দুর্নীতি দূরীকরণে সমাজের নীতিবাদীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া জরুরী

লেখক
সায়ন চক্রবর্ত্তী

ঈশ্বরের এই বিশাল জগতে মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ জীব৷ অন্যান্য সব জীবেদের সঙ্গে মানুষের তুলনা করা না গেলেও অন্যদের ঈশ্বর পূর্ণাঙ্গ রূপে নিখুঁত ভাবে সৃষ্টি করেছেন কিন্তু মানুষকে নিখুঁত ভাবে সৃষ্টি না করে পূর্ণ হওয়ার শক্তি ও সম্ভাবনা দিয়েছেন মাত্র৷ সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে একদিকে মানুষ নিজেকে দেবতারূপেও গড়ে তুলতে পারে আবার সামর্থ্যকে অপব্যবহার করে ভয়ানক শয়তানেও পরিণত হয়ে যেতে পারে৷

মানুষ এই বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়েই বনজঙ্গলে পূর্ণ আদিম পৃথিবীকে আধুনিক হাইটেক শহরে পরিণত করেছে৷ নিজেদের ভোগের উপকরণ সংগ্রহ করতে মানুষ আজ আকাশ পাতাল, গ্রহ গ্রহান্তরে, সমুদ্রের অতল তলেও পৌঁছে যাচ্ছে৷ মাটির পৃথিবীকে সোনার স্বর্গ বানাবার স্বপ্ণ দেখছে৷

অপর দিকে স্বর্গসুখের স্বপ্ণ দেখার পাশাপাশি চরম অশান্তিও বিরাজ করছে৷ বাইরের পৃথিবী রঙীন স্বর্গের রূপ নিলেও অন্তরজগৎ থেকে মনুষ্যত্ব যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে৷ মনুষ্যত্ব যেন পশুত্বে রূপান্তরিত হয়ে চলছে৷ তাই সর্বস্তরেই অশান্তির কালমেঘ ক্রমশঃ ঘনীভূত হচ্ছে৷ কেননা স্বর্গ যতই সুন্দর হোক দেবত্বের বদলে যদি পশুত্বের আধিপত্য বেশি হয় সেই স্বর্গের কোন মূল্য নেই৷

প্রশ্ণ উঠছে মানুষ তো অগাধ বুদ্ধি আর অফুরন্ত সম্ভাবনার অধিকারী–মানুষ কি পারে না অশান্তির মূল উৎপাটন করে স্বর্গস্বরূপ সুন্দর একটি সমাজ গড়ে তুলতে

এর উত্তর খুঁজতে গেলে অনেক গভীরভাবে ভাবতে হবে৷ অশান্তি আর দুর্নীতি আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে৷ শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্প–র্থনীতি, ধর্ম–রাজনীতি সবই আজ দুর্নীতির কবলে৷ সংক্রামক ব্যাধির মতই উপর থেকে নীচের দিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে৷ উপর থেকে নীচে এই জন্যই বলা হলো কারণ দুর্নীতি প্রায় সব ক্ষেত্রেই উপরতলাতেই জন্ম নেয়৷ পুরানো বাড়ির ছাদে বা কার্ণিসে অনেক সময় দেখা যায় বট/অশ্বত্থ ইত্যাদি গাছের অতি ক্ষুদ্র একটি বীজ অঙ্কুরিত হয়ে সবার অবহেলা আর অনাদরে ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে একসময় পুরোবাড়িটাকেই নষ্ট করে দিয়ে থাকে৷ ঠিক সেইভাবেই কোন প্রতিষ্ঠান বা পার্টিতেও দুর্নীতি প্রথমে উপর তলাতেই জন্ম নেয়৷ পরে নীচের দিকে ক্রমশঃ শিকড় বিস্তার করতে করতে একসময় গোটা প্রতিষ্ঠানটাকেই ধ্বংস করে দেয়৷

উপর মহলেই দুর্নীতি জন্ম নেওয়ার সুযোগ বেশি পেয়ে থাকে–এই কারণে যে উপর তলার কর্তাদের মনে ভয়–ডর কম থাকে৷ কেননা তারা মনে করে তারাই সর্বের্স্বা৷ তাদের উপরে আর কেউ দেখার নেই৷ এই মানসিকতাই দুর্নীতি জন্মাবার আদর্শ ভূমি৷ আর নীচু তলা সর্বদাই উপর তলার ভয়ে তটস্থ থাকে তাই দুর্নীতি চট করে সেখানে জন্মাতে পারে না৷ যদি কোথাও জন্মায়ও তা উপরওয়ালাদের প্রশ্রয়ে হয়–তাদের গাফিলতিতে অর্থাৎ প্রশাসনিক তত্ত্ববধানের অভাবে হতে পারে৷

