বাঙলার সম্ভাবনা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আজকাল অনেক জায়গাতেই গভীর নলকূপের সাহায্যে জল তুলে চাষ করা হয়, এটা বিজ্ঞান সম্মত নয়, কারণ যত পরিমাণ জল তোলা হয়, তত পরিমাণ জল ওই গভীরতায় ফিরে যেতে পারে না৷ রোদের তাপে অনেকটা বাষ্প হয়ে যায়, আর কিছুটা গাছপালারা টেনে নেয়৷ এর ফলে জল–তল হু হু করে নেবে যায়৷ মালদা, নদীয়া ও অন্যান্য জেলায় যেভাবে গভীর নলকূপ ব্যবহার করা হচ্ছে তা যদি বন্ধ না করা হয়, তাহলে জল–তল এত নেবে যাবে যে ভবিষ্যতে সেচের জলের অভাবে সমস্ত ফসল ও গাছপালা মরে যাবে৷ চাষীদের এই সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে৷ নদীর জলকে সেচের কাজে লাগানোটাই সর্বোত্তম উপায়৷

তিলাবনী পাহাড়ের পাশ দিয়ে ধলকিশোর নামে একটি ছোট নদী বেরিয়ে আসছে বাঁকুড়ার দিকে৷ আর শুশুনিয়ার উত্তর দিক থেকে আর একটি ছোট নদী বেরিয়ে আসছে–নাম গন্ধেশ্বরী৷ বাঁকুড়া শহরের কাছে দু’য়ে মিলে নাম হ’ল দ্বারকেশ্বর৷ দ্বারকেশ্বর যাচ্ছে আরও পূর্ব দিকে হুগলী জেলার আরামবাগে৷ বাঁকুড়া–মেদিনীপুর সীমান্তে শীলাবতী ও জয়পাণ্ডা নদী দুটো মিলে শিলাই নদী নাম নিয়ে মেদিনীপুর–হাওড়া–বাঁ সীমান্তে দ্বারকেশ্বরে মিশছে৷ মেশার পর দ্বারকেশ্বরের নাম হয়ে যাচ্ছে রূপনারায়ণ৷ সে তমলুকের কাছে গিয়ে ভাগীরথীতে মিশছে৷ এই যে নদী জল নিয়ে আসছে তিলাবনী পাহাড় থেকে, শুশুনিয়া পাহাড় থেকে, সেই জল সমুদ্রে গিয়ে মিশছে৷ সেই জলকে যদি আমরা বাঁকুড়া সদর মহকুমা, আরামবাগ মহকুমা, মেদিনীপুর, ঘাটাল, আর তমলুক মহকুমায় চাষের কাজে লাগাতে পারতুম তবে তা কৃষিতে সুন্দরভাবে ব্যবহূত হত৷ জমি বন্ধ্যা হয়ে পড়ে  থাকতো না৷ এখন জলটা অযথা সমুদ্রের লোনা জলে গিয়ে মিশছে৷

সেচের সমস্যার সমাধান ঠিকভাবে করতে পারলে বছরে চারবার চাষ করে’ প্রচুর ফসল ফলানো যাবে৷ উদাহরণস্বরূপ একই জমিতে আমন, বোরো ও আউশ ধান ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সারা বছর ধরে চাষ করা যাবে৷ এক–একটা ফসলের জন্যে ৯০ দিনই যথেষ্ট৷ ভাদ্রমাসে আউস ধান ওঠে, তারপর কার্ত্তিক অগ্রহায়ণ পর্যন্ত আমন ধানের সময়৷ শীতের শেষ থেকে গরমকাল পর্যন্ত বোরো চাষ চলতে পারে৷ এইভাবে সারা বছর ধরেই নানারকমের ধানচাষ চলতে পারে৷

