এ বিশ্বের ধন–সম্পত্তির মালিকানা ন্যায়তঃ ব্যষ্টির না সমাজের–এ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে এখন বিরাট দ্বন্দ্ব৷ ব্যষ্টি মালিকানাবাদীরা বলেন, ব্যষ্টিই যখন কলকারখানা গড়ে তুলছে–শ্রম দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে জমি–জায়গা করেছে–তাহলে এতে তার চরম মালিকানা তো সম্পূর্ণ ন্যায়সম্মত সিদ্ধ৷ প্রাউট দর্শন এখানে স্পষ্ট ভাবে বলছে ঃ এ বিশ্বের কোন সম্পদ মানুষ সৃষ্টি করে নি যিনি সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন সেই পরম ব্রহ্ম বা ভূমাসত্তাই সব সম্পদের স্রষ্টা–তিনিই প্রকৃত মালিক৷ মানুষ শুধু প্রকৃতিদত্ত সম্পদকে নিয়ে ‘ফিজিক্যাল মিক্সচার’ বা ‘কেমিক্যাল কম্পাউন্ড’ বানিয়েছে বা আকারগত পরিবর্তন করেছে মাত্র৷ তাই কোনও মানুষ এর প্রকৃত মালিক হতে পারে না৷ তবে, সমস্ত মানুষ যেহেতু সেই বিশ্বস্রষ্টা পরমপিতারই সন্তান, তাই বিশ্বের সমস্ত সম্পদে সকল মানুষের পৈত্রিক অধিকার রয়েছে৷ বাঙলার বল্লাল সেনের আমল থেকে চলে আসা জীমূতবাহন ভট্টাচার্য্য প্রণীত দায়ভাগ প্রথায় পিতৃশাসিত একান্নবর্তী পরিবারের মতই এই বিশ্বপরিবারের সমস্ত সম্পদে বিশ্বস্রষ্টার সন্তান হিসেবে সবার যৌথ অধিকার রয়েছে৷ তাই, বিশেষ কোন ব্যষ্টি এ সম্পদ বিপুল পরিমাণে সঞ্চয় করে রাখবে, আর অন্যান্যদের গ্রাসাচ্ছাদনের সম্বলও থাকবে না–এ ব্যবস্থা কোন প্রকারে মেনে নেওয়া যায় না৷ প্রাউট দর্শন তাই পুঁজিবাদের উচ্ছেদ ও প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রবর্ত্তন চায়৷ এই প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের প্রথম শর্ত হ’ল ঃ সমাজে প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম চাহিদা পূরণের অর্থাৎ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, তথা কর্ম সংস্থাপনের গ্যারান্টি চাই৷ তাই ব্যষ্টির অবাধ সঞ্চয়ের স্থান প্রাউটে নেই৷ বিশ্বের সমস্ত সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ ও ন্যায়সঙ্গত বন্টন ব্যবস্থা প্রাউটের মৌলিক অর্থনৈতিক ভিত্তি৷
এখন তাই স্পষ্ট যে প্রাউট ধনতন্ত্রের মত শিক্ষা, কলকারখানা, জমি জায়গা এ সবের ওপর ব্যষ্টির চরম ব্যষ্টিগত মালিকানা স্বীকার করে না৷ প্রাউট বলে–ভূসম্পত্তি, শিল্প, বাণিজ্যের সাধারণীকরণ করতে হবে৷ প্রাউট ‘রাষ্ট্রীকরণের’ কথা বলছে না৷ কেননা সমস্ত সম্পদের রাষ্ট্রীকরণ মানে–‘ষ্টেট ক্যাপিটালিজম’৷
এমনিতে ক্যাপিটালিজম–এ শ্রমিকের শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value) শোষণ করে ক্যাপিটালিষ্টরা৷ ষ্টেট ক্যাপিটালিজমেও এই শ্রমিকের ‘সারপ্লাস ভ্যালু’ শোষণ করা হচ্ছে ও তা করছে ষ্টেট৷ শ্রমিক যেই তিমিরে সেই তিমিরে৷ আর সরকারী শাসন–ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত তারাই ভোগ করছে সমস্ত সুখ–সুবিধা৷ যুগোশ্লাভিয়ার প্রাক্তন ভাইস–প্রেসিডেন্ট মিলোভ্যান জিলাস–এর ভাষায়–‘‘‘The communist political bureaucracy uses, enjoys, and disposes of national property’’৷ তিনি বলেন, কমিউনিষ্ট দেশেও সেই পুঁজিবাদী দেশের মত দুই শ্রেণীর সৃষ্টি হয়েছে–এক দল সুবিধা ভোগী শাসকশ্রেণী (‘‘ ন্দ্বভ্র ন্তুপ্ত্ত্রব্দব্দ’’), অপর দল বঞ্চিত সাধারণ মানুষ৷