তাই সমাজের উপরওয়ালাদের অর্থাৎ সর্বস্তরের কর্তাব্যষ্টিদের সর্বদা সতর্ক থাকা উচিত যাতে কোন অবস্থাতেই দুর্নীতি প্রশ্রয় না পায়৷ গার্জেন সতর্ক থাকলে, সবদিকে নজর থাকলে ছাদে বটগাছ জন্মাতে পারে না৷

প্রশ্ণ হ’ল দুর্নীতি যেভাবে মহামারীর আকার ধারণ করছে তার মোকাবেলার জন্যে কী কী করা যায়৷ অবিলম্বে এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করা না গেলে আর কিছুদিনের মধ্যে গোটা সমাজটাই আক্রান্ত হয়ে পড়বে৷

একথা ঠিক যে দুর্নীতির শেকড়ের সন্ধান পাওয়া যত সহজ সেই শেকড় উপড়ে ফেলা কিন্তু ততটা সহজ নয়৷ এর জন্যে অপেক্ষাকৃত অধিক শক্তির প্রয়োজন৷ তাই মিলিত প্রয়াস চাই৷

সমাজের সর্বস্তরের সমস্ত নীতিবাদীদের এরজন্যে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে৷ পাপশক্তি সর্বদাই জোটবদ্ধ থাকে৷ এমন অনেক দেখা যায় যে, কুখ্যাত বড় বড় সমাজবিরোধীদের পুলিশ জেলে পুরলেও অসৎ নেতা ও অফিসাররা আবার তাদের গোপন বোঝাপড়া করে মুক্তি দিয়ে দেয়৷ অথচ একজন ভালমানুষ এমন বিপদে পড়লে আর দশজন ভালমানুষ তার সাহায্যে এগিয়ে না এসে পাশ কাটিয়ে চলে যান৷ আসলে সমাজের তথাকথিত ভালমানুষেরাই বেশি আত্মকেন্দ্রিক৷ সমাজে কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে, কে অন্যায় অবিচারের শিকার হচ্ছে , সেই দিকে তাদের নজর নেই৷ তারা কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেও এগিয়ে আসে না৷ আবার শান্তিও পাচ্ছে না৷ একা একা হতাশায় ভুগে মরছে৷ শুভ শক্তি ঐক্যবদ্ধ হলে অন্যায় অবিচার কমতে থাকে পাপশক্তি পিছু হঠতে বাধ্য হয়৷

উপর মহলের কর্তাব্যষ্টিদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতার পাশাপাশি তাঁদেরকে নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হতে হবে৷ অনেক ক্ষেত্রেই নৈতিক চরিত্রকে কোন গুরুত্বই দেওয়া হয় না৷ অনেক সময় কার্যক্ষেত্রে নীতিবাদী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁদের কোণঠাসা করে রাখে৷ তাঁদের নীতি আদর্শ বিসর্জন দিয়ে দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করাতে বাধ্য করানো হয়৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এতে উপর মহলের প্রভাবশালী অসাধু ব্যষ্টিদের মদত থাকে৷ তাই সমাজের বড় দায়িত্বে থাকা লোকদের ও রাজনৈতিক নেতাদের অবশ্যই নীতিবাদী হতে হবে৷ তাই এর জন্যেই সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়েই যে কোন দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে৷

প্রশাসনিক স্তরে অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার আমলারা ভালকরেই জানেন কোথায় কী দুর্নীতি হচ্ছে৷ অথচ তাঁরা দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়েও ভয়ে মুখ খোলেন না৷ এই ভয়কে ঝেড়ে ফেলে যেকোন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করলে অনেক শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষও যে শুভ শক্তির পাশে এসে দাঁড়াবে একথা জোর দিয়েই বলা যায়৷ এক্ষেত্রে একথাটি সবসময় মনে রাখা দরকার যে অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়াও অপরাধ৷ কবির ভাষায় ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে’৷

