বিকৃত মানসিকতা বীভৎস অত্যাচার–প্রতিকারের পথ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

নির্ভয়াকাণ্ড থেকে মনিপুর রাজনৈতিক দল থেকে কবি সাহিত্যিক শিল্পী প্রতিবাদে মুখর সমাজের সর্বস্তরের মানুষ৷ তবু এই ধরণের বর্বরতার অবসান হচ্ছে কই বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে৷ শুধু সংখ্যায় নয়, বর্বরতা নৃশংসতার মাত্রাও৷

আসলে সমাজ থেকে এই কদর্যতা নির্মূল করার আন্তরিক প্রচেষ্টা কি প্রশাসন, কি রাজনৈতিক দল ও বুদ্ধিজীবী সমাজ কারো মধ্যেই নেই৷ নেই, কারণ যুবসমাজকে এই কু–পথে নামানোর দায় এইসব কবি,সাহিত্যিক, শিল্পী ও রাজনৈতিক দাদা–দিদিরা অস্বীকার করতে পারে না৷

ফরাসী বিপ্লব থেকে শুরু করে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম কবি সাহিত্যিক শিল্পীদের অবদানের  কথা সমাজ সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন৷ নীলদর্পন, পথের দাবী, আনন্দমঠ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের  বুকে কাঁপন ধরিয়ে ছিল৷ নিষিদ্ধ হয়েছিল এইসব বই৷ গানে কবিতায় উপনাস্যের কথা কাহিনি তখন দেশ প্রেমের প্লাবন বহিয়ে দিয়েছিল৷ আজ বিপরীত মুখী শিল্প, সাহিত্য চলচিত্র যুব সমাজকে বিপথে ঠেলে দিচ্ছে৷ তারই পরিণতি এই বিকৃত মানসিকতা এই বীভৎস অত্যাচার৷ এরই প্রতিকারের  পথ খুঁজতেই এই সম্পাদকীয়৷ অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সামাজিক বিভেদ, বিদ্বেষ এই ধরণের অপরাধ প্রবণতার অন্যতম কারণ৷ সমাজে যদি প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের গ্যারান্টীর ব্যবস্থা করা হয়, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় ক্রয়ক্ষমতা অর্জনের ব্যবস্থা করা হয় – তাহলে সমাজের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে৷ আইন ও প্রশাসনের চাপ সর্বক্ষেত্রে অবশ্যই রাখতে হবে, তবে এ ক্ষেত্রে আইন ও প্রশাসনের নিয়ম–কানুন মানার দিকে সাধারণ মানুষের ঝোঁক খুবই বৃদ্ধি পাবে৷

দ্বিতীয়তঃ  শিক্ষার অভাব৷ পশু জন্ম থেকেই পশু বৃত্তি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, এগুলো তাকে খুব একটা শেখাতে হয় না৷ কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে জন্ম থেকেই একটা শিশু প্রকৃত মানুষের স্বভাব–চরিত্র পায় না৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন– তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশু–পাখী সহজেই পশুপাখী কিন্তু মানুষ প্রাণপণ চেষ্টায় তবে মানুষ৷ তাই মানুষের ক্ষেত্রে শিক্ষার একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে৷ সেই কারণে শিক্ষাকে মানবজাতির মেরুদণ্ড বলা হয়৷ সেই শিক্ষার যদি ত্রুটি থেকে যায় তাহলে তা মানুষের সমাজে প্রতিফলিত হবেই হবে৷ প্রকৃত শিক্ষা বলতে কেবল জীবিকা উপার্জন তথা অর্থ সংগ্রহের  উপায় শিক্ষা নয়, শিক্ষার প্রকৃত অর্থ ‘মানুষ’ হওয়ার শিক্ষা, সমাজ–চেতনা বৃদ্ধির শিক্ষা, সৎ–নীতিবাদী হওয়ার শিক্ষা, জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, কীভাবে মনুষ্যত্বের যথার্থ বিকাশ হবে – সেই সব শিক্ষা৷ সমাজে এই শিক্ষার খুবই অভাব, তাই সমাজের সর্বস্তরে অপরাধ প্রবণতা এত বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ কেননা, মনুষ্যত্বের বিকাশের প্রকৃত শিক্ষা না পেলে মানুষও তো জীব, তাই অন্যান্য জীবের মধ্যেকার যে স্থূল বৃত্তি তা–ই মানুষের মধ্যে প্রকট হয়ে উঠবে৷ মানুষ তখন তার স্থূল ইন্দ্রিয় প্রবৃত্তির দ্বারাই পরিচালিত হবে৷ নীতি–মনুষ্যত্ব ভুলে কীভাবে সহজে সুখ পাওয়া যাবে, যেন তেন প্রকারেণ কীভবে সুখের সামগ্রী সংগ্রহ করা যাবে, এইটাই তখন মানুষের ধ্যান–জ্ঞান হয়ে যাবে৷ মানুষ তখৱ তার বিবেকের কণ্ঠরোধ করে বুদ্ধির অপব্যবহার করবে৷ সোজা কথা মানুষ তখন সুবুদ্ধি বা শুভবুদ্ধি ছেড়ে কু–বুদ্ধির দ্বারা চালিত হবে৷ তখন তো সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে বাধ্য৷

