পৌরাণিক কাহিনী গল্প মহাকাব্যে রাক্ষস অসুর পিশাচের কথা আমরা যা শুণেছি তা অত্যন্ত ভয়ংকর ও রোমাঞ্চকর৷ আদতে ঐ রাক্ষস অসুর পিশাচের অস্তিত্ব কবে কোথায় ছিল তার সন্ধান পেতে কে না কৌতূহলী হয়৷ ঋগ্বেদে যে অসুরের উল্লেখ আছে তা কিন্তু মোটেই আমাদের কাল্পনিক দুর্দান্ত শক্তিশালী কু-দর্শন কোন মানবেতর প্রাণী নয়৷ অসুর একটি ভাষার নাম৷ আর্যরা ভারতে এসে যে অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর সাক্ষাৎ পেয়েছিল তাদের ভাষা আর্যদের কাছে অত্যন্ত অস্ফুট অব্যক্ত,অস্পষ্ট, দুর্র্বেধ্য, কর্কণা ও রূঢ়৷ তাই আর্যরা অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষাকে বলতো অসুর ভাষা৷ আর এই অসুর ভাষাভাষীরা হলো ঋগ্বেদে অসুর৷ অসুর ভাষাভাষীরা বাস করতো পূর্ব ও পশ্চিম আর দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গে৷ বঙ্গ (দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ), সমতট, হরিকেল, গৌড় ও পুণ্ড্রের (উত্তরবঙ্গ) অসুর ভাষাভাষীদের অস্তিত্ব ছিল৷ কোল-মুণ্ডা গোষ্ঠীর অন্যতম প্রধান বুলি আজো ‘অসুর’ বুলি নামে পরিচিত৷ মধ্যভারতের পূর্ব খণ্ডে আদি অস্ট্রেলীয়দের মধ্যে অসুর বুলির প্রচলন আছে৷ অসমে কামরূপের বর্মণ রাজারা সকলেই অসুর বলে অভিহিত৷ সপ্তম শতকের পূর্বে ঐ রাজবংশের আদি পুরুষদের মধ্যে অসুরান্ত ঔপাধিক নাম পাওয়া যায় যেমন, মহিরাঙ্গ অসুর, দানবাসুর, হটকাসুর, সম্বরাসুর, রত্নাসুর, নরকাসুর---এরা অসুর ভাষাভাষী ছিলেন বলেই এদের নামের সাথে অসুর শব্দ যুক্ত হয়েছে বলে পণ্ডিতদের অনুমান৷ এছাড়া পারস্যের আদিম অধিবাসীদের ও অসুর বলা হতো৷
আর্য-নেতা অগস্ত্য সর্বপ্রথম দক্ষিণাপথে তাদের প্রভুত্ব কায়েম করতে অগ্রসর হন৷ দক্ষিণাপথের উত্তর সীমান্তে অবস্থিত বিন্ধ্যপর্বত৷ এই বিন্ধ্যপর্বত অগস্ত্যকে দেখে মাথা নোয়ায়, সে-মাথা আজো নত হয়ে আছে৷ এটা আর্যের মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্য একটা রূপক ছাড়া আর কিছুই নয়৷ রামায়ণের মধ্যে আর্যদের এই দক্ষিণ ভারত অভিযানের চিত্র সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে৷ রামায়ণে উল্লিখিত কিষ্কিন্ধ্যাবাসী