লক্ষণ ঃ বুকের মধ্যে জোর শব্দ হওয়া, বুকে ব্যথা, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট বোধ হওয়া, হাত পা থর থর করে কাঁপা প্রভৃতি৷
কারণ ঃ হূদরোগের পেছনে অজস্র কারণ থাকতে পারে৷
১) পাকস্থলীকে যাঁরা সব সময় খুব বেশী ভারাক্রান্ত করে রাখেন, তাঁদের পাকস্থলীতে অধিক পরিমাণে রক্ত সঞ্চালনের আবশ্যকতা দেখা দেয় ও ওই রক্ত যুগিয়ে চলবার জন্যে হূদ্যন্ত্রকে অত্যধিক পরিশ্রম করতে হয়, যার ফলে তা’ দুর্বল হয়ে’ পড়ে৷
২) ৩৫/৪০ বৎসর বয়সের পরেও যাঁরা লোভের বশে অত্যধিক আমিষ খাদ্য গ্রহণ করে থাকেন তাঁদের হূদরোগ দেখা দিতে পারে কারণ আমিষ খাদ্য রক্তে অম্লভাগ বাড়িয়ে দেয় ও সেই রক্তকে দোষমুক্ত করবার জন্যে হূদযন্ত্রকে অত্যধিক পরিশ্রম করে’ দুর্বল হয়ে পড়তে হয়৷ রক্তে অম্লদোষ বেড়ে গেলে দেহাভ্যন্তরস্থ যন্ত্রগুলিও ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে’ পড়ে ও তারা হূদ্যন্ত্রের দুর্বলতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কারণ হয়ে’ দাঁড়ায়৷
৩) অত্যধিক তৈল বা চর্বি জাতীয় খাদ্যগ্রহণ ও তদুপযুক্ত শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে স্নায়ুপুঞ্জ চর্বিপ্রধান হয়ে যায় ও তাদের পক্ষে হূদ্যন্ত্রকে যথাযথ ভাবে সাহায্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, ফলস্বরূপ হূদ্যন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে৷ ওই চর্বি স্নায়ু–ধমনীর অভ্যন্তরে জমতে থাকলে রক্ত চলাচল ব্যবস্থা শোচনীয় ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয় ও রক্তসঞ্চালন ক্রিয়া যথাযথভাবে চালু রাখবার জন্যে হদযন্ত্রকে খুব বেশী পরিশ্রম করতে হয় যার ফলে অল্পকালের মধ্যেই সে দুর্বল হয়ে পড়ে৷
৪) যকৃতের দুর্বলতার ফলেও অনেক সময় দেহের উদ্বৃত্ত চর্বি স্নায়ু–ধমনীর অভ্যন্তরে সঞ্চিত হবার সুযোগ পায় ও স্বাভাবিক নিয়মে হূদ্যন্ত্র দুর্বল হয়ে যায় (এই ধরণের রোগীর সাধারণতঃ পুরাতন আমাশয় রোগ থাকে)৷
৫) অল্প ক্ষুধায় এক সঙ্গে অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণও এই রোগের একটি কারণ, কেননা এক সঙ্গে খুব বেশী খাদ্য গ্রহণ করলে পাকস্থলীর আকার বড় হয়’ ও তা ঊর্ধ্বস্থ হূদ্যন্ত্রের উপর চাপ দিতে থাকে৷ যে সকল ব্যষ্টি নিয়মিতরূপে জলখাবার খান না সাধারণতঃ তাঁরা দ্বিপ্রাহরিক ও রাত্রির আহারের সময় অধিক খাদ্য গ্রহণ করেন৷ দিনের পর দিন এই অবস্থা চলতে থাকলে তাঁদের পাকস্থলীর আকার বড় হয়ে’ যায় ও হূদ্রোগ দেখা দেয়৷
৫) কোষ্ঠকাঠিন্য এই রোগের আরেকটি কারণ৷ কোষ্ঠ পরিষ্কার না হলে সঞ্চিত মল দেহাভ্যন্তরে পচতে থাকে ও তার ফলে দূষিত বীজাণু সৃষ্ট হয়৷ এই বীজাণু হূদ্যন্ত্রকে আক্রমণ করবার সুযোগ পেলে হূদ্রোগ ফুটে ওঠে৷
৭) যারা অতিরিক্ত ক্রোধী তাদেরও এই রোগে আক্রান্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে কারণ ক্রোধের সময় মুখে ও মাথায় হঠাৎ অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন দেখা দেয়, যার ফলে মুখ লাল হয়ে যায়৷ এই অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালনের জন্যে হূদ্যন্ত্রকে হঠাৎ অত্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়৷ তাই যারা স্বভাবগত ভাবে ক্রোধী তাদের হূদ্যন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে৷ একই কারণে অতিরিক্ত লজ্জাতেও হূদ্যন্ত্র দুর্বল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে৷
