সমাজে নারী ও পুরুষ পাখীর দুটি ডানার মতো৷ একটা ডানা যদি পঙ্গু হয়, তা হলে একটিমাত্র ডানা দিয়ে পাখী উড়তে পারে না৷ ঠিক তেমনি সমাজে নারী যদি অবহেলিত হয়, শোষিত হয়, নির্যাতিত হয়, যা আজকে হচ্ছেও, এ অবস্থায় সমাজের প্রকঁত প্রগতি হতে পারে না৷ নারী পুরুষের জননী৷ এই সত্য মদগর্বী কিছু পুরুষ ভুলে যায় ও নারীর ওপর নির্যাতন চালায়৷
বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে, কিছু পশুস্বভাবযুক্ত পুরুষ যেভাবে মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাচ্ছে তা মানব সভ্যতার মুখে চরমভাবে কালি লেপন করছে৷
আজ তাই সঙ্গতভাবেই নোতুন করে প্রশ্ণ উঠছে, একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ কি ধীরে ধীরে বিবর্তনের উল্টো পথে চলে পশু হয়ে যাচ্ছে? বর্তমানে পত্র–পত্রিকায় যেভাবে নারী–নিগ্রহ , নারী–পাচার, নারীর ওপর পাশবিক অত্যাচারের খবর বেরুচ্ছে, তাতে প্রতিটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরই মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে৷
আর, এইসব ঘটনা ছাড়াও বলতে হয়, বর্তমান সমাজে মেয়েদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছে৷ দেশের আইনে নারী পুরুষের সমান অধিকার স্বীকৃত৷ কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনি কুসংস্কার, ভাবজড়তা, অজ্ঞতা অনুপ্রবিষ্ট হয়ে রয়েছে যে আইন–প্রশাসনও সেখানে প্রবেশের অধিকার পাচ্ছে না৷ আর সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারে আজ বন্দিনী নারীসমাজ৷
তারপর, পণপ্রথার জগদ্দল পাষাণের নিষ্পেষণ তো রয়েছে কত নারীর জীবন যে এই পাষাণের নির্মম পেষণে নিপিষ্ট–নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে – তার কোনো হিসেব নেই৷
সমাজের কিছু সংখ্যক মহিলা হয়তো আজ শিক্ষিত হয়ে সমাজের উচ্চ প্রশাসনিক পদে আসীন বা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছেন, কিন্তু সমগ্র নারী সমাজের তুলনায় তাঁদের সংখ্যা নগন্য৷
কিছু নারী আবার আধুনিকতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতা, নগ্ণতা ও বেলাল্লাপনাকে প্রশ্রয় দিয়ে দেখাতে চাইছে, তারা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়৷ কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা, সভ্যতা ও সমাজ চেতনার উন্মেষ তাদের মধ্যে কতটা হচ্ছে, সেটাও প্রশ্ণের৷ বলতে গেলে তাদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অভব্য আচরণ এক শ্রেণীর পুরুষকে অতিমাত্রায় উচ্ছৃঙ্খল হয়ে নারীদের প্রতি পাশবিক আচরণে প্ররোচিত করছে৷ সমাজের আবহাওয়া তাতে আরও দূষিত হচ্ছে৷ আসলে এটাও যে প্রকৃত শিক্ষার অভাব এতে কোনো সন্দেহ নেই৷
সার্বিকভাবে বলতে হচ্ছে, সারা বিশ্ব জুড়ে নারীরা অবহেলিত, নির্যাতীত, শোষিত৷ বলা বাহুল্য, এর ফলে গোটা সমাজ পিছিয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা সারা পৃথিবীরই৷ এই পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতন বন্ধ করা ও নারী জাতিকে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সমগ্র বিশ্ববাসীর মনে নব চেতনার জাগরণ কল্পে ১৯৭৫ সালটিকে রাষ্ট্রসংঘ আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ হিসেবে পালন করেছিল৷ আর সেই বছর থেকে রাষ্ট্রসংঘ থেকে ঘোষণা করা হয় প্রতি বছর ৮ই মার্চের দিনটিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করা হবে ও এইদিনে বিভিন্ন সভা–সমিতি তথা নানানভাবে প্রচারের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে নারীর ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা হবে৷ সেই থেকে প্রতি বছর এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে ও নারী নির্যাতন বন্ধ তথা নারী প্রগতিতে গতি আনার প্রয়াস চলছে৷ এই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মহান দার্শনকি ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তঁার প্রাউট দর্শনে ‘নারী অধিকার’ সম্পর্কে যা বলেছেন, তা সঙ্গত কারণেই তুলে ধরছি৷ তিনি বলেছেন, ‘‘আজও পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থায় নারীর স্থান প্রায় দাসীর মতই৷ এটা কেবল মন্দই নয়, এটা নিন্দনীয়ও৷ নারীদের ওপর এ ধরণের অবদমন ও ভাবজড়তার (ডগমা) সাহায্যে তাদের ওপর এধরনের মানস–র্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো উচিত৷’’ নারী জাতিকে সর্বপ্রকার শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্যে যা চাই তাও তিনি তাঁর প্রাউট দর্শনে স্পষ্টভাষায় ব্যক্ত করেছেন৷ তিনি বলেছেন,‘‘এই ভাবজড়তার (ডগমা) বিলোপের জন্যে ও মানসিক শোষণের কবল থেকে নারী ও নারীত্বকে মুক্ত করতে চাই– (১) বিশ্বের সমস্ত দেশে সমস্ত নারীর জন্যে অবৈতনিক শিক্ষা, (২) সামাজিক শিক্ষাগত ও ধর্মমতের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার বৈষম্যের অবসান, (৩) সমস্ত নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা৷’’ প্রাউট প্রবক্তা আরও বলেছেন, ‘আমরা বিশেষ করে নারীদের মধ্যে সৃষ্টি করতে চাই এক বলিষ্ঠ গতিশীল ও বৈপ্লবিক সমাজ চেতনা৷ নারীরা নব প্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে সর্বপ্রকার দাসত্বের প্রতীক ও ভাবজড়তাগুলোকে নিশ্চিহ্ণ করতে উঠে পড়ে লেগে যাক৷ আমরা চাই, নারীরা সমমৈত্রী–ভিত্তিক সহযোগিতার নূতন যুগের সূচনা করুক৷ আজকের নারী জাতি হোক নূতন বিপ্লবের অগ্রদূত৷ গৌরবোজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে মানবতার এই অভ্যুত্থান অত্যাবশ্যক৷’’
- Log in to post comments