বেলডাঙ্গা, নারকোলডাঙ্গা পটোলডাঙ্গা প্রভৃতি
জল থেকে উঠেছে, খুব পুরোনো নয় এমন জনপদকে ‘ডাঙ্গা’ বলা হয়৷ পূর্ব রাঢ়ে ও বাগড়িতে এই ‘ডাঙ্গা’ শব্দ যুক্ত অনেক জায়গা রয়েছে৷ যেমন, ‘বেলডাঙ্গা’৷ কলকাতাতেই আছে ‘নারকোলডাঙ্গা’৷ বর্ত্তমানে কলকাতায় যে জায়গাটাকে কলেজ স্কোয়ার বলে সেই জায়গাটার আগেকার নাম ছিল পটোলডাঙ্গা অর্থাৎ সমুদ্রবক্ষ থেকে ডাঙ্গা জেগে উঠলে লোকে ওখানে পটোলের চাষ করত৷ যাই হোক, ‘ডাঙ্গা’ শব্দযোগে কোন জনপদের নাম দেখলেই ক্ষুঝে নিতে হবে যে ওই জনপদটি জলের তলা থেকে উঠেছে৷ জলের দেশ নয়, সেখানে ‘ডাঙ্গা’ খুব কম পাওয়া যাবে৷ অবশ্য উঁচু জমি এই অর্থেও অনেক সময় ‘ডাঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহূত হয়৷ রাঢ়ের উঁচু জমি বলতে ‘ডাঙ্গাল’ শব্দটি আর নীচু জমি বোঝাতে ‘নামাল’ শব্দটি ব্যবহূত হয়৷ দুমকাতে ‘ডাঙ্গালপাড়া’ বলে একটি পাড়া আছে৷ শিউরী শহরেও একটি পাড়ার নাম ‘ডাঙ্গালপাড়া’৷ একেবারেই শুকনো দেশ আসানসোলের কাছে একটি স্থানের না ‘তালডাঙ্গা’৷ কিন্তু বাঁকুড়া জেলার ‘তালডাংরা’–টি ‘ডাঙ্গা’ শব্দ থেকে আসেনি৷ বাংলা ভাষায় অতি উঁচু পাহাড়কে বলা হয় পর্বত •mountain—, তার চেয়ে ছোটকে বলা হয় পাহাড় (hill), তার চেয়ে ছোটকে বলা হয় পাহাড়ী •small hill— এখন যে ইষ্টিশানটির নাম বোকারো ষ্টীল সিটি আগে তার নাম ছিল ‘মরা পাহাড়ী’৷ ভুল করে অনেকে বলতেন ‘মারাফাড়ী’৷ মরা পাথরের পাহাড়ী এই অর্থে মরা পাহাড়ী৷ আমি ব্যষ্টি–গতভাবে ওই অঞ্চলের পাথর হাতের মুঠোয় চাপ দিয়ে দেখেছি তা গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যেত ও এই জন্যেই নাম হয়েছিল মরা পাহাড়ী৷ অনুরূপভাবে বেলপাহাড়ী, সেনপাহাড়ী, ঝাঁটিপাহাড়ী, আসানসোলের নিকটে কালিপাহাড়ী প্রভৃতি৷ পাহাড়ীর চেয়ে ছোটকে বলা হয় ডুংরি বা ড্যাংরা •hillock—৷ তার চেয়ে ছোটকে বলে টিলা, তার চেয়ে ছোট হ’ল ঢিবি, যেমন উই–ঢিবি •ant-hill—৷ ‘তালডাংরা’ নামটি এই ‘ডাংরা’ শব্দ থেকে আসা স্বাভাবিক৷ অবশ্য তালগাছের কাঁদিকেও ‘তালডাংরা’ বলা হয়৷ যাই হোক নামটি ‘ডাঙ্গা’ থেকে যে আসেনি তা সুনিশ্চিত৷ অতি প্রাচীন বাংলায় টিলাকে বলা হত ‘টাল’৷ বার শ’ বছরের পুরানো বাংলায় বলা হচ্ছে– ‘‘টালত ঘর মোর নাহি পরিবেশী৷
হাঁড়িত ভাত নাই নিতি আবেশী৷৷’’
