ভারতে কদর্য রাজনীতি ও দুর্নীতি ব্রিটিশ আমলেই শুরু হয়েছে৷ অহিংসা ও গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র সেদিনই কংগ্রেসের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেছিল৷ বিশেষ করে আদর্শে ও কর্তব্যে অটল সুভাষচন্দ্রের জেদী আপোষহীন মনোভাবকে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি কংগ্রেসের আপোষকামী সুবিধাবাদী নেতৃত্বের পক্ষে৷ তাই সুভাষকে কংগ্রেস থেকে উচ্ছেদ করতে স্বৈরাচারের পথই তারা বেছে নিয়েছিল৷
ব্রিটিশ শাসনে গান্ধীর অনুমোদনে বিভিন্ন রাজ্যে যে সব কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল দুর্নীতির শুরু সেখান থেকেই৷সেই সময় গান্ধীজীর সচিব মহাদেব দেশাই জহরলালকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন---‘আমাদের কয়েকজন মন্ত্রির কাজে যে সত্য ও অহিংসা ভঙ্গের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে সে সম্পর্কে খোলাখুলি ও পুরোপুরি যাতে লেখো---বাপুজী তাই-ই চান৷’ কাটমানির চলন সেই দিন থেকেই৷ ব্যাপারটা শুধু শব্দগত পার্থক্য৷ মন্ত্রিরা বেতন ছাড়লেও ভাতার আড়ালে অনেক বেশী টাকা নিয়ে নিত৷ বিভিন্ন প্রদেশে কংগ্রেসী মন্ত্রিসভাগুলি সততার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে মাত্র ৫০০ টাকা বেতন নিত, কিন্তু ব্যাপার হ’ল তারা বেতন ছাড়লেও বেতনের টাকাটা ছাড়েন নি৷ জহরলালের ব্যষ্টিগত বন্ধু এডওয়ার্ড টমসন জহরলালকে এক চিঠিতে লেখেন---‘কংগ্রেসী মন্ত্রিসভা মাসে মাত্র ৫০০ টাকা বেতন নিচ্ছেন শুণে আমি যারপরনাই আনন্দিত হয়েছিলাম৷ শুণে খুবই খারাপ লাগল---এই যে আত্মোৎসর্গ এর বেশীরভাগই ভুয়ো, কেননা তাঁরা বাকিটা ভাতা হিসেবে নিচ্ছেন৷’ অর্থাৎ ত্যাগের ছল করে বেতন ছাড়লেও ভাতার নাম করে গাড়ী-বাড়ী ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিত৷ দুর্নীতির সেই শুরু, স্বাধীনতার পর ৭৪ বছরে তা আরো শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়েছে৷ শুধু নামের হেরফের, তখন যেটা ভাতা ছিল এখন সেটাই কাটমানি৷
স্বাধীন ভারতে দুর্নীতির জাল বিস্তার করলেও গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলি স্বাধীন সত্তা বজায় রেখেই চলছিল৷ দলীয় হস্তক্ষেপের বাইরেই ছিল৷ অনেকটাই নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলছিল৷ কিন্তু আজ সেই স্তম্ভগুলোর ভিত যেন আস্তে আস্তে আলগা হচ্ছে৷
গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখার অন্যতম স্তম্ভ বিচারবিভাগ৷ সেই বিচারবিভাগেরই নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ণ উঠেছে৷ প্রশ্ণ উঠেছে সুপ্রিম কোর্টের ভেতর থেকেই৷ কোনও বিরোধী দল বা জনতার মধ্য থেকে নয়৷ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তাঁরই চারজন বিচারপতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিলেন৷ এই নিয়ে জল অনেকদূর গড়িয়েছিল৷ সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে বলা হয় সাতটি ভারতীয় ভাষায় সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রকাশ করা হবে৷ দুঃখের বিষয় সেই সাত-এর মধ্যে বাংলা ভাষা স্থান পায়নি৷ শুধু ভারতে নয়, বিশ্বের প্রথম সারির কয়েকটি ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান৷ ভারতেও বাংলা বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ভাষা৷ যদিও নানা কারচুপির মাধ্যমে হিন্দীকে বৃহত্তম দেখানো হয়েছে৷ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিচারেও বাংলা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা৷ সেই বাংলাকে সাতের মধ্যে স্থান না দেওয়ায় সুপ্রিম কোর্টের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠতেই পারে৷ অথবা কোন শাসকের অঙ্গুলী হেলনে এটা হয়েছে মনে হতে পারে৷ সুপ্রিম কোর্ট কি তার স্বাধীন সত্তা হারাতে বসেছে?