বানর বা লঙ্কাবাসী রাক্ষসেরা আসলে কারা? তারা কি সত্যিই বানর বা রাক্ষস ছিল? মোটেই না৷ তারা ছিল দ্রাবিড় গোষ্ঠীর বিভিন্ন উপজাতি৷ এই অনার্য দ্রাবিড়েরা বিদ্যাবুদ্ধি বিজ্ঞান-চর্চা, নগরনির্মাণ ও সামাজিক অনুশাসনে যে কত উন্নত ছিল তার প্রমাণ রামায়ণে পাওয়া যায়৷ মৃৎ শিল্প ও অন্যান্য কারুশিল্পে দক্ষতা, চারুশিল্পের অনেক জ্যামিতিক নকশা ও পরিকল্পনা ছিল তাদের আরত্বে৷ এছাড়া বুদ্ধির লড়াইয়ে যে আর্যরা এদের সমকক্ষ হতে না পেরে মন্তব্য করেছে---‘‘রাক্ষসেরা মায়া বোঝা তারা’ এটা একধরণের হীনম্মন্যতা৷ এই হীনম্মন্যতার বশবর্তী হয়েই আর্যরা অনার্যদের কখনো বলেছে রাক্ষস, কখনো বলেছে পিশাচ, আবার কখনো অসুর ৷
আর্যরা যে-যাগযজ্ঞ করতো অনার্যদের কাছে তার কোন আধ্যাত্মিক মূল্য ছিল না৷ ফলে তারা সুযোগ পেলেই সেইসব যজ্ঞ লণ্ডভণ্ড করে পণ্ড করে দিত৷ সেই রাগে আর্যরা অনার্যদের রাক্ষস, পশু ও পিশাচ নামে সম্বোধন করতো৷ ওই তথাকথিত রাক্ষসদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মুনি ঋষিরা আর্য রাজাদের শরণাপন্ন হয়েছে প্রতিকারের আশায়---এমন গল্প তো সংস্কৃত সাহিত্যে ভুরি ভুরি আছে৷ অনার্যদের মধ্যে বিশেষ করে দ্রাবিড়দের বলা হতো রাক্ষস ও বানর৷ কারণ দ্রাবিড়রা ছিল খর্বকায়৷ মঙ্গোলীয়দের বলা হতো অসুর৷ শ্মশানচারী তান্ত্রিক শবসাধকদের বলা হতো পিশাচ৷ আর তারা নরখাদক বলে প্রচার করা হতো৷ দ্রাবিড়দের চোয়াল উঁচু, গায়ের রঙ কালো৷ মঙ্গোলীয়দের নাক চ্যাপ্ঢা৷ ফলে তাদের নিয়ে কদাকার সব ছবি আঁকা হতো৷ ঠিক আজকের দিনের কার্টুনের মতো৷ যদিও দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয়রা আর্যদের চাইতে ঢের বেশি সভ্যমার্জিত ও শিক্ষিত ছিল৷ সেই সভ্যতা শিক্ষা ছিল তখনকার মতো৷ সত্যি যদি তারা জ্ঞান-গরিমায় উন্নত না হতো তাহলে কিসের মোহে আর্যরা ঐসব অনার্য গোষ্ঠীর কন্যাদের বিয়ে করলো ভীম কেন অনার্যকন্যা হিড়িম্বাকে বিয়ে করলো? রাবণতো ছিলেন রাক্ষস নেতা৷ তবে তাঁর পিতৃকুল কি করে৷ আর্যব্রাহ্মণ হলো? পুলস্ত ঋষির বংশধর মহর্ষি বিশ্বশ্র বা ছিলেন রাবণের পিতা৷ তিনি কেন অনার্যকন্যা রাক্ষসী (?) নিকষা বা কৈকসীকে বিয়ে করলেন?
