বাংলা সাংস্কৃতিক জগতকে বোম্বের ‘গিলে খাওয়া’ থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসুন

লেখক
তপোময় বিশ্বাস

সম্প্রতি দেশে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দী সিনেমা ‘পাঠান’ বাংলার সিনেমা হলে ও মাল্টিপ্লেক্সে দেখানোর ব্যাপারে হল মালিকদের উদ্দেশ্যে এক ফতেয়া জারি করেছে ওই সিনেমার প্রযোজক সংস্থা যশরাজ ফিল্মস৷ মুম্বাইয়ের এই অবাঙালী বেনিয়া প্রযোজক সংস্থার ফতেয়া অনুযায়ী হিন্দী সিনেমা ‘পাঠান’ বাংলার সিনেমা হলগুলিতে দেখাতে গেলে সেখানে কোন বাংলা ছবি দেখানো চলবে না৷ এই নির্দেশ অমান্য যারা করবে তাদের হলে ‘পাঠান’ ছবি দেখানো হবে না৷

বোম্বে থেকে পাঠানো অবাঙালী বেনিয়াদের এই আদেশ বা আরো ভালো বলা যায় প্রভুত্ব আরোপ আসলেই বর্তমানে বাঙালীদের  চরম দুর্বল মানসিকতারই পরিচয় দেয়৷ তারা বুঝে গেছে যে বাঙালীরা হিন্দী সিনেমা, অবাঙালী তারকাদের সিনেমা গল্প থাক না থাক দেখার জন্য নিজের মাতৃভাষায় অভিনীত সিনেমাকেও পরিত্যাগ করতে দ্বিধাবোধ  করবে না৷ করবেই না কেন? সত্যজিৎ পরবর্তী যুগ থেকে তো সেই বলিউডি কায়দায় বেশিরভাগ ল্যারালাপ্পা মার্র্ক সিনেমাই মোটামুটি  বাংলা রিমেক করে তৈরী হয়ে আসছিল৷ যেদিন থেকে বাঙালী তার  নিজের উন্নত সুক্ষ-সাংস্কৃতিক বোধ সম্পন্ন সিনেমা-চলচ্চিত্রকে বাদ দিতে শুরু করেছে সেই দিন থেকেই ‘বোম্বের গিলে খাওয়া’ নীতি বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতেও শুরু হয়ে গিয়েছে৷ গিলতে গিলতে আজ এই আজ এই পর্যায়ে এসেছে যে তাদের আদেশে বাঙলাতে বাংলা সিনেমা চালানো যাবে না৷ অবাঙালী ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুঠবার জন্যেই বাঙলাতে ব্যবসা করতে এসেছে তাদের তো এটা দেখার  কথা নয় যে বাংলা সিনেমা মরল না বাঁচল৷ তাই বাঙলায় অবাঙালীদের নির্মিত সিনেমা হল বা মাল্টিপ্লেক্সে তারা  বাংলা সিনেমা তুলে দিয়ে ওই  সিনেমাই চালাচ্ছে৷ আর পেটের তাগিদে কিছু বাঙালী সিনেমা হল মালিক বোম্বের আদেশ মানতে বাধ্য হচ্ছেন৷ সাধারণ জনগণ অতশত বোঝেন না বা গভীরে যেতে চান না স্বাভাবিকভাবেই তারা শুধু মনোরঞ্জন খোঁজেন, তাই তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই৷ কিন্তু বাংলা সিনেমা জগতে ‘পাঠান’ নামক অশ্লীল হিন্দী ছবির আগ্রাসনের দায় থেকে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না৷ রাজনীতি টানছি না কিন্তু আমরা দেখি প্রতিবছরই নন্দনে অনুষ্ঠিত কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মাননীয়া নিজে উপস্থিত থাকেন, পশ্চিমবঙ্গের ব্রান্ড অ্যাম্বাসাডর শাহরুখ খান তাঁকে এসে প্রণাম করেন, রাজ্যের মন্ত্রী-সান্ত্রীগণ শাহরুখ খানকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে অবধি যান৷ স্বভাবতই এই বিষয় স্পষ্ট বর্তমান রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তথা নেতামন্ত্রীদের সঙ্গে শাহরুখ খানের দারুণ মধুর সম্পর্ক৷ তাহলে বাঙলার  নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী বা তার পারিষদ বর্গ কেন শাহরুখ খানের সঙ্গে কথা বলে ওই ফতেয়া প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করছেন না? বাঙলার সিনেমা জগতে চরম বলিউডি দাদাগিরি তথা বাংলা সিনেমা, বাঙালী শিল্পী, বাঙালী প্রতিভাদের নষ্ট হওয়ার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তাদের নীরবতা শোভা পায় না৷ দিনকয়েক আগেই বাঙলার বিখ্যাত জনৈক পরিচালক সোস্যাল মিডিয়াতে বলছিলেন---‘বাংলা সিনেমা তার ল্যারালাপ্পা মার্কা ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কনটেন্টে নতুন ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিনেমা করছে ও তাতে তারা সফল ও হচ্ছে৷ ‘প্রজাপতি’ ‘হামি-২’ গতবছরের ‘টনিক’-এর মতন সিনেমা দারুণ চলেছে-চলছেও৷ এমন তো নয় বাংলা সিনেমা ব্যবসা করছে না৷ ‘‘হ্যাঁ অবশ্যই ঠিক যে, ‘পাগলু থেকে বেড়িয়ে প্রজাপতি’ সিনেমা বাঙলাতে তৈরি হচ্ছে বাঙালী জনমানস তা গ্রহণ করছেও সেই সিনেমা দারুণ ব্যবসা করছে৷ সামাজিক কুসংস্কারকে কাজে লাগিয়ে অসৎ উপায়ে পয়সা অর্জনের বিরুদ্ধে শিক্ষিত যুবকদের লড়াই করার উদ্দীপনা সম্পৃক্ত ‘লক্ষ্মীছেলে’র মতন উন্নত মানের সিনেমা তৈরী হয়েছে বাংলাতে৷ সুক্ষ অনুভূতিকে স্পর্শ করা যাচ্ছে এমন ছবিও নির্মিত হচ্ছে বর্তমানে৷ দুটি বয়স্ক মানুষের পারস্পরিক এডজাস্টমেন্ট, একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতাকে নিয়ে তৈরি হওয়া ‘‘বেলাশুরু’’র মতন সিনেমাগুলিও বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে৷