রাঢ়ের এঁটেল মাটি বেশীক্ষণ জল ধরে’ রাখতে পারে৷ সায়র, জলাধার, বাঁধ ইত্যাদি তৈরীর ক্ষেত্রে এই এঁটেল মাটিই আদর্শ৷ এই ধরণের মাটিতে মাছের চাষও হতে পারে কারণ এই ধরণের মাটি জল ধরে’ রাখতে সক্ষম৷ আমন ধানের জন্যেও এই এঁটেল মাটি খুবই ভাল৷ উত্তর বঙ্গে কিছু জায়গায় এঁটেল মাটি থাকলেও অন্যান্য জায়গার মাটি দোঁয়াশ মাটি৷ উত্তরবঙ্গের মধ্যে (অবিভক্ত) দীনাজপুর জেলা আমন ধানের উৎপাদনের আদর্শ জায়গা৷ বাঙলাদেশের মাটি মূলতঃ বেলেমাটি হওয়ায় আউস ধানের উপযুক্ত৷ দোঁয়াশ মাটিতে আউশ ভাল হবে৷ ত্রিপুরার মাটিতে আউশ, আলু ও গ্রীষ্মকালীন ফসল ভালো হবে৷ ত্রিপুরায় এত লঙ্কার চাষ হতে পারে যে তা বাঙলাদেশের বাজারেও পাঠানো যাবে৷ রাঢ়ের সরষের উৎপাদন, ও বাঙলার অন্যত্র তিলের উৎপাদন ভালো হবে৷ তিল থেকে নানাধরণের জিনিস তৈরী হতে পারে৷ তিল একটা অর্থকরী ফসল৷ আখ চাষে যেহেতু এক বছর ধরে’ জমি আটকে থাকে সেহেতু আখ চাষের বদলে বীট চাষ করার ওপর জোর দেওয়া উচিত৷ পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় আর বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড় অঞ্চলে বীটের চাষ খুবই লাভজনক হবে৷ বীট আর শাঁখ আলু থেকে চিনি তৈরী করা যেতে পারে৷ রাঢ়ের ডাল ও আলুর চাষ ভালো হবে৷ বীরভূম জেলা তার নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে উত্তরবঙ্গ ও অসমে আলু সরবরাহ করে, ঠিক একইভাবে হুগলী জেলা কলকাতায়, বর্দ্ধমান জেলা (বর্তমানের ঝাড়খণ্ড সহ) বিহারে, আর মেদিনীপুর মধ্যপ্রদেশে আলু সরবরাহ করে৷ পূর্বরাঢ়ের আলুর চাষ খুবই ভালো হয়৷ ত্রিপুরায় উৎপাদিত সরষেও বাঙলাদেশে পাঠানো যাবে৷ ত্রিপুরার মাটি আনারস ও কলার পক্ষেও খুবই ভালো৷ ত্রিপুরায় চায়ের চাষ হতে পারে, কিন্তু চায়ের গুণমান ভালো হবে না৷ কাঁটাল* উৎপাদনের জন্যে যেহেতু তেমন কোন বিশেষ গুণসম্পন্ন মাটির দরকার পড়ে না তাই সারা বাঙলাতেই কাঁটালের চাষ হতে পারে৷ কাঁটালের রস ও কাঁটালের বীজ স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ভালো৷ কাঁটালের রসকে টিনজাত করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রাও আসবে৷

ত্রিপুরায় বুনো প্রজাতির কচুর ফলন হতে পারে৷ সব্জি চাষের জন্যে বৃষ্টির জলের প্রয়োজন না হলেও মাঝেমাঝেই জলের প্রয়োজন হয়৷ সেদিক থেকে দেখলে নদীয়া আর কুষ্ঠিয়া জেলায় প্রচুর সব্জির চাষ হতে পারে৷

নারকেল গাছের জন্যে যেহেতু লবণাক্ত জলের দরকার সেহেতু দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্র তীরবর্ত্তী অঞ্চলে নারকেলের চাষ খুবই ভালো হবে৷ অর্থাৎ (অবিভক্ত) ২৪ পরগণা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও টেকনাকে প্রচুর পরিমাণে নারকেলের চাষ হতে পারে৷ অপরদিকে শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার থেকে শুরু করে কাছাড়, করিমগঞ্জ পর্যন্ত অঞ্চল সুপুরি চাষের আদর্শ জায়গা৷ সুপুরি চাষের জমিতেই গোলমরিচ চাষ লাভজনক হবে৷ নোনামাটিতে পান চাষ ভালো হয়, সেই জন্যেই মেদিনীপুর জেলার তমলুক মহকুমা পান চাষের আদর্শ জায়গা৷ আর এখানকার পানই সারা ভারতের বাজারে যায়৷ অবশ্য সমগ্র দক্ষিণবঙ্গেই পান চাষ চলবে৷

তিল তিন প্রজাতির–শীতকালে হয় লাল তিল, গরমকালে সাদা তিল, আর বর্ষাকালে কালো তিল৷ তিলের খোসা খুবই উন্নতমানের সার৷ তিলের খোল গোরুর খাদ্য ও সার দুই কাজেই লাগে৷ তিলের গুঁড়ো বিসুক্ট, পাঁউরুটি, পুডিং ও পরিজ তৈরীর কাজে লাগতে পারে৷ উত্তরবঙ্গ, বাঙলাদেশ ও অসমের মাটি তিল চাষের পক্ষে খুবই ভালো৷

যে সমস্ত জমি ধান চাষের উপযুক্ত নয় বা লাঙ্গল দেওয়া সম্ভব নয় সেই সমস্ত জমিতে পায়রা ফসল হতে পারে৷ অর্থাৎ একই জমি থেকে একই সময়ে চাল, ডাল ও মাছের ব্যবস্থা হতে পারে৷

(এর পরের অংশ আগামী সংখ্যায়)