ক্রমবিবর্তনের চরম পরিণতি মানুষ অণুচৈতন্যের ব্যাপক স্ফূর্ত্তি-নিৰন্ধন অন্যান্য জীবের চেয়ে শ্রেষ্ঠ৷ মানুষ তার এই স্ফূর্ত চৈতন্যের সাহায্যে ভাল-মন্দের পার্থক্য নির্ধারণে তথা বিপন্মুক্তির পথ অন্বেষণে সক্ষম৷ কোন জীবই দুঃখদুর্দশাক্লিষ্ট জীবন চায় না৷ বস্তুতঃ মানুষের স্বভাবই হচ্ছে আনন্দের অন্বেষণ করা৷ এখন দেখা যাক্ এই আনন্দ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে মানুষ কী করে, আর তাতে তা’ লব্ধ হয় কি না৷
আনন্দের অন্বেষণে মানুষ প্রথমতঃ পার্থিব ভোগের দিকেই আকৃষ্ট হয়---এষণার নিবৃত্তির জন্যে সে ধন আহরণ করে, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি অর্জনে তৎপর হয় কিন্তু এ সকল জিনিস তাকে আনন্দ দিতে পারে না৷ যার আজ একশত টাকা আছে সে চায় লক্ষ টাকার মালিক হতে৷ চাহিদার এরূপ ক্রমবর্ধমান গতি অব্যাহতই থেকে যায়৷ আবার যে আজ নিজের জেলায় প্রতিপত্তি অর্জন করেছে সে চায় প্রদেশজোড়া প্রতিপত্তি, অনুরূপভাবে প্রাদেশিক নেতারা চান রাষ্ট্রনেতা হতে, আর রাষ্টনেতা হবার পরেও তাঁদের মনে বিশ্ব-নেতা হবার বাসনা জেগে বসে৷ অর্থাৎ সীমিত সম্পদ, মান-যশ, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি এগুলো মানুষের বাসনার নিবৃত্তি ঘটাতে পারে না, বরং ভোগের প্রবৃত্তি উত্তরোত্তর বাড়িয়েই দেয়, আর এতে করে মানুষের অনন্ত ক্ষুধা অতৃপ্তই থেকে যায়৷
প্রাপ্তির ঐশ্বর্য যতই মহান হোক্ না কেন, অনন্ত সুখের পিয়াসী মানব-মনকে তা’ পরিতৃপ্ত করতে পারে না৷ যারা ধন-মান, খ্যাতি-যশ প্রভৃতির পশ্চাতে পশ্চাতে ধাবিত হয় তারা এগুলো অনন্ত পরিমাণে না পাওয়া পর্যন্ত কখনও তৃপ্ত হতে পারে না৷ কিন্তু গোটা পৃথিবীটাই একটা সীমিত সত্তা, তাই তৎ-সাপেক্ষপার্থিব জিনিস অবশ্যই সীমিত৷ এগুলো অনন্ত পরিমাণে আহরণ করাও সম্ভব নয়৷ সুতরাং পার্থিব মহান প্রাপ্তি তা’ যদি ভূমণ্ডলও হয় তাহলেও অনন্ত ও শাশ্বত নয়৷ তাহলে সেই শাশ্বত সত্তাটি কী যা মানুষকে চিরন্তন সুখ দিতে পারে?
ভূমাসত্তাই কেবল অনন্ত ও শাশ্বত, আর তাঁর উপলব্ধিতেই মানুষের অনন্ত ক্ষুধার পরমা নিবৃত্তি সম্ভব৷ নশ্বর পার্থিব মানৈশ্বর্য, ক্ষমতাপ্রাপ্তি মানুষকে এই স্থির সিদ্ধান্তেই নিয়ে আসে যে সান্ত-সীমিত পৃথিবীর কোনো কিছুতেই তার অনন্ত সুখলাভের চিরন্তন স্পৃহার শাশ্বতী তৃপ্তি হতে পারে না---হতে পারে কেবল সেই বিভু সত্তা ৰ্রহ্মের উপলব্ধি (তে৷ বস্তুতঃ মানুষের অনন্ত ভোগবাসনার পশ্চাতে এই ব্রহ্মোপলব্ধির বাসনাই প্রচ্ছন্নভাবে থেকে যায়৷ অতএব ব্রহ্মপ্রাপ্তিই মানুষের ধর্ম, আর জীবমাত্রেরও তা-ই স্বভাব৷
ধর্ম শব্দের অর্থ হ’ল সত্তাগত বৈশিষ্ট্য বা গুণ৷ এর ইংরেজী প্রতিশব্দ হ’ল ‘নেচার’, characteristic বা (property) ৷ আগুনের ধর্ম বা স্বভাব দহন করা৷ আগুন ও তার ধর্ম এ দুটো জিনিস যেমন অবিচ্ছেদ্য, মানুষ ও তার ধর্ম ব্রহ্মানুসন্ধিৎসা---এও ঠিক তেমন ধারা জিনিস৷