তাহলে বাংলা ছবি বন্ধের শর্তাবলি কেন? পাঠকবর নিশ্চয়ই অবগত আছেন-স্বাধীনতা পূর্ববতী সময়ে বিপ্লবপর্বে দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ কিংবা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ বা কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পথের দাবী’-র মতন সাহিত্য সম্ভার গুলি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের  বিরুদ্ধে বাঙালী জনমানসে বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের কাছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণ সম্পর্কে সচেতন করা, তাদের এই শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ সঞ্চার ও ব্রিটিশরাজকে ভারত থেকে  উৎখাত করার মনোবৃত্তি জাগিয়ে তুলেছিল৷ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ভয়েই ব্রিটিশসাম্রাজ্যবাদ উপরিউক্ত সাহিত্যগুলির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল৷ হ্যাঁ বর্তমানেও বাঙলাতে বলিউডি আগ্রাসনের সঙ্গে ওই বাংলা সিনেমা জগতের এক অংশ  ঘটনার  একটি সাংঘাতিক  মিল রয়েছে৷ ল্যারালাপ্পা মার্র্ক, যৌনতা সর্বস্ব হিংসাত্মক ভাবধারায় প্রেষিত হওয়া থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ বেশীর ভাগ অংশই এখনো ভোগসর্বস্ব মানসিকতার দ্বারা প্রভাবিত, হিংসা ও যৌনতা মার্জছবি তৈরীর জন্য টাকা ঢালছে যুব সমাজ যাতে ওই সবে বুঁদ হয়ে থেকে শোষণ সম্পর্কে অসচেতন থাকে৷ তবুও বলতে আপত্তি নেই বাংলাতে গোলন্দাজের মতন এমন কিছু সিনেমা তৈরি হচ্ছে যা যুব সমাজকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শোষণবাদ বিরোধী ও বিপ্লববাদ জাগ্রত করতে সহায়ক৷  যারা  ‘গোলন্দাজ’ সিনেমাটি দেখেছেন তারা জানেন কিভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের রক্তচক্ষুকে ভ্রুক্ষেপ না করে ব্রিটিশের পাঁচটা দালালদের উপেক্ষা করে চরম সংগ্রাম করে বীর বঙ্গসন্তান নগেন্দ্রনাথ সর্বাধিকারী বাঙলাতে প্রথমে ভারতীয় ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছেন৷ এই যে প্রতি পদে পদে তাঁর যে সংগ্রাম তা জন সমক্ষে  প্রদর্শনের ফলে এক সংগ্রামী মানসিকতা সিনেমার মাধ্যমে বাঙলার যুব সম্প্রদায়  অনুপ্রবিষ্ট হচ্ছে৷ এই বছরই মুক্তি পাবে  আর এক বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘‘বাঘা যতীন’’ এর  বায়োপিক৷ আমরা সবাই জানি কিভাবে চরম লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ মাতৃকার শৃঙ্খল  মোচনে নিজেকে আত্মবলিদান করেছিলেন বাঘা যতীন৷ এইসব সিনেমা প্রদর্শনে বাঙালী যুব সম্প্রদায়ের মনের মধ্যে বিপ্লববাদ জাগিয়ে তুলে ফেললেই তো বিপদ অবাঙালী বেনিয়াদের৷ বাঙলার উপর অবাধ অর্থনৈতিক শোষণকে চালিয়ে যেতে গেলে চাই বাঙালী জনগোষ্ঠীর উপর চরম মানসিক শোষণ৷ বাঙালীর কাছ থেকে তার মাতৃভাষা , সংস্কৃতি, নিজস্বতা কেড়ে নেওয়ার ফলস্বরূপ বাঙালী জনগোষ্ঠী আপনা আপনিই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের পদতলে চলে আসবে৷ তাই আমরা দেখেছি স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকেই ধাপে ধাপে  বাঙলাতে প্রথমে বাঙালীর প্রাণের ভাষা, বেঁচে থাকার উপকরণ স্বরূপ মাতৃভাষাকে  কেড়ে নেওয়ার  চেষ্টা, রাজনৈতিক দলগুলির সাহায্যে বাঙলার অর্থনৈতিক ক্ষমতা অবাঙালী বেনিয়াদের দখলে এনে, পরবর্তীতে বাঙলার চাকরি বাকরির ক্ষেত্রেও অবাঙালীদের প্রভু হয়ে ওঠার মতন কার্যসম্পন্ন করে, বাঙালীদের মানসিকভাবে ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে অর্থনৈতিক পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রেখে বাঙালীর শ্রম ও বাঙলার সম্পদ, অর্থ, কাঁচামাল লুঠ করাটাই লক্ষ৷ মহান দার্শনিক ঋষি শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন--- ‘‘চলচ্চিত্র শিল্পটির ক্ষেত্রেও ঠিক এই ব্যাপার দাঁড়িয়েছে৷ শিল্পটি রয়েছে মুষ্টিমেয় পুঁজিবাদী ব্যবসায়ীর হাতে৷ যারা ছবি তোলে শুধু বাজার চাহিদা বুঝে যে ভাব, ভাষা বা ছবিহীন পশুভাবকে ভালোভাবে জাগিয়ে তুলবে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিক নিয়মে সেই দিকেই ছুটে যাবে৷’’ একদিকে যেমন সিনেমা জগতে বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে বোম্বের পদতলে করে রাখা ও এখন তৈরি হওয়া প্রতিবাদ মুখর বাংলা সিনেমাগুলি চলতে থাকলে অচিরেই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের চরম অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে  বর্তমান বাঙলার যুব সম্প্রদায়ের  মনে মধ্যে  এক প্রতিবাদী ক্ষোভ তৈরি হওয়ার সম্ভবনা জাগবে৷ সেই আশঙ্কাতেই রক্তচোষক অবাঙালী গুজরাটি  মারোয়ারি বেনিয়ার  দল সব বাংলা সিনেমা বন্ধ রেখে হিন্দী বেলেল্লাপনা ছবি ‘পাঠান’ চালানোর ছক কষল৷

