অর্থনৈতিক গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা চাই

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই  বিভিন্ন ভাবে কি কেন্দ্রীয় সরকার কি রাজ্য সরকার দরিদ্র্য জনসাধারণের সমস্যা সমাধানের নামে নানান পাঁয়তারা কষছেন, নানা ধরণের চমক দিয়ে চলেছেন৷ কিন্তু স্বাধীনতার পর ৭৪ বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল আজও গরীব জনসাধারণের দুর্দশার অন্ত নেই৷ আসলে পুঁজিবাদ বা মার্কসবাদ–এদের কোনটাই দরিদ্র্য মানুষের যথাযথ কল্যাণ করতে পারবে না৷ প্রাউটের অর্থনৈতিক গণতন্ত্রই একমাত্র বিকল্প৷

প্রাউটের অর্থনীতির গোড়ার কথা হ’ল, বিশ্বের প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণকে সুনিশ্চিত করা ও উত্তরোত্তর তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করা৷ যাতে করে দেশ–কাল–পাত্রের পরিবর্ত্তনের সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হয় তার ব্যবস্থা করা৷

নূ্যনতম চাহিদা বলতে প্রাথমিকভাবে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসস্থান ও শিক্ষার কথা আসে৷

এগুলো একটা মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে অত্যাবশ্যক প্রাথমিক চাহিদা৷ অস্তিত্বটাই জীবনের সমস্ত কিছু নয়, এটাও ‘প্রাউট’ মানে৷ তার জীবনের বিকাশ (ভাতি) চাই৷ তারপর দেখতে হবে, মানুষ যেন তার জীবনে পরম আনন্দ লাভ করতে পারে৷ কিন্তু প্রথমে তার যা চাই  তা হ’ল অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে অত্যাবশ্যক অন্ন–বস্ত্রাদি প্রাথমিক উপাদান সমূহ৷

প্রাউট–প্রবক্তা তাই তাঁর রচিত ‘আনন্দসূত্রম্’ গ্রন্থের ৫ম অধ্যায়ে প্রাউটের মূল সূত্রগুলি উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন,

‘‘ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি সম্পদ প্রতিটি মানুষের সাধারণ সম্পত্তি, কিন্তু বিশ্বের কোনো কিছুই ষোল আনা সমান হতে পারে না৷ তাই মানুষের যা সর্বনিম্ন প্রয়োজন তার ব্যবস্থা সবাইকার জন্যেই করতে হবে অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসগৃহ, শিক্ষা এগুলির ব্যবস্থা সবাইকার জন্যেই করা অবশ্য কর্তব্য৷ মানুষের আবার সর্বনিম্ন প্রয়োজন যুগে যুগে পাল্টে যায়৷’’

ওই গ্রন্থে অন্যত্র তিনি আরও বলেছেন, ‘‘প্রতিটি মানুষের সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটাবার দায়িত্ব সমাজের কিন্তু যদি এই দায়িত্বের প্রেরণায় প্রেষিত হয়ে প্রত্যেকের গৃহে অন্ন প্রেরণের ব্যবস্থা করে, প্রত্যেকের জন্যে গৃহ–নির্মাণ করিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে ব্যষ্টির কর্মপ্রচেষ্টায় ভাঁটা পড়বে – সে ক্রমশঃ অলস হয়ে পড়বে৷ তাই সর্বনিম্ন প্রয়োজন মেটাতে গেলে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন নিজ সামর্থ্য মত পরিশ্রমের বিনিময়ে মানুষ যাতে সেই অর্থ উপার্জন করতে পারে সেই ব্যবস্থাই সমাজকে করতে হবে ও সর্বনিম্ন প্রয়োজনের মানোন্নয়ন করতে হলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়ে দেওয়াই হবে তার প্রকৃষ্ট উপায়৷’’

এখন, প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করতে হবে – এটা হ’ল প্রাউটের মূল নীতি৷ এখন এই ‘নীতি’–কে বাস্তবায়িত করা হবে কীভাবে? এ ব্যাপারে প্রাউট কী বলছে – তা আমাদের জানা দরকার৷

বর্তমান সরকার ভেবেছেন দেশের গরীব মানুষকে চাল বা বিভিন্ন ভাবে কিছু দান দক্ষিণা দিয়ে তাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দেবেন–এটা আসলে জনগণের কাছে সস্তায় বাহাদূরী পাওয়ার বা ভোট সংগ্রহের উপায়ও হতে পারে, কিন্তু এতে জনগণের যথার্থ কলাণ হবে না৷ যেমন, নামমাত্র মূল্যে চাল/গম দিলেই কি খাদ্য সমস্যা মিটে যায়? খাদ্যের জন্যে কি চাল/গম ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন নেই? মানুষের পুষ্টির জন্যে শ্বেতস্বার কার্বোহাইড্রেট ছাড়া প্রোটিন, বিভিন্ন ভিটামিন প্রভৃতি অত্যাবশ্যক, আর তা না হলে পুষ্টির অভাবে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে৷ আর সেই রেশনের কারণে মৃত্যুও প্রকৃতপক্ষে অপুষ্টিজনিত মৃত্যু অর্থাৎ খাদ্যাভাবে মৃত্যুর নামান্তর মাত্র৷