চৈতন্যের স্ফুটতর অভ্যব্যক্তিতেই মানুষের মধ্যেকার পশুত্বের মান সূচিত হয়ে থাকে, সৃষ্টির ক্রমোন্নতির ধারায় পশুজীবন থেকে মানব জীবনের বিকাশ ঘটে থাকে, আর তাই মানব জীবনে বৃত্তির দ্বিমুখী গতি পরিদৃষ্ট হয়৷ জড়াভিমুখী গতি তাকে পশুত্বের দিকে টেনে নিয়ে যায়, আর তদ্বিপরীত সূক্ষ্মধর্মী গতিই তাকে পশুত্বের গ্লানি থেকে মুক্তি দেয়৷ পশুজীবনে পশুত্বের ব্যাপক বিকাশ দৃষ্ট হয়, আর চৈতন্যের স্ফূটতর অভিব্যক্তি-নিৰন্ধন মনুষ্য-জীবনে বিচার বিবেচনারও মহত্ত্ব পরিলক্ষিত হয়৷ পশুত্বের প্রাৰল্যে মানুষ পানাহারাদি যে সকল স্থূল ভোগের দিকে আকৃষ্ট হয় তারা কখনো তার অনন্ত ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটাতে পারে না৷ পশুদের ভোগ-স্পৃহা অনন্ত নয় ৰলে তারা এ সকল সীমিত ভোগ্যে পরিতৃপ্ত হয়---অপর্যাপ্ত ভোগোপাদান থেকেও পশুরা তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত গ্রহণ করে না৷ কিন্তু অনুরূপ অবস্থায় মানুষ নিশ্চয় তা করে না৷ এ থেকে এই সিদ্ধান্তেই আসা যায় যে পশুদের ভোগাকাঙ্ক্ষা সীমিত, কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে তা’ অনন্ত৷ উভয়ক্ষেত্রেই পশুত্বকে কেন্দ্র করেই ভোগাভিমুখী গতির অভিবক্তি হয়ে থাকে৷ মানুষের বিকশিত চৈতন্যই এতদুভয়ের মধ্যে এই বিভেদের সৃষ্টি করে৷ এই বিকশিত চৈতন্য-সাপেক্ষ অনন্ত সুখ প্রাপ্তির অনন্ত ক্ষুধা নশ্বর সীমিত পার্থিব সুখৈশ্বর্য-ক্ষমতা-প্রতিপত্তি প্রভৃতিতে নিবৃত্ত না হয় তাকে উত্তরোত্তর ব্রহ্মানন্দের দিকেই আকৃষ্ট করতে থাকে৷
মানুষের মধ্যে পশুত্ব ও বিবেকের মধ্যে সর্বদাই সংঘর্ষ হয়ে চলেছে৷ পশুত্ব তাকে প্রপঞ্চাত্মক ভোগে উৎসাহিত করে আর অতৃপ্ত ও জাগ্রত বিবেক তার ব্রহ্মাভিমুখী গতি অব্যাহত রাখে৷ ক্ষমতা-প্রতিপত্তি দ্বারা আহৃত ভোগ্য-সামগ্রী যদি অসীম ও অনন্ত হত তাহলে তারা অবশ্যই আনন্দভিলাষী বিবেকের চিরন্তন অনুসন্ধিৎসার অবসান ঘটাতে সক্ষম হত কিন্তু তারা তা’ নয় ৰলে নশ্বর পার্থিব ভোগের চরম মর্যাদাও মানুষের মনে শাশ্বতী শান্তির প্রতিষ্ঠা করে তাকে ভূমানন্দে অধিষ্ঠিত করতে পারে না৷
চৈতন্যের স্ফূটতর অভিব্যক্তিই মানুষ ও পশুর পার্থক্য সূচিত করে৷ তাহলে এই চৈতন্যের সদ্ব্যবহার কি মানুষ মাত্রেরই একান্ত করণীয় নয়? তার চৈতন্য বা বিবেক যদি পশুত্বের আড়ালে প্রসুপ্তই থেকে যায় তাহলে তার আচরণ অবশ্যই পশুস্তরে নেৰে আসতে বাধ্য৷ বস্তুতঃ সে পশুরও অধম হয়ে পড়ে, কেননা অভিব্যক্ত চৈতন্যের অধিকারী হয়েও সে তার সুযোগ গ্রহণ করে না৷ এরূপ ব্যষ্টি নিশ্চয়ই মনুষ্য নামের অযোগ্য---এরা মানবাধারে এক একটি পশুবিশেষ৷
চৈতন্যের ধর্মই হ’ল অখণ্ডসত্তা ৰ্রহ্মের পানে ধাবিত হওয়া৷ অভিব্যক্ত চৈতন্যের প্রেরণাকে কার্যান্বিত করে যারা মনুষ্য নামের সার্থকতা বহন করে তারা অবশ্যই দেখৰে যে তাদের সকলের লক্ষ্যই সেই এক অদ্বিতীয় অনন্ত ব্রহ্ম৷ ব্রহ্মসম্প্রাপ্তির এই এষণাই হ’ল মানুষের সত্তাগত বৈশিষ্ট্য, গুণ বা ধর্ম৷
ইচ্ছার পরিপূর্তিই হ’ল আনন্দ৷ ঈপ্সিত বস্তু না পেলে দুঃখের গ্লানিতে মানুষের মন ভরে ওঠে৷ স্ফূটতর চৈতন্যই মানুষকে পশুজীবনের গ্লানি থেকে অব্যাহতি দেয় ও ব্রহ্মানুশীলনে তৎপর করে৷ তাই ব্রহ্মসম্প্রাপ্তিতে বা তৎপ্রচেষ্টায় সংলগ্ণ হয়েই মানুষ যথার্থ আনন্দ লাভ করে৷ এভাবে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে অনন্তকে বা ব্রহ্মকে উপলব্ধি করাই হ’ল বিশ্ব মতবাদ বা মানব-ধর্ম৷ কেবল এই ধর্মের অনুশীলনেই মানুষের শাশ্বত সুখ বা পরমা শান্তি লাভ সম্ভব৷