অনেক সময় কোন দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকলেও সেই অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ এসব ক্ষেত্রে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা দরকার৷ নীতিবাদীদেরই তা করতে হবে৷ এই নীতিবাদীরা যত ঐক্যবদ্ধ হবে পাপশক্তি ততই দুর্বল হতে থাকবে৷ প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত থাকলেই সর্বত্র ভালকাজ হয়৷ সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে৷ কিন্তু অসাধু ব্যষ্টিরা তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে একজোট হয়ে শান্তির পরিবেশ নষ্ট করার চেষ্টা করে৷ প্রশাসনকে দুর্বল করার চেষ্টা করে থাকে৷ এই অবস্থায় সৎ ব্যষ্টিরা যদি ঐক্য বদ্ধ হয়ে প্রশাসনের পাশে এসে দাঁড়ায় তাহলে সহজেই প্রশাসনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা যায়৷ কিন্তু শৃঙ্খলা একবার নষ্ট হয়ে গেলে তাকে ফিরিয়ে আনা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে৷ তাই সময় থাকতেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷

অনেক সময় রাজনৈতিক নেতা–মন্ত্রীরা ক্ষমতায় এসে সমাজের কাজের চেয়ে আপন স্বার্থ চরিতার্থ করতেই বেশি সচেষ্ট থাকে৷ নিজের স্বার্থ পূর্ত্তির জন্যে অনেক সময় সৎ নীতিবান অফিসারদেরও অসৎ কাজে উৎসাহিত করে থাকে৷ কখনও কখনও নীতি বিরুদ্ধ কাজের জন্যে পুরস্কৃত করা হয়৷ কখনও বা আবার অফিসারকে বাধ্য করা হয়ে থাকে অথচ সেই সব অফিসাররা মুখবুজে সব হজম করলেও ভয়ে কিছু বলেন না৷ এই অবস্থায় ভয় না পেয়ে নেতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হলে সৎ ব্যষ্টিদের ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা খুবই জরুরী৷

সমাজে শান্তি স্থাপনে রাজনীতিকদের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে৷ কিন্তু রাজনীতিতে সৎব্যষ্টিদের বড্ড অভাব তাই গোটা সমাজটাই কলুষিত হয়ে গেছে৷ সৎ নীতিবাদী ব্যষ্টিরা রাজনীতিতে এগিয়ে আসলে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা সহজ হবে৷ আমরা জানি সমাজের প্রায় সবাই–ই শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন পছন্দ করেন৷ কিন্তু এই শান্তিপ্রিয় মানুষেরা ঐক্যবদ্ধ নয় বলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদ গড়ে তুলতে পারেন না৷ কোথাও কোথাও প্রতিবাদ করতে গিয়ে আরও বিপদে পড়তে হয়৷ তাই অনেকেই পরিস্থিতির চাপে পড়ে দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করে চলতে বাধ্য হচ্ছেন৷ ফলে ভেতরে ভেতরে চাপা ক্ষোভ আর অসন্তোষ বাড়তে থাকায় মানসিক টেনশান আর হতাশার জন্ম দিচ্ছে৷ এই টেনশান আরও দশটা রোগের জন্ম দিচ্ছে, অশান্তির পারদ চড়ছে হু হু করে৷ আজকের শিক্ষিত সমাজে এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা৷ একটা শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ প্রয়াশই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান৷ যুগে যুগে দেখা যায় সমাজে যখন চরম অবক্ষয় চলতে থাকে, রাজশক্তি রাজকার্য চালাতে ব্যর্থ হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়৷ স্তব্ধ হয়ে যায় উন্নয়নের গতি৷ ভেঙ্গে পড়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা৷ সাধারণ মানুষ চরম হতাশা আর অশান্তির মধ্যে দিন কাটায়.....এমন পরিস্থিতিতে সমাজের হাল ধরার জন্যে বুদ্ধিমান নীতিবাদী মানুষেরাই এগিয়ে এসে থাকে৷ আজও এমনই একটি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমাদের সমাজকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে হচ্ছে৷ তাই নীতিবান ও আদর্শবাদী মানুষেরা সমাজ রক্ষার্থে এগিয়ে আসুক৷ দলবদ্ধ পিঁপড়েরা যেমন তাদের তুলনায় অনেক বড় প্রাণীকেও সহজেই কাবু করে ফেলে তেমনি আজকের এই সমস্যাও যতই জটিল হোক না কেন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে এর সুষ্ঠু সমাধানও অবশ্যই সম্ভব৷