গণতন্ত্রের আর একটি শক্ত স্তম্ভ নির্বাচন কমিশন৷ তারও স্বাধীন অস্তিত্ব আজ সন্দেহের ঊধের্ব নয়৷ সম্প্রতি লোকসভা নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের তিন সদস্যের একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনে পদত্যাগ করেন৷ একইভাবে সিবিআই সংবাদ মাধ্যম সর্বস্তরেই শাসক দলের কালো হাতের ছায়া দেখা যাচ্ছে৷
গণতন্ত্রের আড়ালে তাহলে কী হিটলারি শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটছে? সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস ছাড়া করতে হিন্দুস্থানী হিটলারের নামে কংগ্রেসের ভেতর থেকে প্রথম জয়ধবনি উঠেছিল ভারতের মাটিতে৷ নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে গিয়ে দেশনেতারা কত নীচে নামতে পারে, কত হীন হতে পারে সেদিন দেখিয়েছিল কংগ্রেসের ভেতর থেকে সুভাষ বিরোধীরা৷
গান্ধী মনোনীত প্রার্থী পট্টভী সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে সুভাষচন্দ্র দ্বিতীয়বার সভাপতি নির্বাচিত হলেন৷ গণতন্ত্রের মুখোশ খসে পড়ল কংগ্রেসের ভিতর থেকে৷ শুরু হল কদর্য রাজনীতির খেলা৷ যে কোন ভাবেই হোক সুভাষকে তাড়াতে হবে! কংগ্রেসে থেকে গান্ধীর মতের বিরুদ্ধে যাওয়া চলবে না৷ তাতে দেশ যদি অধঃপতে যায় যাক৷
কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র অণুযায়ী যিনি কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হবেন তিনিই ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করবেন৷ কিন্তু কংগ্রেসের ভেতর থেকে প্রস্তাব নেওয়া হ’ল-সুভাষকে গান্ধীর মনোমত লোকদের নিয়ে ওয়ার্কিন কমিটি ঘটন করতে হবে৷ গান্ধীর আর সময় হ’ল না সুভাষকে সময় দেওয়ার৷ বরং গান্ধীবাদী নেতা শেঠ গোবিন্দ দাস এক সভায় বললেন---‘ফ্যাসিস্টদের মধ্যে মুসোলিনী, নাৎসীদের মধ্যে হিটলার, কমিউনিষ্টদের মধ্যে ষ্ট্যালিনের যে স্থান, কংগ্রেসসেবীদের মধ্যেও মহাত্মা গান্থীরও সেই স্থান৷’ সভার মধ্য থেকে আওয়াজ উঠল---হিন্দুস্থান কা হিটলার মহাত্মা গান্থীজী কী জয়!’ না, গান্ধী সেদিন এ কথার কোন প্রতিবাদ করেননি৷
ব্যথিত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখলেন--- ‘অবশেষে আজ, এমনকি কংগ্রেসের মঞ্চ থেকেও হিটলারী নীতির জয়ধবনী শোণা গেল....৷ স্বাধীনতার মন্ত্র উচ্চারণ করার জন্যে যে বেদী উৎসৃষ্ট, সেই বেদীতেই আজ ফ্যাসিস্টের সাপ ফোঁস করে উঠেছে৷’
সুভাষচন্দ্রকে ঘিরে যে নীচ,হীন, কদর্য রাজনীতি কংগ্রেসে শুরু হয়েছিল সেই রাজনীতির শিকার হয়েই গান্ধীজীকে চলে যেতে হয়েছে৷ কিন্তু ভারতবর্ষের রাজনীতি থেকে হিটলারীতন্ত্র চলে যায়নি৷ গণতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে হিটলারি শক্তির ভজনা চলছেই৷ দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও কংগ্রেস মুক্ত ভারত চাইলেও গান্ধী মুক্ত ভারত চাননি৷ বরং তিনি একটু বেশী গান্ধীভক্ত৷ তাই দেশ কংগ্রেস মুক্ত হলেও হিটলারিতন্ত্র থেকে মুক্ত হবে কি?৷ প্রশ্ণ উঠছে কারণ---হিন্দুস্থান কা হিটলার গান্ধীর ছায়া আজও শাসকদের আচ্ছাদিত করে রেখেছে৷ আজ যেভাবে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলো স্বাধীন সত্তা হারিয়ে শাসকের বশীভূত হচ্ছে, তাতে একদিন হয়তো কেউ আওয়াজ ওঠাবে---হিন্দুস্থান কা হিটলার কি জয়!
- Log in to post comments