জনৈক ইউটিউবারের (পড়ুন ফুড ব্লগার) সমাজ মাধ্যমে আপলোড করা এক ব্লগিং ভিডিওতে তিনি বলছেন ‘বাঙলাতে বিহারের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করলে সমস্যাটা কোথায়? সবাই খেটে খাওয়া মানুষ, প্রত্যেকের কাছে ভারতের নাগরিকত্ব রয়েছে৷’
শুধু তিনিই নন, অনেকের কাছেই এই বাঙালী-অবাঙালী ব্যাপারটা নিয়ে প্রাদেশিক, সাম্প্রদায়িকতার ধোঁয়াশা রয়েছে৷ অনেকেই মনে করেন ‘সবাই ভারতীয়’ তাহলে বাঙলাতে বিহারীরা বা অবাঙালীরা ব্যবসা করলে সমস্যাটা কোথায়? আজকের এই আলোচনার শুরুতেই বলে রাখি আমার প্রবন্ধটি সাম্প্রদায়িকতার উগ্রতা ছড়ানোর উদ্দেশ্যে নয়৷ বরঞ্চ জনকল্যাণের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির পথ ধরে বিশ্বৈকতাবাদে পৌঁছানো অর্থাৎ স্থানীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ মজবুত করার মাধ্যমে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করার সঠিক, সুস্পষ্ট চিন্তা নিয়ে লেখা৷
যাইহোক, যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছিলুম, ‘বাঙলাতে অবাঙালীরা ব্যবসা করলে সমস্যা কোথায়?’ সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে সমস্যা ধরা পড়বে না৷ অর্থনীতির দৃষ্টিতে দেখলে সমস্যা অবশ্যই আছে যদি না সেই অবাঙালী ব্যবসায়ীরা বাঙলাতে ব্যবসা করে তা থেকে উপার্জিত অর্থ (মুনাফা) বাঙলার বাইরে পাচার না করে, অর্থের বহিঃস্রোত না ঘটিয়ে উপার্জিত সেই অর্থ বাঙলা তথা স্থানীয় অঞ্চলেই বিনিয়োগ করে৷ ভাবাবেগের ঊর্ধে উঠে অর্থনীতি, তার পরিভাষায় অর্থের মূল্য বেড়ে চলে তার চলমানতায়, অর্থাৎ টাকা যত হাত ঘুরতে ততই তার মূল্য বাড়তে থাকে৷ এটাই অর্থনীতির মৌলিক কথা৷ Keep the wagons moving এর মতনই Keep coins (money) moving কথাটিও একই ভাবে সত্য৷ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্তিত প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব সংক্ষেপে ‘প্রাউট’ দর্শন আমাদের বুঝিয়েছে পুঁজিবাদী শোষকেরা চরম অর্থনৈতিক শোষণ চালাতে বিশ্বজুড়ে অবিরাম স্থানীয় অর্থনীতিকে শোষণ করছে ও অর্থের বহিঃস্রোত ঘটাচ্ছে৷ ‘প্রাউট’ এর মতে, কোন একটি বিশেষ অঞ্চলে যদি ভাসমান লোক থেকে যায় তাহলে অবাধভাবে সম্পদের বহিঃস্রোত হতে থাকে ও সেই এলাকার অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হয়৷ তাই সম্পদের বহিঃস্রোতের বিরোধিতা করতেই হবে৷ কোনক্রমেই একটা সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের মূলধনের বহিঃস্রোত ঘটানো চলবে না৷ যারা একটা বিশেষ অঞ্চলে অর্থ রোজগার করে অন্য এক অঞ্চলে তা ব্যয় করে, তাদেরকেই বহিরাগত বা ‘‘অস্থানীয়’’ মানুষ বলে’গণ্য করা হবে৷ কারন তাদের কাজকর্ম যে এলাকায় তারা কর্মরত সেই এলাকার স্বার্থানুকুল হচ্ছে না৷ এতে ওই বিশেষ এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশোপযোগী মূলধনের বহিঃস্রোত ঘটছে ও ফলে ওই এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে৷
সুতরাং কোন বিহারী বা কোন অবাঙালী যদি বাঙলাতে ব্যবসা করে তা বাঙলাতেই ব্যয় করে তাহলে বাঙলার অসুবিধে হবে না৷ কিন্তু কোন বিহারী বা অবাঙালী যদি বাঙলাকে ব্যবসা করার বাজার, উপনিবেশ হিসে গড়ে তুলে এখানে ব্যবসা করে বাঙালীর পকেট থেকে মুনাফা অর্জন করে তা বাঙলা তথা স্থানীয় অঞ্চলে বিনিয়োগ/ব্যয় না করে সেই লাভের গুড় বাঙলার বাইরে ব্যয় করে ও বাইরের স্টক হোল্ডারে প্রেরণ করে তাহলে বাঙলার ও বাঙালীর অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ উন্নতির কোন আশা থাকে না৷ এখানেই আপত্তিটা৷ যেমস্ত বহিরাগত অবাঙালী ব্যবসায়ীরা বাঙলাতে থাকছে অথচ বাঙলার ভাষা-কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজে একাত্ম না হয়ে শুধুমাত্র বাঙলাকে বাজার গড়ে মুনাফা লুটে তা বাঙলার বাইরে পাচার করে বাঙলার অর্থনীতির উন্নয়নের পথ অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে৷ এক ‘‘ভারতীয়’’ ভাবাবেগের আড়ালে এদের প্রশয় দেওয়া নিজ জনগোষ্ঠী এবং নিজের পায়ে কুড়ুল মারার সমার্থক৷ তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তবের চিত্রপট মেলালেই দেখা যাবে, পরিসংখ্যান বলছে কোটি কোটি ‘‘অ-স্থানীয়’’ অবাঙালীরা বাঙলার ফুটপাত থেকে ব্লিডিং কমপ্লেক্স, হাকারি থেকে শপিং মল সবকিছুরই দখলদারিত্ব নিয়ে নিয়েছে৷ হ্যাঁ, অবশ্যই ব্যবসায়ে অনীহা বাঙালীর বড় দোষ তবে শুধু এই তত্তটাই এটা প্রমাণ করবে না যে ওই জন্যেই বাঙলার ব্যবসা, হকারি অবাঙালীরা গ্রাস করে নিয়েছে৷ পশ্চিমবঙ্গে বিগত ৩৪ বছরের বাম সরকারের অপশাসনের সঙ্গে মার্কবাদীদের তীব্র বাঙালী বিদ্বেষ ও ধর্মঘটের রাজনীতি একদিকে যেমন বাঙালী শিল্পপতি-উদ্যোগপতিদের বাঙলা থেকে বিতাড়ন করেছে, নতুন উঠতি বাঙালী শিল্পপতিদের শিল্পোদ্যোগকে নস্যাৎ করে অবাঙালী বেনিয়াদের বাঙলাতে প্রবেশ করিয়েছে৷
পাশাপাশি স্থানীয় আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধিকে ব্রাত্য রেখে বিশ্বমানব হওয়ার দিবাস্বপ্ণ ও অবাঙালী ভোটব্যাঙ্কের মোহে বাঙলার ব্যবসা, সম্পদের মালিকানা অবাঙালীদের কুক্ষিগত হতে সাহায্য করেছে৷ অস্বীকার করার জায়গা নেই বর্তমান সরকার ও একই পথে হাটছে৷ তাই বাঙলার অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বাঙালীদের কেই এগিয়ে আসতে হবে৷ ভারতবর্ষ ৪৪টি সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল বিশিষ্ট ‘যুক্তরাষ্ট্র’৷ এই দেশের সর্বাত্মক উন্নতি সাধন করতে হলে ‘বাঙালীস্তান’ সহ উক্ত ৪৪টি সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চলের স্বয়ম্ভরতা আনতে হবে৷এই সামাজিক-অর্থনৈতিক অঞ্চল গুলির স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনার শর্তগুলির মধ্যে অন্যতম স্থানীয় অর্থনীতিতে বহিরাগতদের (অ-স্থানীয়) হস্তক্ষেপ মুক্ত করতে হবে ও অর্থের বহিঃস্রোত বন্ধ করতে হবে৷ অতএব বাঙলার অর্থনীতিতে বহিরাগত অবাঙালীদের হস্তক্ষেপ তথা দখল মুক্ত করতে হবে৷ বাঙালীদের ব্যবসাতে আগ্রহী হতে হবে৷ পণ্য কেনা-বেচা তেও বাঙালীদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে তাদের অর্থে অবাঙালী শোষকদের মুনাফা তৈরী না হয়, বাঙলার সম্পদ-অর্থ বাঙলার বাইরে পাচারের কোন সুযোগ বাঙালীদের দ্বারা নতুন করে তৈরি না হয়৷ সরকারি রিপোর্ট বলছে বাঙলা থেকে যত লোক কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে যায় তার পাঁচ গুণ বেশী বহিরাগতরা বাঙলায় পরিযায়ী হয়ে রয়েছে৷ এইভাবে বাঙলার হকারি, লেবার, ফুটপাত, রাজপথ সবকিছুই বহিরাগতদের দখলে চলে যেতে থাকলে বাঙালী যাবে কোথায়? বাঙালীদেরই ঐক্যবদ্ধ শোষণবিরোধী গণ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙলার হারিয়ে যাওয়া অর্থনীতি, ব্যবসা, সম্পদ,সবকিছুরই পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হতে হবে৷ বাংলা ভাষা, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক জগৎে যেভাবে হিন্দী আগ্রাসন, বেলেল্লাপণাসর্বস্ব সংস্কৃতির বেনোজল প্রবেশ করিয়ে বাঙালী জাতিকে ভোগে উন্মত্ত করে জাতির চিন্তাশক্তি ক্ষয় করে ক্লীব মেরুদণ্ডহীন জাতিতে পরিণত করার মতলব করছে ,তার বিরুদ্ধেও লড়াই করাও বাঙালীদের আশু কর্তব্য৷ শোষণ বিরোধী আন্দোলনের এই সংগ্রামই বাঙলার হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেবে৷এই পথই আবার বাঙলাকে আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসনের পদে বরণ করে নেবে৷
- Log in to post comments