এবার তরুণ–তরুণীদের মোহমুক্ত হয়ে কিছু করার সময়

লেখক
প্রভাত খাঁ

অনেক ভাবনা চিন্তা করে সুভাষচন্দ্র একটি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতকে নির্বাচিত করেছিলেন ভারতের জাতীয়                 সঙ্গীত হিসেবে৷ সত্যই অনবদ্য সঙ্গীতটি৷ ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে, জয় হে, জয় হে’৷ সত্যই সকল মনের যিনি নিয়ন্ত্রক ও কর্ত্তা সেই তিনি তো ভাগ্যবিধাতা৷

কত বড়ো যে কবির চিন্তা ও ভাবনা তা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের চিন্তার বাইরে৷

আমরা ভাগ্যবান, এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ৷ তবে মুখোশের আড়ালে যে বুদ্ধিজীবীরা সেই সৎচিৎ আনন্দমের বিরাটত্বকে পদে পদে অস্বীকার ও অপমানিত করছে তা বড় বেদনার৷ অসহায় আমরা বুঝেও কিছু করতে পারছি না৷

অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি ও যে রাজনৈতিক অধিকারের বলে নাগরিক হয়েছি সেই অধিকারকে নির্ভয়ে প্রয়োগ করার পরিবেশ আজও এ দেশের নেতারা করেননি৷ পেশীশক্তি, ছলে–বলে তাকে সংকুচিত করে রেখেছে৷ এটাই হ’ল সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা৷

আইনের চোখে আমরা সবাই সমান কিন্তু বাস্তবে কি তাই? আইনকে বাস্তবায়িত করবেন সরকার, সেই সরকারই যদি দুর্বৃত্তদের দ্বারা ধর্ষিত হয় তাহলে দেশের জনগণ যাবে কোথায় আর থাকবেই বা কি? জননী জন্মভূমি স্বর্গাদপি গরীয়সী–সেই জন্মভূমিকেই তো নেতারা টুকরো টুকরো করে দিল৷ লক্ষ লক্ষ নিরীহ নরনরীর রক্তে ভাসিয়ে দিল জননীর বুক৷ আজও সেই কান্না বন্ধ হয়নি৷ মুখোশের আড়ালে একদল যে কি ভয়ংকর অঘটন ঘটাচ্ছে তার ইয়ত্বা নেই৷

গণতন্ত্রে তো সবাই আপন ইচ্ছানুসারে মতামত দান করবে তা কি আজও হয়েছে? দেশের মানুষ আজও সেই অধিকারকে মনের মতো করে পাচ্ছে না৷ মুখোশধারী বুদ্ধিজীবীরা প্রতি পদে পদে ছলবল কৌশলে সত্যকে গলা টিপে মারছে৷ দেশে দলাদলি, খেয়োখেয়ি করেই শক্তিক্ষয় করছে৷ সম্প্রদায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বতে দেশ আজ বিপন্ন৷ ভাই ভাইকে হত্যা করছে৷ প্রেম, দয়া মায়া কোথায় উবে গেছে৷ ঘৃণা হিংসা ও বিচ্ছেদই আজ ভয়ংকর রূপে ধেয়ে এসে সব কিছু গ্রাস করছে৷

গণতন্ত্র আজ দলতন্ত্রের বেড়াজলে হাঁপিয়ে উঠেছে৷ ন্যায়নীতি আদর্শ বলতে কিছুই নেই৷ তাই অধিনায়ক আজ আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে৷ দেশসেবায় আজ আর সৎনীতিবাদীরা স্থান পায় না৷ গণতন্ত্রে মানবিক মূল্যবোধটাই হ’ল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ সেই মানবিক মূল্যবোধই আজ পদে পদে অস্বীকৃত৷ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, চরিত্রহীনতা, ব্যাভিচারিতা মানবতাকে গ্রাস করছে৷ তাই এই যুগধর্মকে বলা যায় এক তমসাচ্ছন্ন আত্মকেন্দ্রীকতায়পূর্ণ্ অধঃগতি৷ এই অধঃগতি হতে দেশ ও জাতিকে জাগরণের জন্যে প্রথম দরকার একদল নীতিবাদী তরুণ–তরুণীর আবির্ভাব যারা আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে সেই সর্বশক্তিমান জনগণমন অধিনায়কের অস্তিত্ব স্বীকার করে মানবিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দিয়ে নিপীড়িত, নির্য্যাতিত শোষিত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে সেবা দিতে এগিয়ে আসবে৷ সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার ওপরে নাই এই মহানবাণীকে বাস্তবায়িত করবে৷

আর আজ চারিদিকে যে সব বুদ্ধিজীবী মুখোশধারী খণ্ড ক্ষুদ্র স্বার্থে প্রেতের নাচ নাচাছে তাদের মুখোশগুলো খুলে যাদের জনগণের দরবারে বিচার করবে অদ্যাবধি তারা কতটা ক্ষতি করেছে দেশ ও জনগণের৷ আজ এই চরম সংকটে সকলকে স্মরণে রাখতে যে মিথ্যাচার আর ভণ্ডামীর দ্বারা বিরাটের আবাহন করা যায় না৷

অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যে যতদিন যাচ্ছে এদেশে দলীয় সরকারগুলি দলবাজি যতটা করছে তার চেয়ে দেশের সামাজিক  ও আর্থিক উন্নতির  কাজ যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেদিকে তিলমাত্র নজর দিচ্ছে না৷  ফলে চরম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও বেকার  সমস্যা  দেশের নাভিশ্বাস উঠছে৷ শিক্ষাক্ষেত্রেও নেমে এসেছে একটা অনিশ্চয়তা ও হতাশা৷  তারই দরুণ শিক্ষা জগতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে৷ প্রশ্ণপত্র ফাঁস থেকে এমন সব কাণ্ড ঘটছে  যা খুবই  লজ্জাজনক৷ অভিভাবকগণ ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যত গড়ে তুলতে বর্ত্তমানে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়তে নজর দিচ্ছেন৷  কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে রুজি-রোজগারের তেমন সুযোগ না থাকায় ইঞ্জিরিয়ারিং পড়ার দিকে  অনীহা দেখা দিয়েছে তাঁদের মনে৷  এতে দেশের বৌদ্ধিক সম্পদ নষ্ট হচ্ছে৷ অন্যদিকে  এদেশের কল-কারখানা সম্প্রসারন না হয়ে তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে৷ বেকারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে৷ তা হলে  দেশের উন্নতিটা কী হচ্ছে? রাজনৈতিক দলগুলো কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাডার ধরার কাজে উঠে পড়ে লেগেছে৷ তারা অনেকে পড়াশুনার শেষে সরাসরি দলে যোগ দিয়ে দলের মধ্যে  নানা ধরণের  বিরোধিতা করছে ও অশান্তি পাকাচ্ছে৷  বিশেষ করে এই রাজ্যে রাজনৈতিক  প্রবণতাটা রাজ্যের  যুবক যুবতী তরুণ তরুণীদের অন্য রাজ্যের চেয়ে বেশী৷

 ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক দুর্নীতিটা  যতদিন  যাচ্ছে এই রাজ্যই বেশী করে বাড়ছে৷

রাজনৈতিক মানটাও কমছে, আর দল থেকে অনেকেই  নেতা নেত্রীদের লাগাম ছাড়া হচ্ছে৷ রাজ্যটা ধীরে ধীরে অশান্তি ও অরাজকতার দিকে এগিয়ে চলেছে৷ বেকারত্বের এটা যে  একটা কারণ সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই৷  অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে যখন যে শাসনে আসে, তখনই সেই দলে জনসমর্থন  লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে , কারণটা একটাই  কিছু  পাবার  আশায়৷ তাই যে দল শাসনক্ষমতা হারায় তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না৷  তাদের চরম দুর্দশা নেমে আসে৷ সংবাদ পত্রে দেখা যায় দলে দলে লোক যোগ দিচ্ছে শাসকদলের দিকে৷ আবার যে দল মাথাচাড়া দিচ্ছে সে দলে কিছু পাবার  আশায় লোক অন্যদল ভেঙ্গে ঢুকছে, মার খাচ্ছে৷ ধুনী জ্বেলে  বসে আছে বয়স্করা৷ এটাই হলো এক করুণ দলীয় দলনীতির ছবি৷ এটা কিন্তু  প্রকৃতপক্ষে  দেশের সামগ্রিক সামাজিক চেহারা৷  আর্থিক  লক্ষ্য নেই,  তাদের নজরটা শুধু গদি রক্ষার দিকে৷ তারা মুখে উন্নতির বাণী ছড়ায় ৷ আর ঋণভারে দেশ আর্থিক উন্নয়ন  রুদ্ধ করেই ছাড়ে৷ ভারতের  যে বাৎসরিক আয় হয়, তার কয়েকগুণ বেশী খরচ হয় দেশের প্রশাসনিক খরচ চালাতে৷ তাই বহুদলীয়  গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাটা এদেশে  এক মর্র্মন্তিক আর্থিক, সামাজিক ব্যর্থতাকে বাড়িয়ে তুলেছে৷ মানুষের শুভ গুণগুলিকে এইসব নেতা ও নেত্রীগণ দলীয় স্বার্থে ধবংস করেই ছাড়ছে৷ অভিজ্ঞতায় দেখা গেল কোন রাজনৈতিক দল ৭৫ বছরে  দাঁড়াতে পারলো না টুকরো টুকরো  হয়ে ছোট ছোট দলে পরিণত হলো৷

এখন রাজনৈতিক দলগুলির একমাত্র  লক্ষ্য হয়ে উঠেছে যেন তেন প্রকারেণ গদি দখল৷  তাই নির্র্বচনী  বৈতরণী পার  হওয়ার জন্যে প্রায় সমস্ত  বড় বড় দলগুলিই প্রতিপক্ষের  ওপর  ঝাঁপিয়ে পড়ছে  নানান্‌ অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে৷

সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্র্বচনে  তাই দেখা যাচ্ছে প্রায় সব জেলা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে৷ প্রতিপক্ষের  প্রার্থী মনোনয়ণপত্রই পেশ  করতে দিচ্ছে না চলছে মারপিট, খুন-জখম, ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসসৃষ্টির  পরিস্থিতি৷  যাদের যেখানে বেশী ক্ষমতা তারা সেখানে উগ্রভাবে  ক্ষমতা প্রদর্শনে  মেতে উঠেছে৷ তাকে  আর যাই হোক গণতন্ত্র বলা যায় না৷ গণতন্ত্রের বুলি আউড়িয়ে গদি দখলের  লড়াই৷