বাংলায় আর একটা কথা রয়েছে ‘হাট’৷ সংস্কৃত ‘হট্ট’ শব্দ থেকে ‘হাট’ শব্দটি এসেছে৷ যেমন পাশাপাশি সাজানো অনেকগুলি হাট, সংসৃক্তে ‘হট্টমালা’৷ ‘হট্টমালার গল্প’ তোমরা অনেকেই নিশ্চয় পড়েছ৷ সংসৃক্তে বড় বড় হাটকে বলে ‘হট্টিক’৷ হট্টূ + ‘ষ্ণিক্’ প্রত্যয় করে ‘হট্টিক’৷ যদিও বৈয়াকরণিক বিচারে ‘হট্টিক’ মানে ছোট হাট হওয়া উচিত কিন্তু আসলে বড় হাট অর্থেই ‘হট্টিক’ শব্দটি ব্যবহার করা হ’ত৷ ‘হট্ট’–এর তদ্ভব বাংলা হচ্ছে ‘হাট’৷ যেমন রাজারহাট, বাগেরহাট, মাঝেরহাট প্রভৃতি৷ ‘হট্টিক’ শব্দের বাংলা ‘হাটি’৷ যেমন ‘নবহট্টিক’ থেকে ‘নৈহাটি’, ‘নলহট্টিক’ থেকে ‘নলহাটি’, ‘গুবাকহট্টিক’ থেকে ‘গৌহাটি’ (গুয়াহাটি) প্রভৃতি৷ দক্ষিণ বাংলায় হাটকে ‘হাটা’, ঘাটকে ‘ঘাটা’ রূপে উচ্চারণ করার একটা প্রবণতা ছিল৷ তার ফলে আমরা পাচ্ছি পাথুরে ঘাটা, বেলেঘাটা, মুরগীহাটা, দরমাহাটা, গড়িয়াহাটা প্রভৃতি৷
আউশ ধানের জেলা নদীয়ায় স্বাভাবিক নিয়মেই গো–খাদ্যের (fodder) টান পড়ত৷ পাশেই রয়েছে আমনের জেলা বর্দ্ধমান৷ বর্দ্ধমানের নন্দনঘাট (নাদনঘাট) থেকে নৌকো বোঝাই খড় জলঙ্গী নদী দিয়ে নদীয়া জেলায় আমদানী করা হ’ত৷ সেকালের এই খড়ের নৌকো–বোঝাই জলঙ্গী নদীর তাই নতুন নামকরণ করা হয়েছিল খড়িয়া বা খড়ে নদী৷ অর্থাৎ পদ্মা হতে নিঃসৃত এই জলঙ্গী নদী মুর্শিদাবাদ জেলায় ‘জলঙ্গী’ নামে পরিচিত হলেও এর আটপউরে নাম খড়ে নদী৷ তাই সেই নদীয়া জেলার গোপালক–প্রধান রেউই গ্রামের (সেকালকার সেই রেউই গ্রামই পরবর্তীকালে ‘কৃষ্ণনগর’ নামে পরিচিত হয়েছিল) পাশেই ছিল প্রকাণ্ড একটি গোরুর হাট–সংস্কৃত ভাষায় ‘গোহট্টিক’>প্রাকৃতে ‘গোহড্ডি’> অর্দ্ধপ্রাকৃতে ‘গোহাডি > পুরোনো বাংলায় ‘গোহাড়ি’ > বর্তমান বাংলায় ‘গোয়াড়ি’৷ ইংরেজরা নদীয়া জেলার সদর গোয়াড়িতেই করেছিলেন৷ এখনও আমরা একসঙ্গে উচ্চারণ করে বলি ‘গোয়াড়ি–কৃষ্ণনগর’৷
যেখানে কেনা–বেচার জন্যে খুব বড় রকমের কেন্দ্র রয়েছে–তা সে গ্রামেই হোক বা শহরেই হোক, তাকে ফার্সীতে বলে ‘কসবা’৷ চব্বিশ পরগণাতে ‘কসবা’ বলে একটি জায়গা রয়েছে৷ যশোর শহরের পুরোনো নাম ছিল ‘কসবা’৷ আসল যশোর নামক স্থানটি যখন খুলনা জেলা তৈরী হ’ল তখন খুলনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়৷ খুলনা খুব প্রাচীন জেলা নয়৷ চব্বিশ পরগণার সাতক্ষীরা, যশোরের খুলনা, বাখরগঞ্জের বাগেরহাটের অধিকাংশ অংশ নিয়ে জেলাটি তৈরী করা হয়েছিল৷ যশোর স্থানটি (ধূমঘাট) খুলনা জেলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবার পরে জেলার অবশিষ্টাংশের নাম যশোর রাখার কোন সার্থকতা ছিল না৷ তবু ‘যশোর’ নামটি বরাবর থেকে গেছ্ল৷ তখন থেকেই লোকে জেলা–সদর কসবা শহরকে যশোর নামে অভিহিত করেন৷ আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি, গ্রাম্য মেয়েরা শ্যালদায় টিকিট কাটতে গিয়ে বুকিং ক্লার্ককে ক্ষলত, ‘মাষ্টারবাবু, কসবার একটি টিকিট দেবে গা?’’ আর সঙ্গে সঙ্গে বুকিং ক্লার্ক যশোরের একটা টিকিট বার করে দিতেন৷
কলকাতার উত্তর ঘুঘুডাঙ্গাতে ইংরেজরা সৈন্যাবাস তৈরী করেছিলেন৷ সেখানে হরদম গুলিগোলার দুমদাম আবাজ হত৷ এ যেন সেই দীপাক্ষলীর রাত্রে এক–দমা দো দমা ফাটানো হচ্ছে৷ চারিপাশের গ্রামের লোকেরা আবাজে অতিষ্ঠ হয়ে ওই জায়গাটার নাম রেখেছিলেন ‘দমদমা’৷ পরে যখন সেখানে রেলের ইষ্টিশান হ’ল তখন জায়গাটির নাম রাখা হ’ল ‘দমদম’৷ জায়গাটার আসল নামটা হচ্ছে তাহলে ‘দমদমা’৷ স্থানীয় জনসাধারণ শ্যালদা ইষ্টিশানে টিকিট কাটতে গিয়ে বলত, ‘‘মাষ্টারবাবু, ঘুঘুডাঙ্গার একটা টিকিট দাও তো গো’’৷ বুকিং ক্লার্ক তাদের দমদমের টিকিট দিতেন৷ কেউ সিঁথির টিকিট চাইত না৷ হয়তো বা সিঁথির নামডাক ঘুঘুডাঙ্গার চেয়ে একটু কম ছিল বলেই চাইত না৷