরিবর্তন একে বলা যায়, পুনর্জাগরণ বা ‘রেণেশাঁ’৷ এই পুনর্জাগরণ আনতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে৷ আনন্দমার্গের প্রবক্তা শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী এই সর্বাত্মক রেণেশাঁর কথা বলে গেছেন তাঁর বিভিন্ন পুস্তকে৷ তিনি তাঁর বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই রেণেশাঁ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন৷ তাঁর এই সর্বাত্মক রেণেশাঁ চিন্তাধারা সম্পর্কে কিছুটা বিস্তারিত আলোচন করছি৷

মানুষের ধর্ম তার মানবতা৷ মানুষের যে মানবতা এতদিন ঘুমিয়ে ছিল তাকে জাগাতে হবে৷ জাগরণ আনতে হবে জীবনের সকল স্তরে সকল ক্ষেত্রে৷ জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর রয়েছে–জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক৷

ক. জাগতিক স্তর ঃ

জাগতিক স্তরকে আবার কতগুলি উপস্তরে ভাগ করে আলোচনা করা যায় ঃ–

১. বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ঃ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই অর্থাৎ আজ থেকে দশ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে মানব জাতির আবির্ভাবের ঊষালগ্ণ থেকেই মানুষের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্ক৷ যতদিন মানুষ থাকবে ততদিন বিজ্ঞান থাকবে৷ তাই বিজ্ঞানকে মানুষের সেবা ও কল্যাণের কাজে লাগাতে হবে৷ মানব সমাজের যথার্থ প্রগতির জন্যে প্রয়োগ করতে হবে৷

২. সামাজিক অগ্রগতি ঃ সমস্তরকম সামাজিক বৈষম্য দূর করে মানব সমাজের সাম্য, ভাগবত ও আস্তিত্বগত সন্তুলানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷

জৈব সংরচনাগত পার্থক্য ঃ একজন মানুষের মতই প্রতিটি প্রাণী ও উদ্ভিদের কাছে তার জীবন অত্যন্ত প্রিয়৷ মানুষের মতই তাদেরও বেঁচে থাকার জন্মগত অধিকার আছে৷ সেই অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ ‘মানুষ সবাই আপন, একই মর্মে গাঁথা সবারই হিয়া, সবাকার একই প্রয়োজন৷’

জন্মগত বৈষম্য ঃ জন্মের ভিত্তিতে তৈরী হয়েছে সুবিধাভোগী উচ্চবর্ণ ও বঞ্চিত নিম্নবর্ণ৷ একদেশে অর্থের প্রাচুর্য৷ অন্যদেশে দারিদ্র্যের অভিশাপ৷ মানুষের সৃষ্টি এই সামাজিক বৈষম্য খুবই খারাপ৷ তা দূর করতে রচনাত্মক কাজ করতে হবে৷

নারী পুরুষের পার্থক্য ঃ নারীরা অনেকেই  সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত৷ মেয়েরা কি গবাদি পশু না কাপড়ের পুঁটলি যা বিয়ের সময় দান হিসেবে দেওয়া হয়? তা হওয়া উচিত নয়, তারাও মানুষ৷ সমাজে পুরুষ বা নারী কোনো পক্ষের একাধিপত্য থাকা উচিত নয়৷ উভয়েরই সামবায়িক নেতৃত্বে থাকা উচিত৷ সমাজের অর্ধেক নারীদের অবহেলা করে মানব সমাজের সর্বাত্মক প্রগতি হবে কীভাবে?

বর্ণগত বৈষম্য ঃ ভৌগোলিক কারণে ও ঐতিহাসিক কারণেই সমাজে বর্ণগত পার্থক্য দেখা যায়৷ গায়ের রঙ সাদা, কালো বা হলদে এগুলি কোনো মৌলিক পার্থক্য নয়৷ তার ওপর ভিত্তি করে কোনো সামাজিক বৈষম্যও মানায় না৷

৩. রাজনৈতিক ঃ এক দেশ অন্য দেশকে শোষণ করছে বা একই দেশে এক জনগোষ্ঠী অন্য জনগোষ্ঠীকে শোষণ করছে৷ শুধু অর্থনৈতিক শোষণ নয়৷ সামাজিক ক্ষেত্রে নীতিবাদীদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে৷ রাজনৈতিক জীবনকে অবশ্যই বিশ্বৈকতাবাদের ভিত্তিতে গড়ে তুলতে হবে৷

