ছিলে আছো থাকবে তুমি

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

তোমারই সৃষ্ট জগতে তোমারি বাঁধা নিয়মে কত কিছুই যায় আসে৷ যে সূর্য অস্ত গেল একটু আগে, সেই সূর্য আবার কাল সকালে উদয় হবে৷ এইভাবে দিন যায় রাত আসে, রাতের পর আবার দিন আসে৷ এই যে শরৎ আর কটা দিন পরে বিদায় নেবে এও আবার ফিরে আসবে আর একটা বর্ষা পার করে৷

এখন তুমি শুধু আসো না চরণ ফেলে৷ মধু মালঞ্চ, মধুকর্ণিকা, মধুমলয়, মধুকরকে আর পড়ে না তোমার পদচিহ্ণ৷ রবিবারের বিকালে আর কেউ আসে না তোমার মিষ্টি মধুর হাসি মাখা মুখের অমৃত বচন শুনতে৷ ’ছিলে আছো থাকবে তুমি’ তবুও তো গেলে! তাইতো শব্দ চয়নিকা থেমে গেছে ‘গ’ এর মাঝপথে এসে, প্রভাত সঙ্গীত থেমে গেছে পাঁচ হাজার আঠারতে, ডিএম সি শব্দ টা বদলে হয়ে গেছে ডিএমএস৷ তুমি তো আছোই প্রতিমুহূর্তে প্রতি ক্ষণেই সঙ্গে সঙ্গে জীবনের সকল কাজে৷ তবু হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো মাঝে মাঝে একটা না থাকার বেদনায় আচ্ছন্ন করে মনকে৷ পাঞ্চ ভৌতিক জগতে এই না থাকাটাও অস্বীকার করা যায় না৷

তবুও কেউ কেউ প্রশ্ণ তুলেছেন পরম পুরুষের আবার মহাপ্রয়াণ হয় নাকি? যুক্তিসংগত প্রশ্ণ, যিনি অনাদি অনন্ত সর্বব্যাপী, যিনি কালাতীত তাঁর আবার মহাপ্রয়াণ!

পার্থিব ওই জগতে যা আসে তাকে যেতেই হয়, কোন কিছুই এখানে চিরস্থায়ী নয়৷ এ তাঁরই বিধান৷ স্রষ্টার কোন সৃষ্টি এই বিধানের বাইরে নয়৷ এমনকি স্বয়ং পরমপুরুষ নিজেই যখন সৃষ্টি রূপে এই ধরায় অবতীর্ণ হন তখন তাঁকেও তাঁরই বিধান মেনে চলতে হয়৷ সেই বিধানের বাইরে তিনিও যেতে পারেন না৷

তাই পরমপুরুষ যখন পাঞ্চভৌতিক দেহ ধারণ করে পৃথিবীতে আসেন তখন তাঁকেও সেই দেহ ত্যাগ করে যেতে হয়৷ অরূপ যখন রূপে ধরা দেন, তখন নিজের বিধানেই বাঁধা পড়েন৷ তাই তাঁকে যেতেও হয়৷

১৯২১ এর আনন্দ পূর্ণিমায় যিনি এসেছিলেন পার্থীব দেহ ধারণ করে, ১৯৯০ এর একুশে অক্টোবর তিনি সেই দেহ ত্যাগ করে গেলেন৷ সারা বিশ্বের ভক্তদের সেই পবিত্র দেহ দর্শনের জন্য তিলজলা কেন্দ্রীয় আশ্রমে পাঁচ দিন রাখা ছিল৷ ২৬ তারিখ অপরাহ্ণে তাঁর সেই পবিত্র পার্থিব দেহ অনলে বিলীন হয়৷

পাঞ্চভৌতিক দেহ নিয়ে যে আসে সেই সম্ভুতি৷ পরম পুরুষ যখন পাঞ্চভৌতিক দেহ নিয়ে পৃথিবীতে আসেন তখন তাকে বলা হয় মহাসম্ভুতি৷ সম্ভুতি দেহত্যাগ করলে বলা হয় প্রয়াণ৷ মহাসম্ভুতির দেহত্যাগ কে মহাপ্রয়াণ বলাই যুক্তিসঙ্গত৷

ভক্তবৃন্দ কিন্তু তার এই যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি৷ তাই যে ৫ দিন তাঁর দেহ সংরক্ষিত ছিল কেন্দ্রীয় আশ্রমে শোকার্ত ভক্ত বৃন্দ বাবা নাম কেবলম মহানাম মন্ত্র কীর্তনে মেতেছিল৷ কীর্তন কেন? পরমপুরুষই বলেছেন---’কতগুলো মানুষ যখন কীর্তন করছে তখন সেই মানুষগুলির শারীরিক শক্তি যে একত্রিত হচ্ছে তাই নয়, তাদের মিলিত মানবশক্তিও একত্রিত হচ্ছে৷ একই ভাবধারায় আর একই পরম পুরুষের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়ে প্রেষণা পেয়ে একই ধারায় একই খাতে বইতে থাকে৷ তাই সেখানে কেবল যে একটা বিপুল জড়শক্তির সমাবেশ ঘটে তাই নয় মানস শক্তির একটা অতি বিরাট সমাবেশ ঘটে আর সেই মিলিত জড়শক্তি ও মিলিত মানস শক্তি এই প্রপাঞ্চিক জগতের পুঞ্জিভূত দুঃখ-ক্লেশ দূর করে দেয়৷’

প্রতিবছর ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসের সেই পাঁচ দিনকে স্মরণ করে যদি কীর্তন করা হয় আর সেই অনুষ্ঠানকে যদি মহাপ্রয়াণ দিবস বলা হয় এতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না৷ যারা এটাকে ডগমা বলে আসলে তারাই ভাবজড়তায় আচ্ছন্ন, সংকীর্ণ মনের মানুষ৷ এরা জ্ঞান পাপী, সব জেনে বুঝেও মানুষকে বিপথে চালিত করতে চায় কু-মতলবে৷

পরিশেষে তাঁরই কথা স্মরণ করি---’ভক্তরা যখনই মিলিত কীর্তন করেন তখনই পরমপুরুষ সেই ভক্ত হৃদয়ের সিংহাসনে এসে উপবেশন করেন৷ পরমপুরুষ তখনই তাঁর কেন্দ্রবিন্দুকে সেই স্থানটিতে স্থানান্তরিত করেন৷ সেটাই হয়ে দাঁড়ায় পরমপুরুষের দিব্য রাজধানী’৷

মহাপ্রয়াণ দিবস উপলক্ষে একুশে অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে তিলজলা কেন্দ্রীয় আশ্রমে বাবার স্মৃতিসৌধে পাঁচ দিনব্যাপী অখণ্ড বাবা নাম কেবলম মহানাম মন্ত্র কীর্তন৷ এই পাঁচ দিন প্রতিটি ভক্ত কীর্তনে সামিল হয়ে নিজের হৃদয়কে পরম পুরুষের দিব্য রাজধানী রূপে গড়ে তুলুন৷