দেব-রাক্ষস বা দেব-অসুর ছিল কারা? আর্যরা ছিল দেখতে সুন্দর৷ তাই বলতে বোধাতো সুন্দর আর্য সর্দার৷ আর রাক্ষস বা অসুর হচ্ছে অনার্যরা৷ যুদ্ধের কাহিনীতে দেখা যায়, বড় বড় অসুর ও রাক্ষসেরা সবাই শিবের কৃপাতে মহাশক্তির অধিকারী হয়ে দেবতাদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছে৷ রাক্ষস ও অসুরেরা সবাই কেন শিবের ভক্ত ছিল৷ কারণ শিব জন্মগ্রহণ করেছিলেন মঙ্গোলীয়-আর্য মিশ্রকুলে তাই অসুর রাক্ষস অর্থাৎ অনার্যকুলের দ্রাবিড় অষ্ট্রিক, মঙ্গোলীয় সবাই ছিল শিবের ভক্ত৷ ধীরে ধীরে অবশ্য আর্যরা ও শিবের ভক্ত হয়ে পড়ে৷ নাম করা সব রাক্ষস আর অসুররা ছিল পরম শৈব৷ যে অনার্যরা রাক্ষস নামে অভিহিত সেই অনার্যর রক্তেই শিবের জন্ম৷ অথচ আর্য রাজা দক্ষের কন্যা গৌরী শিবকে বিয়ে করতে চাইলেন৷ নিশ্চই তিনি শিবের রূপে গুণে মুগ্দ হয়েছিলেন৷ যদিও দক্ষের ঐ বিয়েতে সম্মতি ছিল না৷ শিবকে বিয়ের ব্যাপারে গৌরীর অনমনীয় মনোভাবের কাছে তিনি হার মেনেছিলেন৷
আর এদিকে আর্য অনার্য উভয় সমাজে শিবের প্রচণ্ড জনপ্রিয়তা সহ্য করতে না পেরে দক্ষরাজা এক বিরাট যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে শিবকে করলেন অপদস্থ৷ শিবের অপমান বরদাস্ত করতে না পেরে তাঁর ভক্তরা সেই যজ্ঞ পণ্ড করে দেয়৷ ‘‘ভূতনাথ ভূতসাথ দক্ষ নাশিছে৷’’ শিবের দুই অনুচর নন্দীভৃঙ্গীকে আর্যরা ভূত প্রেত বলে উল্লেখ করেছে৷ হিন্দুদের মধ্যে আট প্রকার বিবাহ প্রচলিত৷ ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর গন্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ৷ এর মধ্যে ব্রাহ্ম, আর্য, দৈব ও প্রাজাপত্য বৈদিক৷ আর বাকী অসুর, পৈশাচ ও রাক্ষস অবৈদিক৷ পাত্র-পাত্রীর পারস্পরিক মনের আকর্ষণে যে বিবাহ তা হলো গান্ধর্ব বিবাহ৷ এই পদ্ধতি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন৷ আর ছলে বলে বিবাহ হচ্ছে রাক্ষস ও পৈশাচ৷ টাকা পয়সা দিয়ে বিবাহ হচ্ছে অসুর৷ বর্তমান সমাজে পণপ্রথা তো আসুর বিবাহেরই প্রকৃষ্ট নমুনা৷ আবার এই অবৈদিক আসুর বিবাহে অগ্ণিসাক্ষী দেবারাধনা ও বৈদিক মন্ত্রও উচ্চারিত হয়৷ দ্রাবিড় সংস্কৃতি আজো কতটা অপ্রতিরোধ্য তার প্রমাণ এখানে পাওয়া যায়৷ ঐতরেয় ব্রাহ্মণগ্রন্থে পুণ্ড্র প্রভৃতি জনপদের অধিবাসীদের ‘দস্যু’ ও বলা হয়েছে৷ পুণ্ড্র একটা প্রাচীন জাতির নাম৷ এরা উত্তরবঙ্গে বাস করতো বলে এই অঞ্চল পুণ্ড্রবর্ধন নত্রামে খ্যাত ছিল৷ গৌড় (মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র বিভাগ), পুণ্ড্র, সমতট আর হরিকেলের অধিবাসীদের ভাষাকে বলা হয়েছে ‘অসুর’ভাষা৷ ‘মঞ্জুশ্রী মূল কল্প’ নামক বৌদ্ধ পুঁথিতে হরিকেল, সমতট ও বঙ্গ আলাদা আলাদা ভূখণ্ডরূপে উল্লিখিত হলেও বঙ্গ ও হরিকেল অভিন্ন বলেও অনেকের অনুমান৷
তাহলে দেখা যাচ্ছে বিশেষ জনগোষ্ঠী ও ভাষা উভয়ই ‘অসুর’ নামে পরিচিত৷