বীরভূমের পূর্বাংশে কিছু কিছু নীচু জায়গাকে বলে ‘নামাল’৷ যেমন লাভপুর, নান্নুর, ময়ূরেশ্বর, রামপুরহাট, নলহাটি, মুরারই প্রভৃতি থানা৷ পশ্চিমাঞ্চলে যেমন দুবরাজপুর, খয়রাসোল, শিউরী, মামুদবাজার, ইলেমক্ষাজার, রাজনগর প্রভৃতি জায়গা হ’ল ডাঙ্গাল৷ আর বোলপুর, সাঁঞিথিয়া প্রভৃতি জায়গা আংশিক ভাবে ডাঙ্গাল ও আংশিকভাবে নামাল৷ নামাল জমিতে ফসল ডাঙ্গাল জমির চেয়ে ভাল হয় কিন্তু ধান ডাঙ্গাল জমিতে ভাল হয় কারণ সেখানে রয়েছে এঁটেল মাটি৷ নামালের লোকেদের একটা ধারণা আছে–ডাঙ্গালের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলে পোস্ত খেয়ে খেয়ে মেয়ের পেটে চড়া পড়ে যাবে৷ তাই নামালের লোকেরা বলে, ‘‘ওখানে মেয়ের বিয়ে দোব না গো, ওখানে বিয়ে দিলে পোস্ত খেয়ে খেয়ে মেয়ের পেটে চড়া পড়ে যাবে৷’’
‘ডাঙ্গা’ শব্দটি সুপ্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক অষ্ট্রিক শব্দ৷ বাংলা ভাষায় প্রচুর অষ্ট্রিক শব্দের ব্যবহার আছে৷ ‘ডাঙ্গা’ শব্দটি এই ধরণের একটি অষ্ট্রিক শব্দ৷ এই অষ্ট্রিক শব্দের বহুল ব্যবহার বীরহোড় ভাষাতেও রয়েছে৷ সাঁওতালী ‘হড়’ ভাষায় অষ্ট্রিক শব্দ কিছুটা বিকৃত হয়েছে৷ অন্যদিকে ওঁরাওদের কুরুক ভাষা দ্রাবিড় ভাষা৷ তাতে অষ্ট্রিক শব্দ খুবই কম৷ বাংলা ভাষায় ‘ডাঙ্গা’র মত অষ্ট্রিক শব্দ আছে প্রচুর কিন্তু কুরুক ও অন্যান্য দ্রাবিড় ভাষার শব্দ খুবই কম৷ তবে নেই বলতে পারছি না৷ বাংলা ভাষায় অতি প্রচলিত ‘পল্লী’ শব্দটি মূলতঃ দ্রাবিড় শব্দ৷ ইড়াপল্লী, তিরুচিরাপল্লীর মতই আমাদের ভট্টপল্লী, পল্লীগ্রাম৷ ‘পল্লী’কে আমরা যতই সাজিয়ে গুছিয়ে বেনারসী শাড়ী পরিয়ে সংস্কৃত বলে চালাবার চেষ্টা করি না কেন সে মূলতঃ দ্রাবিড়৷ অনেকে ভাবেন বাংলা ‘পাড়া’ শব্দটি ‘পল্লী’রই অপভ্রংশ৷ অর্থাৎ ‘পল্লীগ্রাম’ থেকেই ‘পাড়াগাঁ’ শব্দটি এসেছে৷ না, জিনিসটি তা নয়৷ ‘গ্রাম’ শব্দ থেকে ‘গাঁ’ শব্দটি এসেছে একথা ঠিক কিন্তু ‘পল্লী’ থেকে ‘পাড়া’ আসে নি৷ ‘পাড়া’ একটি পূর্বভারতীয় শব্দ যা বাংলা, অসমীয়া, ওড়িয়া, নাগপুরী ও ছত্তিশগড়ী ভাষায় ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়৷ ‘পাড়া’র হিন্দুস্থানী প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘মুহল্লা’৷ বাংলায় যেখানে বলব ‘এ পাড়ায়’, হিন্দুস্তানীতে সেখানে বলব, ‘ইস্ মুহল্লামে’৷ মুহল্লা শব্দটি ফার্সী সঞ্জাত৷ প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি সংস্কৃত ভাষায় ‘পল্লী’ মানে ‘পাড়া’ নয়৷ ‘সংস্কৃত ভাষায় ‘পল্লী’ মানে ‘টিকটিকি’ আর ‘কৃকলাস’ মানে গিরগিটি৷ এই টিকটিকিকে হিন্দীতে বলে ‘ছিপকলী’ মৈথিলী, মগহী ও ভোজপুরীতে বলে ‘বিছৌতি’ অঙ্গিকা ভাষায়বলে ‘টিকটিকিয়া’৷ আর তোমরা তো সবাই জানো ইংরেজীতে বলে ‘লিজার্ড’৷