৪. অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ঃ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রয়েছে চরম অসাম্য ও শোষণ৷ ঔপনিবেশিক শোষণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে আজও রয়ে গেছে৷ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকলকে নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তির নিশ্চিততা দিতে হবে৷ মার্কসবাদের মত শঠতা পূর্ণ, অসারতত্ত্ব মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করছে কিনা খতিয়ে দেখতে হবে৷

৫. সাংস্কৃতিক জীবন ঃ মানবজীবনের বহুমুখী অভিব্যক্তির সমাহারই হচ্ছে সংস্কৃতি৷ সমগ্র মানবজাতির সংস্কৃতি এক৷ মনে রাখতে হবে সংস্কৃতি এক কিন্তু অভিব্যক্তি ভিন্ন৷

শিক্ষা সাংস্কৃতিক জীবনেরই অঙ্গ৷ শিক্ষা হবে নিঃশুল্ক, তা বিশ্বৈকতাবাদের ভিত্তিতে হওয়া উচিত৷ শিক্ষা দিতে সমাজে এক এক অঞ্চলের স্থানিক পরিস্থিতি, সমস্যা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে৷

খ. মানসিক স্তর ঃ

মানসিক জগতেও রয়েছে নানান ধরণের ব্যাধি৷ মানসিক সমস্যাগুলিকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়৷

১. মানসভৌতিক জগৎ ঃ এই স্তরে রয়েছে নানান ভাবজড়তা৷ যার ফলে এক মানব সমাজ বিভিন্ন রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে গেছে ও একই রাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্ম মতে বিভক্ত হয়েছে৷ একই ধর্মমত আবার বিভিন্ন জাত–উপজাতে ভাগ হয়েছে৷ এক গোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মনে করে পরমপুরুষের আশীর্বাদধন্য, আর অন্যরা সব অভিশপ্ত৷ এই মানসিক ব্যাধি দূর করতে হবে৷

২. ভৌতমানসিক জগৎ ঃ কেউ কেউ ভাবেন মানুষের আহারের জন্যেই ঈশ্বর জীব–জন্তুর সৃষ্টি করেছেন৷ এই মানসিক রোগ দূর করতে হবে৷ এই বিশ্ব সকলের জন্যে৷ মানুষ, পশু, পাখি, উদ্ভিদ–সকলের সমান অধিকার৷

৩. বিশুদ্ধ মানসিক জগৎ ঃ ত্রুটিপূর্ণ মানসিকতার কারণে কোন ব্যষ্টি বা গোষ্ঠী প্রায়ই অন্যকে দমন ও পীড়ন করতে চেষ্টা করে৷

৪. মানসাধ্যাত্মিক জগৎ ঃ মানসাধ্যাত্মিকতার নামে৷ মজহব বা উপধর্মের (রেলিজন) নামে মানব সমাজে অসাম্য তৈরী হয়েছে৷ ধর্মের নামে হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম৷ আমাদের মনে রাখতে হবে একমাত্র ভূমা সত্তা, চরম সত্তাই আমাদের রক্ষক৷ সেই আমাদের জীবনের চরম ও পরম লক্ষ্য৷

গ. আধ্যাত্মিক স্তর ঃ

সমস্ত কিছুকে অধ্যাত্মিকতার দিকে চালিত করে দিতে হবে৷ আদর্শের ক্ষেত্রে কর্মের ক্ষেত্রে৷ ভাষার ক্ষেত্রে, ঐক্যের ক্ষেত্রে সর্বত্রই এর উত্তরণ হওয়া দরকার৷ অস্তিত্বের প্রতিটি অণুপরমাণুকেই আধ্যাত্মিকতায় রূপান্তরিত করতে হবে৷ কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের জন্যে, ত্রুটিপূর্ণ নির্দেশনার জন্যে, মানুষ এ সত্য ভুলে গিয়ে আত্মিক শক্তিকে মানস শক্তিতে ও মানস শক্তিকে জড় শক্তিতে রূপান্তরিত করে চলেছে যা প্রগতির পরিপন্থী৷

রেঁনেশাকর্মীদের এই সব ত্রুটির বিরুদ্ধে সরব হতে হবে৷ সকলকেই বিচার বুদ্ধি সমর্থিত পুনর্জাগরণের পথে এগিয়ে চলতে হবে৷ তবেই মানব জাতির কল্যাণ, জগতের কল্যাণ৷

‘মানুষ যেন মানুষের তরে সব কিছু করে যায়৷

একথাও যেন মনে রাখে পশুপাখী তার পর নয়

তরুও বাঁচিতে চায়৷’ –প্রভাত সঙ্গীত৷