দেখা যাচ্ছে, মূলতঃ অস্পষ্ট অব্যক্ত ভাষার জন্যই পূর্বাঞ্চলের লোকেরা ‘অসুর’ নামে অভিহিত৷ ভাষার দুর্র্বেধ্যতার জন্যেই বেদ ব্রাহ্মণের আর্য ঋষিরা প্রাচ্য ভারতের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ছিলেন৷ প্রাচ্য ভারতীয় ব্রাত্যদের ভাষা আর্যভাষা হলেও তা ‘প্রাকৃত’ কন্টকিত৷ ফলে তা ঋগবেদীয় আর্যভাষার সমকক্ষ হতে পারেনি৷৷ পানীনী পতঞ্জলির মতে উত্তর আর মধ্যভারতের আর্যভাষাই শুদ্ধ ও মার্জিত৷ পূর্বাঞ্চলের লোকদের পতঞ্জলি ও বলেছেন ‘অসুর’৷
একথা সত্যি, আর্যরা ছিল গৌরবর্ণ, দীর্ঘকায়, স্বাস্থ্যবান, সুদর্শন জাতি৷ কিন্তু শিক্ষা সভ্যতার দিক দিয়ে অনার্যরা তাদের চাইতে কোন অংশে কম ছিল না৷ দ্রাবিড়দের কাছ থেকেই লিপিহীন আর্যরা অক্ষরজ্ঞান লাভ করে৷ হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো সভ্যতা আবিষৃকত হওয়ার পর প্রমাণিত হয় আর্যদের আগমণের বহুপূর্বেই দ্রাবিড়দের মধ্যে লিপির প্রচলন ছিল৷ দ্রাবিড়দের সৈন্ধবী লিপিই ব্রাহ্মী ও খরোষ্ঠী লিপির জন্মাদাতা৷
ধর্মচেতনার নিরিখে এ মন্তব্য অসঙ্গত নয় যে, অনার্যরা আর্যদের চাইতে যথেষ্ট অগ্রসরমান ছিল৷ অনার্যদের সুসংগঠিত সমাজব্যবস্থা ছিল, সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি ছিল, ছিল অধ্যাত্মদর্শন ও তন্ত্রসাধনা৷ আর্যদের মতো অনার্যদের জীবনে ছিল না হৈহল্লা ও জাঁকজমক৷ লক্ষ্যণীয় বিষয়, ভোগ্যবস্তু অনার্যদেরই বেশি ছিল৷ তৎসত্ত্বেও তাদের জীবন ছিল সহজ সরল অনাড়ম্বর৷
গোষ্ঠীবদ্ধতা আর দাম্পত্য, অনুশাসন ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজ গড়ার প্রেরণা অনার্যদের কাছ থেকেই আর্যরা লাভ করেছিল৷
অনার্যদের মধ্যে অষ্ট্রীক-নিগ্রো মিশ্রণজাত দ্রাবিড়গোষ্ঠী ছিল বুদ্ধিমত্তা ও অধ্যাত্মবোধের সব চাইতে উন্নত৷ তন্ত্র সাধনার মাধ্যমে এরা লাভ করেছিল জ্ঞান ও ভক্তি অনার্যদের আরেক গোষ্ঠী মঙ্গোলীয়রা ছিল তন্ত্রসাধনালব্ধ ভক্তি ও কর্মে উদ্বুদ্ধ৷
অনার্যদের তৃতীয় গোষ্ঠী অষ্ট্রীক সম্প্রদায় বৌদ্ধিকস্তরে ছিল প্রায় আর্যদের সমান৷ এই অষ্ট্রীক সম্প্রদায়ের মধ্যেই দেখা যেত তন্ত্রের প্রবৃত্তিমূলক ক্রিয়াকলাপ৷ যেমন বাণমারা, যাদু, উচ্চাটন, সম্মোহন ইত্যাদি৷
তাই আর্যরা যাদের রাক্ষস অসুর দস্যু বানর ইত্যাদি নামে অপবাদ দিত ও অশুভ শক্তির প্রতীকরূপে চিত্রিত করেছিল তারা কিন্তু প্রাচীন অনার্য গোষ্ঠীরই বিভিন্ন প্রতিভা সম্পন্ন সম্প্রদায়৷
‘অসুর’ শব্দ নিন্দার্থেই প্রয়োগ হয়েছিল৷ ঋগ্বেদে ‘অসুর’ শব্দটি দেবতাদের শত্রুরূপে ব্যবহৃত৷ এছাড়া রাক্ষস, অসুর, পিশাচ-এসব শব্দ অনার্যদের প্রতি আর্যদের গালিগালাজ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ (তথ্যসূত্র তন্ত্র ও আর্যভারতীয় সভ্যতা---শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)
- Log in to post comments