বাঙালী পাঠকবৃন্দ, আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আসুন, এই হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াই৷ আমরা অপসংস্কৃতি মার্কা হিন্দী ও তাদের রিমেক বাংলা সিনেমা বর্জন করে বেশি করে উন্নত  সংস্কৃতির পরিচায়ক বাংলা সিনেমা দেখি, উন্নত রুচি সম্পন্ন বাংলা সিনেমা তৈরী করতে বাধ্য করি৷ মায়েরা ছোট থেকেই সন্তানদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিন-জীবনের হিরো নাটকের মুখ্য অভিনেতারা নন৷ জীবনের  হিরো সেই যে বা যাঁরা প্রতি পদে পদে সংগ্রামী আত্মত্যাগী মানসিকতা ও কার্যকারিতার উদাহরণ রেখে  ও সমাজের কল্যাণ সাধনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন৷ বাঙালী জনগোষ্ঠীর মনের মধ্যে হীনম্মন্যতা বোধ তৈরী হওয়ার কোন জায়গাই নেই৷ মনে রাখতে হবে বাঙালী জনগোষ্ঠীর গর্বের, অহংকারের যা যা  আছে পৃথিবীর আর কোন জনগোষ্ঠীর তা নেই৷ কী নেই আমাদের বাঙালীদের? বাঙালীদের নিজস্ব পোশাক রয়েছে, বাঙালী নারীদের শাড়ী পরবার নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে, বাঙলার পঞ্জিকা রয়েছে, ভাষা রয়েছে, লিপি রয়েছে, বাংলার নিজস্ব উচ্চারণ রীতি রয়েছে৷ বাঙালীর নেতাজী আছেন, বিবেকানন্দ আছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আছেন, রামমোহন রায় আছেন, বিদ্যাসাগর আছেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ আছেন, ক্ষুদিরাম বসু আছেন৷ কত শত নাম জানা নাজানা ও অজানা হীরে মানিক রয়েছেন বাঙলা মায়ের৷ আর কোন জনগোষ্ঠীর এত কিছু রয়েছে? এত সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কীসের ভয়? কেন আমরা বাঙালীরা শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকব? সব বাঁধা কাটিয়ে, ভয় কাটিয়ে ভাষা-সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্র আমরা আমাদের বাঙলার  নিজস্বতায় নিজেদের  অণুপ্রাণিত করে অভ্যস্ত করে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জনগোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে তুলি৷ তবেই আমাদের প্রতিবাদ সার্থক হবে৷