কথায় আছে রাজনীতি মানে রাজার নীতি, আবার অনেকে বলেন, রাজনীতি হলো নীতির রাজা৷ অর্থ যাই হোক, রাজনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে অবস্থিত রাজ্য বা দেশের জনগণের সার্বিক উন্নতি ও মঙ্গল সাধনে একটি সুসংবদ্ধ পদ্ধতি অবলম্বন করে শাসকবৃন্দ বা নেতৃবৃন্দ সেই রাজ্য বা দেশ পরিচালনা করবেন৷ জনগণের সার্বিক উন্নতি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা অন্ন-বস্ত্র--শিক্ষা-বাসস্থান-স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যার সমাধানই নয় , তাদের পরিপূর্ণ মানসিক ও আত্মিক বিকাশের জন্যে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিরও বিশেষ প্রয়োজন৷ এই রাজনীতি শব্দটির আর্থিক বা বৈবহারিক প্রয়োগ যেভাবেই হোক---‘‘নীতি’’ শব্দটি তার সঙ্গে সর্বদাই যুক্ত৷ অর্র্থৎ রাজনীতির সঙ্গে নীতিবাদ বা নৈতিকতার মেলবন্ধন থাকতেই হবে, নচেৎ রাজনীতি একটি দুনীর্তি বা অনৈতিক কাজকর্মের আখড়াতে পরিণত হবে৷ ভারতের মতো বিশাল গ্রামীণ এলাকাযুক্ত দেশের বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, গোষ্ঠী-সম্প্রদায়বিশিষ্ট মানুষজনের পরিপ্রেক্ষিত বিচার করলে, সেই আশঙ্কা আরও প্রবল হয়ে ওঠে৷ ভারতের নাগরিক সমুদায়ের সামগ্রিক শিক্ষার মান, নৈতিকতা ও রাজনৈতিক বিচক্ষণতা সেই পর্র্যয়ে এখনো পৌঁছায় নি যাতে তারা সঠিক নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের মতামত ব্যক্ত করবেন ও ভোটবাক্সে তা সত্য সত্যই প্রতিফলিত হবে৷ ফলে গণতন্ত্রের সার্থক রূপায়ণও ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা সমধিক৷
অপরপক্ষে দেশীয় রাজনীতিকগণ তাঁদের পেশাকে বা রাজনৈতিক কাজ কর্মকে সমাজসেবা নামে অভিহিত করেন৷ কোন নির্র্বচনে অংশগ্রহন করলে জনগণের নিকট যখন তারা ভোট ভিক্ষা করেন তখন তাদেরকে জনসেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্যে জনগণের সম্মুখে করজোড়ে প্রার্থনা জানান৷ অতএব দেখা যাচ্ছে, রাজনীতির ‘‘নৈতিকতা’’ ও জনসেবা বা সমাজ সেবার ‘সেবা’ এই দুটি শব্দ রাজনৈতিক নেতাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ৷
নৈতিকতা, সততা ও অপরের মঙ্গল ভাবনা না থাকলে সেবার ভাব কিছুতেই আসবে না৷ কারণ সেবা হচ্ছে নিঃস্বার্থভাবে মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করা-সেখানে কোনো কিছু পাওয়ার আশা থাকবে না৷ সেবা করার বিনিময় যদি বিনিময়ে অন্য কোন প্রত্যাশা থাকে, তবে তা হবে ব্যবসায়৷ ব্যবসাতে দেনা-পাওনার ব্যাপার থাকে, সেবাতে নয়-কারণ সেবা হল একতরফা৷ কিন্তু, বাস্তবিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেবার কথা বললেও তাঁদের পাখীর চোখ তথা শ্যেন দৃষ্টি থাকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মোটা অংকের মাসোহারা, আর্থিক সুযোগ সুবিধা, প্রভাব প্রতিপত্তি ও ক্ষমতার প্রতি৷ তার ওপর শাসক দলের বিধায়ক বা সাংসদ হতে পারলে তো সোণায় সোহাগা-এমনকি মন্ত্রিত্বও কপালে জুটে যেতে পারে৷ আর এর জন্য বহুবিধ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তেও তারা কুন্ঠিত হন না৷ তখন সেবা ও নীতি দুটিকে জলাঞ্জলি দিয়ে জনসেবার মোড়কে স্বার্থসিদ্ধিই প্রধান উপজীব্য হয়ে ওঠে৷ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও ভারতবর্ষের নেতা-নেত্রীরা গণতন্ত্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারেনি৷ বরং বিভিন্ন রকম গোষ্ঠী-সম্প্রদায়, ধর্ম-বর্ণ-ভিত্তিক রাজনীতি করতে গিয়ে দেশকে এক চরম ভয়াবহ পরিণতির দিকে নিয়ে চলেছে৷ অশিক্ষা, অপুষ্টি, কুসংস্কার , ভাবজড়তা ,জর্জরিত সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠী-সম্প্রদায়গত, ধর্ম-বর্ণগত বিভাজনে সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষে মানুষে পারস্পরিক বিদ্বেষ, অবিশ্বাস ও হিংসার বাতাবরণ সৃষ্টি করে চলেছে৷ ফলে কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধছে , কোথাও গোরক্ষার নামে মানুষ আহত-নিহত হচ্ছে, কোথাও সম্প্রদায়গত তোষণ আবার কোথাও একপক্ষ অপরপক্ষকে হুমকি-শাসানি দিয়ে চলেছে৷ আর দেশের মানুষের মধ্যেকার ঐক্য-সম্প্রীতির ঐতিহ্য ধূলাবলুন্ঠিত হয়ে আইন-শৃঙ্খলা জনিত পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে৷ সাংস্কৃতিক জগতেও চলছে এক অদ্ভুত অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ ৷ কোথাও সাংবাদিক খুন হচ্ছে, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগের নামে সাহিত্যসৃষ্টি ও সিনেমামুক্তিকে নিয়েও চলছে তীব্র অশান্তি৷ সাধারণ মানুষ তাদের বিচার বুদ্ধি ও রুচি অনুযায়ী কোন সাহিত্য পুস্তক পঠন-পাঠন বা কোনো সিনেমা ছবি দেখতে পারেন আবার নাও পারেন৷ কিন্তু সাধারণ মানুষকে সেই সুযোগ না দিয়ে একশ্রেণীর সুবিধাবাদী স্বার্র্থন্বেষী নেতা-নেত্রী দলীয় স্বার্থে বা গোষ্ঠীস্বার্থে দাঙ্গা হাঙ্গামায় প্ররোচনা দেয় আর তাদের নির্দ্দেশেই চ্যালা-চামুন্ডারা ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ শুধু তাই নয়, প্রতিপক্ষ দলের নেতৃবৃন্দ পরস্পরের প্রতি এমন কুরুচিকর ও কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করেন যা সাধারণ মানুষের কাছে অকল্পনীয় ও অসভ্যতার নামান্তর৷
শিক্ষাজগৎ ও সামাজিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ আরও মারাত্মক৷ ছাত্র-যুবদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও রাজনীতিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ দেশের পক্ষে মঙ্গলজনক, কারণ আজকের যুব সম্প্রদায় দেশের ভবিষ্যৎ ---দেশ ও জাতির অগ্রগতির দায়িত্ব একদিন তাদের হাতেই ন্যস্ত হবে৷ তাদের রাজনীতির শিক্ষাদানের জন্য সুস্থ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ আবশ্যিক৷ কিন্তু বর্ত্তমানে শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক হানাহানি, পেশীশক্তির ব্যবহার ও গোষ্ঠীকোন্দল এমন একটা পর্র্যয়ে পৌঁছেছে যে ছাত্রযুব সম্প্রদায় একশ্রেণীর অপরিণামদর্শী নেতৃত্বের ক্রীড়নক হয়ে প্রায়শঃই ঝগড়া লড়াই হাঙ্গামাতে জড়িয়ে পড়ছে৷ এমনকি একই দলের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে গণ্ডগোল ও হানা হানি বেড়েই চলেছে৷ ফলে শিক্ষায়তনে সুশিক্ষার পরিবেশ দুষিত হচ্ছে, ছাত্রসমাজ বিভিন্নরকম কুপ্রবৃত্তি ও নোংরা পরিস্থিতির শিকার হয়ে উঠছে৷ যা দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে কোনো ভাবেই কাম্য নয়৷ এছাড়া সমাজজীবনে দেখা যাচ্ছে--- যেকোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অনুপ্রবেশ ও চাপান-উতোর চলে৷ সার্বিকভাবে কোন সমস্যার সমাধান না করে ঘটনাকে রাজনৈতিক রঙে রাঙিয়ে আরও জটিল করে ফেলা হচ্ছে, নেতাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতে৷
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মোটামুটি ভাবে আমরা এ সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, রাজনীতিকে স্বার্থজনিত (দলগত ও গোষ্ঠীগত) দূষণমুক্ত রাখতে হবে ও নৈতিকতা, সততা, সেবা পরায়নতার দ্বারাই দেশের সর্র্বত্মক উন্নতি ও মানুষের মঙ্গল সাধনে নেতৃবৃন্দকে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে৷ নৈতিকতা ও সততায় প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে নীতিবাদের কঠোর অনুশীলনে অবশ্যই মনোনিবেশ করতে হবে৷ আধ্যাত্মিকতার ভাবনা না থাকলে, ‘বৃহতের’ আদর্শে জীবন পরিচালিত না হলে ব্যষ্টিগত ভাবে মানুষ বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে পারে না--- প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে যেকোনো সময়ে পদস্থলন হবার সম্ভাবনা থাকে৷ সেই কারণে রাজনীতিবিদদের প্রত্যেককে আধ্যাত্মিকতার আদর্শে জীবন ও চিন্তা ধারাকে স্বচ্ছ, শুদ্ধ ও শুভ ভাবনায় জারিত করতে হবে৷ আর তখনই মন সমস্ত রকম সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে উদার ও প্রকৃত সেবার মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হতে পারবে৷ ভারতবর্ষের মহান ঐক্য ও সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের কাছে আরও সমুজ্জ্বল করে তুলে ধরতে হলে আজকের ছাত্রযুব ও রাজনীতির লোকেদের অবশ্যই নৈতিকতা, সত্যনিষ্ঠা ও সেবা ধর্মের অনুশীলনের মাধ্যমে সকল ভেদ-বিভেদ ও অশুভ ভাবনার ঊধের্ব উঠে রাজনীতির অভিমুখকে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতি প্রধাবিত করতেই হবে৷ আমাদের গর্বের ভারতবর্ষকে ধর্মে, কর্মে, ঐতিহ্যে, সংস্কৃতিতে সুমহান ভারতবর্ষ রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত করা আমাদের সকলের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ আর এরজন্য নিরলস পরিশ্রম ও নিঃস্বার্থ সেবাই একমাত্র পথ৷
- Log in to post comments