বাঙলা ও মনিপুরের আত্মিক সম্পর্ক

লেখক
হরিগোপাল দেবনাথ

বিশ্বৈকতাবাদের অন্যতম পুরোধা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ন্যায় প্রবাদপুরুষের লেখনী নিঃসৃত কাব্যপংক্তি দ্বয় দিয়েই এই নিবন্ধের সূচনা করছি৷ কবিগুরু বলেছেন তাঁর ‘‘ভারত-তীর্থ’’ কবিতায়ঃ---

‘হেথা আর্য হেথা অনার্য হেথায় দ্রাবিড়-চীন

শক, হুনদল, পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন৷’’

তিনি ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যপূর্ণ জনমণ্ডলী সমূহের ব্যাখ্যামূলক পরিচয় প্রসঙ্গ বর্ণনা করতে গিয়েই উপরে  উদ্ধৃত পংক্তিদ্বয় রচনা  করেছিলেন৷ পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই এই উপমহাদেশের প্রতি পৃথিবীর নানাপ্রান্তের মানুষদের  দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল দেববন্দিত এই পূণ্যভূমির প্রতি৷ কেউ প্রাণের টানে, কেউ হৃদয়ের আকর্ষণে, কেউ বা  লোলুপ দৃষ্টি হেনে দলে দলে  নিজ নিজ সম্পদ আাহরণের তাগিদে এই দেশে মানুষরা এসেছিল--- আবার, তাদের অনেকে ফিরে গেছে৷ যার যার কাজ হাসিল করে আবার এ মাটির প্রেমে, এদেশবাসীকে ভালবেসে ফেলে থেকেও গেছে৷ এভাবেই আবহমান কাল থেকে গড়ে উঠেছে ভারতীয় জনমণ্ডলী৷

বিশ্বকবিই আবার একই কবিতায় বলেছেন---

‘‘পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার / সেথা হতে সবে আনে উপহার,/ দিবে আর নিবে মিলাবে মিলবে/ যাবে না ফিরে এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে৷’’

অর্থাৎ কবিগুরু এখানে ভারতবর্ষকে মহামানবের ‘সাগরতীর’ বলেই আখ্যায়িত করেছেন৷ অবশ্যই এই উপমাটিই ভারতবর্ষীয় মহানুভবতাকে ও তার বিশ্বৈকতামূলীয় সুমহান মানবপ্রেমকেই মননশীলতার উচ্চকোটিতে পৌঁছে দিয়েছেন৷

