মানুষ যেটা দেখতে অভ্যস্ত সেটারই কথা বলে কিন্তু পরিবর্ত্তনশীল জগতে অনেক কিছুরই পরিবর্তন ঘটে সেটাকে ধৈর্য ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে যদি গ্রহণ করা হয় ও সেটাকে দাঁড় করাবার আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকে তা হলে দেখা যাবে পুরাতনের পাশে নোতুন স্থান করে নিয়েছে৷ আজকের যা নোতুন, কালই সেটা পরিবর্ত্তনশীল জগতে পুরাতন হয়ে যায়৷ তার স্থলে নোতুন আসে৷ অনেক পত্র পত্রিকায় অনেক লেখকের লেখায় বলা হচ্ছে যে পুঁজিপতিদের সাহায্য ছাড়া শিল্প গড়া সম্ভবপর নয়৷ তাই সমস্যাসঙ্কুল পশ্চিমবঙ্গে শিল্প গড়তে পুঁজিপতিদের দাবী দাওয়া মেনে তাঁদের আহবান জানাতে হবে তবেই এ রাজ্যে শিল্প গড়ে উঠবে৷ তাঁরা অর্থাৎ লেখকগণ বিশেষ বিশেষ শিল্পপতিদের নামও উল্লেখ করেছেন৷ এটা ঠিক যে, পুঁজি ছাড়া শিল্প গড়া সম্ভব নয়৷ তবে সেই পুঁজির সরবরাহ কেবল শিল্পপতি ধনী ব্যষ্টিরাই করতে পারেন এটাকে ধ্রুব সত্য বলে মেনে নেওয়া যায় না৷ রাঘব বোয়াল শিল্পপতিরা কোটি কোটি টাকা শিল্পে বিনিয়োগ করবেন, তাঁরা সেই কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে তো লক্ষ লক্ষ টাকা লভ্যাংশ আদায় করে নেবেন৷ এটাতো আমরা দেখে আসছি৷ আমাদের চোখের সামনে দেখছি বিড়লার হিন্দমোটরস, জেসপের মতো শিল্প, ডানলপের মতো কারখানা কিভাবে ধ্বংস হয়ে গেল৷ এর পশ্চাতে যে শিল্পপতিদের গভীর চক্রান্ত ও রাজনৈতিক দলের ইউনিয়নগুলির ব্যভিচার রয়ে গেছে সেটাকে কি অস্বীকার করা যায়? গত কয়েক মাসের মধ্যে পশ্চিম বাংলায় প্রায় ২৩টি চটকল বন্ধ হয়ে গেল৷ এর পশ্চাতে যে কি ঘটনা ঘটছে সেটা সবারই জ্ঞাত৷
এই প্রসঙ্গে আলোচনা করাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না তা হ’ল এদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কাঠামোটাই দাঁড়িয়ে আছে পুঁজিপতিদের অঙ্গুলি হেলনে৷ এখানে এম. এল. এ ও এম. পি. কেনা বেচা হয় কাদের টাকায়? সেই কারণে পুঁজিপতিদের সব দাবি না মানলে তাঁরা কোন রাজ্য সরকারের অধীনে শিল্প গড়াতো দূরের কথা, কলকারখানা তুলে নিয়ে যায় অন্য রাজ্যে দুর্বল রাজ্য সরকারগুলিকে নিছক চাপে রাখতে৷ তাঁদের বিরোধিতা করলে তাঁরা কোন রাজ্য সরকারকে সহ্য করবেন না৷ তাই তাঁদের হাতের ক্রীড়ানক হয়ে চলতে হবে রাজ্য সরকারগুলিকে৷ তাছাড়া তাদের প্রাণ ভ্রমরাটাও ওই শিল্পপতিদের নির্দেশেই শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ ও বর্জন করে৷ এটাই চলে আসছে সেই অতীত কাল হতেই৷
মনে রাখতে হবে আজ ভারতের মতো বিরাট রাষ্ট্রে যেখানে বহু ভাষাভাষীর মানুষ বাস করেন সেখানে সেই পুরাতন পদ্ধতিতে শিল্পের একোদেশীকরণটা অচল (Localisation of Industry)৷ এতে চরমভাবে পরিবেশ দূষিত হয়৷ শিল্প অঞ্চলে অত্যধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চরম দুর্নীতি বৃদ্ধি পায় ও আরো অনেক ক্ষতিকারক বিষয়ের সৃষ্টি হয়৷ গ্রাম–প্রধান ভারতে গ্রামগঞ্জে, শহর ও শহরতলীতে ছোট ছোট শিল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে যেখানে যে কাঁচা মাল পাওয়া যায় তার উপর নির্ভর করে৷ তা ছাড়া সেখানে যে খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়া যায় তাকেই ব্যবহার করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হবে৷
আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে স্থানীয় নাগরিকদের দ্বারা সংগৃহীত মূলধনকে কাজে লাগিয়ে সমবায় পদ্ধতিতে শিল্প গড়ে তুলে সারা ভারতকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে৷ স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে না পারলে চরম বেকার সমস্যা সমাধানের অন্য কোন পথ নেই আর ‘সার্কুলেশান অব মানির’ সার্থক চলনটাও গড়ে উঠবে না৷ নাগরিকের ক্রয় ক্ষমতা বাড়াতে ও ধনী দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে দূর করতে এছাড়া অন্য পথ নেই৷ বাইরের মূলধন টানতে এ দেশের রাজনৈতিক নেতাদের যে ব্যাকুলতা দেখা যায় সেটা মোটেই উৎসাহব্যাঞ্জক নয় কারণ সেই বাইরের বণিকরাই এদেশে এসে সেই ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর মতোই ওইসব রাজনৈতিক দলগুলিকে কিনে নিয়ে দেশকে একেবারে অন্তঃসারশূন্য করেই ছাড়বে৷ এটা তো অতীব সত্য যে, রাজ্যে যেসব বাইরের দেশের ধনীরা অর্থবিনিয়োগ করবেন তাঁরা অবশ্যই দানছত্র করতে আসবেন না৷ তাঁরা তাঁদের দেশের কর্মক্ষম শিক্ষিত ব্যষ্টিদের আনবেন, তাঁদের জন্যে কলোনী হবে৷ এই ধরণের বিদেশী কলোনী যে ভারতে কোথাও কোথাও হয়েছে সেটা সকলেরই জানা৷
সিঁদুরে মেঘ দেখলে ঘর পোড়া গোরুর ভয় হয় এটাকে ভুলে যাওয়ার অর্থ চরম মূর্খামী ছাড়া কিছুই নয়৷ ভারতকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে৷ আর পশ্চিমবঙ্গকে চরম শোষণের হাত থেকে বাঁচাতে আরো কঠোর হতে হবে৷ সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সব কিছু পাথেয় এই রাষ্ট্রেরই আছে৷ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসকদের সেটা খুঁজে বের করতে হবে তা না হলে চরম দুর্নীতিতে যেভাবে সারা দেশ ডুবছে সেইভাবেই ডুবে যাবে৷ তাই বলি প্রাকৃতিক, খনিজ সম্পদে, কৃষিতে চরম সম্ভাবনাময় ভারতের শাসকগণকে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শাসকের আসন অলঙ্কৃত করতে হবেই হবে৷ আবার বলি, ব্লক ভিত্তিক পরিকল্পনা ও সমবায় আন্দোলনের মাধ্যমে কুটির শিল্পই বাঁচাবে ভারতকে৷ আজ সবচেয়ে চরম অভাব সারা পৃথিবীতে তা হলো খাদ্য, জ্বালানি ও পানীয় জল৷ ভারত খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েও উদ্বৃত্ত উন্নত খাদ্য উৎপাদন করে যদি পৃথিবীর অন্য দেশের খাদ্যাভাব দূর করতে পারে, তা হলে ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার অভাব হবে না৷ ভারতকে সারা পৃথিবী শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে৷ মনে রাখতে হবে ধনতান্ত্রিক চরম শোষণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তাকে উৎসাহ দান নয়৷ সর্বপ্রকার শোষণকে উৎখাত করাই হলো গণতন্ত্রের মহান আদর্শ ও লক্ষ্য.
- Log in to post comments