তৃতীয়তঃ, অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থের অপব্যবহার৷ যে সমস্ত মানুষের হাতে অতিরিক্ত সম্পদ রয়েছে, যা তার প্রকৃত প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি, ওই প্রয়োজনাতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থ মানুষকে কু–পথে চলতে প্রলুব্ধ করে৷ এই সমস্ত ধন–কুবেররা চোরাকারবারি, মাদক দ্রব্যের ব্যবসা – এসব করে৷ এরাই অসৎ রাজনৈতিক নেতাদের ভুড়িভুড়ি টাকা দিয়ে নির্বাচনে জেতাতে সাহায্য করে৷ পরে তারা ক্ষমতায় এলে তাদের সাহায্যে অসৎ পথে সম্পদ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে৷ এরাই সংস্কৃতিকে কলুষিত করে৷ এরা সিনেমার দূরদর্শনের সিরিয়ালে অশ্লীলতা, কুরুচি, নগ্ণতা – এ সবের আমদানি করে দেদার মুনাফা  লুঠতে থাকে৷ কারণ তারা জানে এইসব সিনেমা বা সিরিয়াল বেশী জনপ্রিয় হবে৷ জল যেমন নিম্নগামী, সাধারণতঃ মানুষের মনও তাই৷ এই সমস্ত সিনেমা, সিরিয়াল বিশেষ করে যুব সমাজের নৈতিক মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়৷ তাই মানুষের হাতে প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থাকাটা সমাজের পক্ষে ভীষণ ক্ষতিকর৷

চতুর্থতঃ, অতিরিক্ত সঞ্চিত অর্থের মত, প্রকৃত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষারহিত বুদ্ধিজীবীরাও তাঁদের জ্ঞান–বুদ্ধির অপব্যবহার করে সমাজের অকল্যাণ করেন৷ তাঁরা তাঁদের কু–বুদ্ধি ও  

কু – পরামর্শ দিয়ে শোষক তথা প্রতারক শ্রেণীকে নানান্ভাবে সাহায্য করে’ কু – পথে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করেন৷ সমাজের বিভিন্ন ঘটনাবলীর দিকে তাকালে এ সত্য সহজেই চোখে পড়ে৷

অপরাধ প্রবণতার পঞ্চম কারণ হ’ল, গতিহীনতা (ষ্ট্যাগনেন্সী)৷ মানুষের জীবনের একটা স্বাভাবিক গতি রয়েছে৷ আর গতিটা পূর্ণতার অভিমুখে৷ মানুষ যদি তার মনুষ্যত্বকে পূর্ণতার অভিমুখে পরিচালিত করার প্রয়াস না করে তা হলে জীবন গতিহীন হয়ে পড়ে ও কলুষতা পূর্ণ হয়ে ওঠে৷ তাই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, যে নদী পথ হারিয়ে সম্মুখ পানে চলতে না পারে, সে নদীকে অজস্র শৈবাল এসে বেঁধে ফেলে, ঠিক তেমনি যে মানবগোষ্ঠী সামনের দিকে এগিয়ে না চলে তাদের জীবন কলুষিত হয়ে পড়ে৷

সামনের দিকে এগিয়ে চলা মানে মনুষ্যত্বের পূর্ণতার পথে এগিয়ে চলা, মনুষ্যত্বের বিকাশই দেবত্ব আর এর পূর্ণতাই ব্রহ্মত্ব৷ মানুষের জীবনই পূর্ণত্বের পানে এগিয়ে চলার জন্যে৷ তা যদি না করে তাহলে জীবনে কলুষতা আসবে৷ তারা কেবল নিজেরাই সমাজের বোঝাই হবে না, তারা সমাজের অগ্রগতিতে বাধাস্বরূপ হয়ে উঠবে৷ তাই যারা প্রকৃত প্রগতির পথের যাত্রী তাদের বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সমাজের অগ্রগতির পথকে বাধামুক্ত করতে হবে৷