তাছাড়া, যে রাষ্ট্রের হাতে অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক দুই প্রকার ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়–তা অত্যাচারী হতে বাধ্য(Absolute power corrupts absolutely)৷
তাই, প্রাউট কেবল মূল শিল্প ন্ন্দ্বম্ভ ঢুস্তুব্ভব্দব্ধব্জম্ভ ছাড়া অন্যান্য সব শিল্পকে ‘সমবায়ে’র আদর্শে চালানোর কথা বলে৷ সমবায়গুলির রক্ষাকবচ হিসেবেই মূল শিল্পগুলিকে অর্থাৎ কাঁচামাল সরবরাহকারী শিল্পগুলিকে (যা ‘না ক্ষতি না লাভ’ ভিত্তিতে সমবায়গুলিকে কাঁচামাল সরবরাহ করবে) ইমিডিয়েট গভর্ণমেন্ট–এর হাতে (সেন্ড্রাল গভর্ণমেন্টের হাতে নয়) রাখতে নির্দেশ দিয়েছে৷ প্রাউট বলছে, দেশের বেকার সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান সম্ভব যদি উপরিউক্ত অর্থনৈতিক নীতিতে ব্যাপকভাবে গ্রামে গ্রামে শিল্পের বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়৷ এই ভাবে গ্রামে গ্রামে গড়তে হবে (১) কৃষিভিত্তিক শিল্প–কৃষি উৎপাদনের ভিত্তিতে, (২) কৃষিসহায়ক শিল্প–কৃষিতে বৈজ্ঞানিক প্রথা প্রবর্ত্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিতে নিয়োজিত যন্ত্রপাতির নির্মাণের ভিত্তিতে, আর গড়তে হবে–(৩) স্থানীয় খনিজ পদার্থের সহজ প্রাপ্যতার ভিত্তিতে–অকৃষি শিল্প৷ আর সমবায়গুলিকে সার্থক করে তুলবার জন্যে চাই–(১) নীতিবাদী মানুষের কঠোর তত্ত্বাবধান তথা শাসন, (২) সমাজে সামবায়িক মনস্তত্ব তৈরী, (৩) সমাজের নৈতিক মানের উন্নয়ন৷ রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে পূর্ণ উদ্যোগী হতে হবে, না হলে ফাঁকী দিয়ে মহৎ কাজ করা যাবে না৷
ভারত কৃষিপ্রধান হলেও এখানে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষির সঙ্গে যুক্ত৷ কিন্তু এই কর্ষকরা এখন চরমভাবে বঞ্চিত৷ তাঁরা তাঁদের উৎপাদিত সম্পদের ন্যায্য মূল্য পায় না৷ তাই সাধারণভাবে কর্ষকশ্রেণী চরম দারিদ্র্য ও হতাশায় ভুগছে৷ এক্ষেত্রে কৃষি ও গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নের জন্যে প্রাউটের নীত হ’ল–(১) সমবায় প্রথায় চাষ, (২) কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দান, (৩) বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির প্রচলন, (৪) সরকারের পক্ষ থেকে উপযুক্ত পরিমাণে সেচ, সার, উন্নত বীজ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহের গ্যারান্টি প্রদান, (৫) কৃষিজাত দ্রব্য ও শিল্পজাত দ্রব্যের মূল্যের মধ্যে ভারসাম্য আনয়ন, (৬) উদ্বৃত্ত শ্রমকে গ্রামেই কৃষিভিত্তিক শিল্পে নিয়োগ করার সমান্তরাল পরিকল্পনা, (৭) উৎপাদন অনুসারে উৎপাদিত দ্রব্যেরই নির্দিষ্ট শতাংশে খাজনা সংগ্রহ, (৮) সমস্ত কর্ষক মজুরদের তথা তার পরিবারবর্গের মৌলিক চাহিদা পূরণের গ্যারান্টি প্রদান, (৯) কৃষিজাত দ্রব্য উৎপাদন ও বন্টনের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী লোপ করে উৎপাদক সমবায় ও উপভোক্তা সমবায়ের ব্যাপক প্রসার ঘটানো৷
- Log in to post comments