তন্ত্রের সঙ্গে বেদের আদর্শগত তফাৎ বেশী বললে যথেষ্ট হবে না, বলা উচিত খুব বেশী৷ তন্ত্র হ’ল সম্পূর্ণ বৈবহারিক (Practical), তন্ত্র অস্বাভাবিক কোন কিছুকে সমর্থন করে না৷ ফলে তন্ত্রের মধ্যে স্বাভাবিরতা থাকায় সেটা সমাজে সহজেই গৃহীত ও সহজেই আদৃত হয়৷ মানুষ একে সহজেই নিজের জিনিস বলে মনে করতে পারে৷ যেমন বেদে একটা শ্লোকে আছে---‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য ররান্ নিৰোধত’--- ওঠো, জাগো, উপযুক্ত আচার্যের নিকট সত্বর উপস্থিত হও ও সাধনা মার্গে চলতে শুরু করো৷ এতখানিতে বেদ ও তন্ত্রে মিল আছে৷
এরপর বেদ বলছে, ‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি’৷ বেদ বলছে, তুমি যে পথ ধরে চলতে চাইবে বা চলা শুরু করবে সে পথে শাণিত ক্ষুর বিছানো রয়েছে, সত্য ও সতর্কতার সঙ্গে চলতে হবে৷ তন্ত্র কিন্তু তা’ বলছে না৷ তন্ত্রের পথটা হচ্ছে কী? মানুষের মধ্যে যে স্বাভাবিক সৎগুণ আছে, সেগুলোকে ধাপে ধাপে বাড়িয়ে দেওয়া হবে৷ আর যে যে অসৎ গুণ আছে সেগুলোকে ধাপে ধাপে কমিয়ে দেওয়া হবে৷ সুতরাং ‘‘ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া’’ প্রশ্ণই ওঠে না৷
এইজন্যেই তন্ত্র পরিবেশের সঙ্গে সংঘর্ষ করে ধাপে ধাপে জয়ী হতে হতে ওপরে ওঠে৷ পরিবেশকে বাদ দিয়ে কেবল নিজের মনে এগিয়ে চলার যে প্রচেষ্টা বেদেতে আছে, তন্ত্র তা স্বীকার করে না৷ যেমন তন্ত্র বলে মন থেকে ভয় দূর হয়ে যাবে, বেদও এই কথাটা বলে৷ কিন্তু মন থেকে ভয় দূর করো সাধনা করতে করতে,মন থেকে ভয় দূর হয়ে যাবে, বেদ এই কথাটা বলে৷ কিন্তু এই একদিন কবে হবে কে জানে? তার প্রত্যাশায়, তার প্রতীক্ষায় বসে থাকা যায় না৷ আর এছাড়া এইভাবে কাজ করতে করতে কোন কিছু অস্বাভাবিক তো ঘটে যেতে পারে যা ব্যষ্টি বা সমষ্টির জীবনের পক্ষে ভাল নাও হতে পারে৷
কিন্তু তন্ত্র বলছে কী ? --- না, পরিবেশের মধ্যে গিয়ে পড়ো, ভয় নেই৷ ধাপে ধাপে ভয় দূর হয়ে যাবে৷ আজ যতটা ভয় রয়েছে, কাল ততটা থাকবে না৷ পরশু ভয় আরও কমে যাবে, দশদিনের মধ্যে দেখবে ভয়শূন্য হয়ে গেছে৷ তন্ত্রের সাধনা পদ্ধতিটা হ’ল এই ধরনের৷
প্রথম দিন থেকে তান্ত্রিক যখন মহাশ্মশানে সাধনা করতে যায় বা যাবে বা গিয়েছিল সেদিন তার ভীষণ ভয় করে, গা ছম্ ছম্ করে, কিন্তু যখন সে ফিরে এল মনটা অনেক হাল্কা হয়ে গেছে৷ পরের দিন যখন গেল, পরের দিন মানে পরের রাত্রে যখন গেল, তখন আর আগেকার মত ভয় নেই৷ ধীরে ধীরে এইভাবে ভয়কে জয় করতে হয়, সমস্ত বৃত্তিগুলোকে পরাভূত করার এইটাই হ’ল তন্ত্রোক্ত পদ্ধতি---বৈবহারিক৷ এদিকে ভিতরে ভিতরে তার মনের সাধনা তো চলছেই---সে সাধনাটা তার সম্পূর্ণ মানসিক৷ অর্থাৎ মানসিক সাধনার সঙ্গে শারীরিক- মানসিক সাধনার একটা সুন্দর সম্বন্বয় রয়েছে৷ বেদেতে কিন্তু এই শারীর-মানসিক দিকটা একেবারেই নেই৷ কেবল মানসিক দিকটা রয়েছে যে জন্যে অনেক সময় অনেক গোলমালের সম্ভাবনা থেকে যায়৷