আর সেই নিরিখেই উল্লেখিত ভাবাদর্শের সঙ্গে যদি আজকের আমাদের চিন্তাধারার পাশাপাশি অবস্থান রেখে একটু তলিয়ে বিশ্লেষণ করতে বসি, তাহলে কেমন হয়? আসুন না, একটু দেখাই যাক না৷ কবি তো বলেছেন যে পশ্চিম-এযুগে এসে তার দ্বারা৷ খুলেই দিয়েছে যাতে পাশ্চাত্যে নবজাগরণ আর শিল্প-বিপ্লব ঘটে যাবার পর যে আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিপুল প্রসার লাভ ঘটা সম্ভব হয়েছে, এর অবদান যাতে প্রাচ্যে,সহ সমগ্র বিশ্ববাসী লাভ করে সমৃদ্ধ হতে পারে৷ এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের বদান্যতা তথা উচ্চ মননশীলতার কোন জুড়ি নেই বলতেই হবে৷ কিন্তু ইয়ূরোপীয় বণিকগোষ্ঠীদের ও বিশেষ করে লুণ্ঠনকারী ও তস্কর ব্রিটিশ বেনিয়ারা কী করেছিল তাদেরই লোক পাঠিয়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নামে এদেশীয়দের উপর অমানবিক জুলুম চালিয়ে, ঠকিয়ে আমাদের সম্পদ নিংড়ে নিয়েছে আমাদের কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংহতি, দেশপ্রেম, মানবিক সম্প্রীতিকে তছ্‌নছ করেছে আমাদের ঐতিহ্যকে দুম্‌ড়ে-মুচড়ে দিয়ে অবশেষে  দেশভাগের  নামে ভারতীয়ত্ববোধের মূলে কুঠারঘাত করেই সর্বনাশ সাধন করে গেছে৷ আর এরই অনিবার্য  পরিণতির শিকারে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে গোটা বাঙালী তথা বাঙালী জনগোষ্ঠী৷ দেশ বিভাজনের বাঙালী পিতৃ-পুরুষদের বাস্তুভিটে থেকে উৎখাত হয়েছে৷ ভারতের মাটিতে পা রেখে ওরা উদ্বাস্তু হয়ে কিছু সংখ্যক পুনর্বাসিত হয়েছে আন্দামানে, কিছু সংখ্যক সুন্দরবনে বাঘের মুখে কিছু বা দণ্ডকারণ্যে পাহাড়ী রুক্ষভূমিতে কিছু সংখ্যককে মারা হয়েছে, পশ্চিম বাঙলার মরিচ ঝাঁপিতে৷ সিপিএম ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে জলে ডুবিয়ে আর অন্নজল- রসদ বন্ধ করে রেখে দিয়ে৷ উদ্বাস্তুদের অর্ধেকের বেশী সংখ্যকের অদ্যাবধি কোনই হিল্লে করা হয়নি৷ আরও মর্মান্তিক যে যারা দৌড় ঝাঁপ করতে গিয়ে বা প্রত্যাশার দিনগুণে গুণে কোন প্রকারে যমালয়ে পৌঁছে গেছেন তাদের কী গতি হয়েছে তাতো আর আমাদের  জানবার কোন উপায়ই রইল না কিন্তু, যারা এখন ত্রিপুরা অসম, মনিপুর, মেঘালয়, পশ্চিমবঙ্গ ইত্যাদি রাজ্যসমূহে পুনর্বাসিত হিসেবে রয়েছেন বা পুনর্বাসন না পেলেও নিজেদের ভরসায়  বাঁচতে চাইছেন ও  চেয়েছেন--- তাদের এখন ৰলা হচ্ছে--- বিদেশী, অনুপ্রবেশকারী (ঘুষ,পেটিয়া সাম্রাজ্যবাদীদের  ভাষায়), ডি-বোটার ও আরও বিশ্রী বা কদর্য রকমের অপমানজনক ভাষায়৷

অথচ, মূল সত্য হচ্ছে ত্রিপুরা ও অসম, মেঘালয় মিজোরাম ইত্যাদি সবই প্রকৃতপক্ষে বাঙলারই অবিচ্ছেদ্য অংশ বা ভূভাগ ছিল৷ অর্থাৎ বাঙালী আজ নিজ দেশেই প্রবাসী বা রিফ্যুজি কী চমৎকার, তাই না৷

সম্মানিত পাঠকবর্গ, আপনারা অবশ্যই জানতে পেরেছেন যে মণিপুর সরকার তার রাজ্যে বাঙালীদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যই ইনার লাইন পারমিট’’ (আই-এল-পি) চালু করেছেন৷ এর প্রতিবাদেই জনস্বার্থে ‘আমরা বাঙালী’ দলের কেন্দ্রীয় সচিব থাকাকালীন মাননীয় কেন্দ্রীয় সচিব শ্রী বকুল চন্দ্র রায় মহাশয়  ভারতের মাননীয়  সুপ্রীম কোর্টে এক  মামলা করেছেন ন্যায় বিচার  পাবার উদ্দেশ্যে৷ উক্ত মামলাটির হীয়ারিং-এর পরই মাননীয় সর্র্বেচ্চ আদালত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও মনিপুর সরকার উভয়েকেই এক মাসের সময় দিয়ে নোটিশ জারি  করেছেন৷ আর এর প্রতিবাদে এখন শুরু হয়েছে নোংরা রাজনৈতিক খেলায় মদতপ্রাপ্ত কতিপয় সংঘটন দ্বারা বাঙালীদের গালি-গালাজ ও  হুমকি-ধমকানিসহ বাঙালী বিদ্বেষী আন্দোলন৷ আরও চলছে  ‘আমরা বাঙালী’ দলের বিরুদ্ধে  কুৎসা প্রচার৷ সম্প্রতি সেখানে  আমরা বাঙালী দলের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সচিব শ্রী বি সি রায়ের কুশপুতুল দাহ করা হয়েছে৷ (ক্রমশ)