আর, সরকারী কোষাগার উজাড় করে কেবল দানছত্র খুলে চললে অচিরেই কোষাগার খালি হয়ে যাবে৷ এটা সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে মানা যায় কিন্তু স্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না৷ কারণ, সরকারী কোষাগারের তো জনগণের প্রদত্ত করের অর্থেই তৈরী হয়েছে৷ তাই কোষাগার ক্রমশঃ শূন্য হয়ে যাওয়া মানে শেষে ‘ঋণ করে ঘি’ খাওয়ার দশা হবে৷ তারপর দেউলিয়া হয়ে যেতে হবে৷

তৃতীয়তঃ, জনসাধারণের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ কেবল সস্তায় বা বিনা ব্যয়ে চাল/গম প্রাপ্তিতে হবে না, চাই অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা, বাসগৃহ ও শিক্ষা৷ আর এ সব করতে গেলে অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ণ চাই৷ দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ণ ছাড়া এর কোনো স্থায়ী ‘শটকার্ট’ পদ্ধতি নেই৷

বর্তমানে সরকার দেশ–বিদেশের পুঁজিপতিদের ডেকে এনে তাদের মাধ্যমে বড় বড় শিল্প গড়ে তোলাটাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ণের একমাত্র উপায় বলে মনে করেন ও সেই মত কর্মসূচী গ্রহণ করে চলেছেন৷ তাই সরকার অর্থনৈতিক উদারীকরণ তথা  বিশ্বায়ণ, এফ. ডি. আই’কে সাদর আমন্ত্রণ– এই নীতি নিয়ে চলেছেন৷

আগেই বলা হয়েছে, প্রাউটের মতে জনসাধারণের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ করতে গেলে সর্বপ্রথম যা করণীয় তা হ’ল – জনগণের ১০০ শতাংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা৷

পুঁজিপতিরা শিল্প গড়ে তোলে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে অর্থাৎ যতদূর সম্ভব কম অর্থ বিনিয়োগ করে অধিক থেকে অধিকতর আয় করার উদ্দেশ্যে৷ সেই কারণে তাঁরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে৷ আর এই সব অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বেশী সংখ্যায় কর্মীর প্রয়োজন হয় না৷ এই সব শিল্পে মূলতঃ প্রায় সমস্ত কাজই যন্ত্রের মাধ্যমেই হয়, ফলে এর জন্যে প্রয়োজন এই সব প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত দক্ষ মুষ্টিমেয় কর্মী৷ তাই দেশের বিপুল সংখ্যক বেকারদের কর্মসংস্থান এর দ্বারা কখনোই সম্ভব নয়৷

এই সমস্ত বড় বড় শিল্প গড়ে তুলে, সেই শিল্প দ্রব্য বিদেশে রপ্তানি করে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা দেশে সংগ্রহ করা যাবে, কিন্তু তাতে দেশের দরিদ্র জনসাধারণের প্রয়োজন মিটবে না, তাদের নূ্যনতম চাহিদা মিটবে না৷

অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় ধনীদেরই বিলাসোপকরণ বাড়বে মাত্র৷ এতে দেশের পুঁজিপতি, উচ্চবিত্ত লোকেরা ও তাদের প্রসাদপুষ্ট এক শ্রেণীর রাজনৈতিক নেতার বিপুল সম্পদ বৃদ্ধি হতে পারে৷ আর সেই কারণে দরিদ্র মানুষের দুর্দশা চরম বৃদ্ধি পেলেও উচ্চবিত্ত মানুষদের বিপুল আয়বৃদ্ধির জন্যে সরকারী হিসেবে দেশের গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাবে৷ তখন দেশ নেতারা ঢ়াক পিটিয়ে বলতে পারবেন, ‘আমাদের দেশ এগিয়ে চলেছে’৷ আর, বর্তমানে এইটাই হচ্ছে৷

প্রাউট তাই উন্নয়ণের এই পুঁজিবাদী নীতিকে সমর্থন করে না৷ প্রাউট ‘অর্থনৈতিক গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনসাধারণের নূ্যনতম চাহিদা পূরণ তথা ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির নীতিতে বিশ্বাসী৷