তন্ত্র বলেছে, বেদ প্রথমেই মানুষকে হঠাৎ কোন কিছু করে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ তার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়৷ তাই বৈদিক সাধনা সমাজ জীবন থেকে সরে গেছে, নেই বললেই চলে৷ নামমাত্র এককালে ছিল, আজ আরও নামমাত্র আছে অর্থাৎ কিছুই নেই৷ বৈদিকী সাধনার আজ যেটুকু ব্যবহার রয়েছে সেটা সাধনা নয়, সেটা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করা৷ ‘‘আমাকে পথ প্রদর্শন করো, আমাকে তান্ত্রিকী সাধনা দাও৷’’ তান্ত্রিকী সাধনা পাবার জন্যেই আজ এই বৈদিকী দীক্ষা৷ সে বলে, ‘‘হে ঈশ্বর, আমি সাধনা করতে চাই, আমি তান্ত্রিকী সাধনা করতে চাই, শিখতে চাই তুমি আমাকে শেখবার সুযোগ দাও’’৷ তন্ত্র বলছে---
‘‘সর্বে চ পশবঃ সন্তি তলবদ্ ভূতলে নরাঃ৷
তেষাং জ্ঞানপ্রকাশায় বীরভাবঃ প্রকাশিতঃ৷
বীরভাবং সদা প্রাপ্য ক্রমেণ দেবতা ভবেৎ৷৷’’
বলছে, প্রথমাবস্থায় প্রতিটি মানুষ পশুরই সমান৷ যখন সে আলের সন্ধান পায়নি, জ্ঞানের আলো পায়নি, তখন তার কী করণীয়, কী অকরণীয় ৰোঝেনি৷ যখন সে ৰোঝে না কী চর্য আর কী অচর্য, তখন সে পশুরই সমান৷ তাকে ধাপে ধাপে উঠতে হয়৷ তন্ত্র সাধনার প্রথম ধাপে যখন সে এগিয়ে চলল, যখন তাঁর জ্ঞান এল, বিদ্যে-বুদ্ধি এল, করণীয়, কী অকরণীয় ৰুঝল, তখন আর পশু নয়, তখন সে বীর৷ তন্ত্রে এই সাধনাকে বলা হয় বীরাচার, সে আবার ‘‘বীরভাবং সদা প্রাপ্য ক্রমেণ দেবতা ভবেৎ’’, এই বীরাচারের সাধনা করতে করতে সেইটাতেই যখন একেবারে সমাহিত হয়ে গেল ---যেমন ভয়ের বিরুদ্ধে যুঝে চলেছে যে সে বীরাচারী, আর ভয়কে যে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলেছে সে আর বীরাচারী নয়, সে আরও ঊধের্ব উঠেছে, তাকে বলা হয় দিব্যাচারী৷ আর যে ওই দিব্যাচারের সাধনা করছে, রিপু-পাশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এগিয়ে গেছে এই দিব্যাচারীর তখন কাজ হবে কী? ধীরে ধীরে ব্যষ্টিস্বার্থের ওপরে উঠে সমষ্টি স্বার্থ অর্থাৎ পরমপুরুষে মিলে যাওয়া৷ এই ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়া হ’ল তন্ত্রের লক্ষ্য৷ তাই তন্ত্র হ’ল সম্পূর্ণ নির্দোষ সাধনা যাতে ভয়ের লেশমাত্র সম্ভাবনা নেই৷ আর তাতে মানুষের জীবনের স্বাভাবিকতা কোন অবস্থাতেই ক্ষুণ্ণ্ হয় না৷
পৃথিবীতে সদাশিব যখন তন্ত্র সাধনার প্রবর্ত্তন করেন, বলতে পারি সেইটাই প্রথম সাধনা৷ তন্ত্র সাধনাই সাধনা৷ তন্ত্র বাদে সাধনা হয় না, আর সাধনা বাদে তন্ত্র হয় না৷ আর তন্ত্রের আরও একটা বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেটা হচ্ছে বেদে সিদ্ধান্তের Theory) ওপর ভিত্তি করে বৈবহারিক জীবনে (Practical life) চলতে হবে৷ কিন্তু সিদ্ধান্তের যতক্ষণ না বৈবহারিক জগতে মূল্য নিরুপিত হচ্ছে, ততক্ষণ তার ভিত্তিতে চলতে গেলে সেই চলাটা ঠিক হতেও পারে, নাও হতে পারে৷ কিন্তু তন্ত্র তা নয়৷ চলার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার থিয়োরীটা তৈরী হয়েছে, সেইহেতু সর্বক্ষেত্রেই তা অব্যর্থ, অমোঘ ৷
(১৩ নবেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা, সকালবেলা)