৮) অতিরিক্ত ভয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত সরে যায় ও সেই সমস্ত রক্ত হঠাৎ বিপুল পরিমাণে হূদ্যন্ত্রের কাছে গিয়ে জমা হয়৷ এই চাপ হূদ্যন্ত্রের পক্ষে সহ্য করা কষ্টকর৷ তাই অতি ভয়ে হূদ্যন্ত্র ঢিপ ঢিপ বা ধড়ফড় তো করেই থাকে, অনেক সময় অতিক্রিয়তার ফলে তার ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়ে মৃত্যুও ঘটতে পারে৷ এইরূপ কাল্পনিক ভূতের ভয়ে অনেক সময় হূদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতেও দেখা যায়৷ মৃত্যুর ঠিক পূর্বক্ষণে অথবা কিছুটা পরে কখনও কখনও ওই রক্ত মুখ দিয়ে বহির্গত হয়ে যায়, (লোকে ভাবে ভূত মেরে ফেলেছে)৷ তাই দেখা যায় ভীরু স্বভাবের লেকেরা প্রায়শঃ হূদরোগে আক্রান্ত হন৷
৯) ঠিক একই কারণে কামোন্দ্রিয়ের ব্যবহারও হূদ্যন্ত্রকে অতিক্রিয় করে থাকে ও শ্বাসক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করে দেয়৷ তাই যারা স্বভাবগতভাবে কামুক তারাও প্রায়ই হূদ্রোগে আক্রান্ত হয়৷ যুবকদের অতিরিক্ত শুক্রস্খলনের ফলেও তাই হূদ্রোগ দেখা যায়
১০) মদ্ তামাক, বিড়ি, সিগারেট বা অন্যান্য নেশার জিনিস অত্যধিক পরিমাণে ব্যবহার করলে কোষ্ঠকাঠিন্য রোগের উদ্ভব হয় যা হূদ্রোগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ৷ তাছাড়া ওই সকল নেশার জিনিস রক্তে অম্ল ভাগ বাড়িয়ে দেয়, দেহের গ্রন্থি সমূহকে দুর্বল করে দেয় ও শেষ পর্যন্ত হূদ্যন্ত্রও এই গ্রন্থিসমূহের সক্রিয় সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত হয়ে রোগগ্রস্ত হয়ে যায়৷
১১) কোন জীবনীক্ষয়ী রোগে বা চিররোগে ন্তুড়ব্জপ্সুন্ন্তু স্তুন্ব্দন্দ্ব্ত্রব্দন্দ্ব অধিক দিন ভুগে রক্ত দুর্বল হয়ে পড়লে সেই রক্তের পুনরুজ্জীবনের জন্যে হূদ্যন্ত্রকে খুব বেশী পরিশ্রম করতে হয় বলে তা ক্রমশঃ দুর্বল হয়ে যায়৷ তাই দেখা যায় বেরিবেরি, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, মধুমেহ, প্রমেহ, উপদংশ বা স্ত্রী–ব্যাধিতে মানুষ যত বেশী দিন ধরে ভুগতে থাকে হূদযন্ত্রও ততই দুর্বল হতে থাকে ও এই হদ্যন্ত্রের চরম দুর্বল মুহূর্ত্তে তার ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায় ও রোগীর মৃত্যু ঘটে৷
চিকিৎসা
প্রাতে ঃ উৎক্ষেপ মুদ্রা (অধিক জলপান করা চলবে না), যোগমুদ্রা, দীর্ঘপ্রণাম, ভুজঙ্গাসন, বায়বী মুদ্রা বা বায়বী প্রাণায়াম৷
সন্ধ্যায় ঃ যোগমুদ্রা, দীর্ঘপ্রণাম, ভুজঙ্গাসন, পদহস্তাসন, বায়বী মুদ্রা বা বায়বী প্রাণায়াম৷
মনে রাখতে হবে রোগের বাড়াবাড়ি অবস্থায় এক মাত্র উৎক্ষেপ মুদ্রা ব্যতিরেকে আর কোন আসন, মুদ্রা করা চলবে না৷ রোগের প্রকোপ কিছুটা কমে যাবার পরেই তাই আসন, মুদ্রা গুলির অনুশীলন করতে হবে৷ রোগী মোটামুটি বিচারে সুস্থ হয়ে যাবার পরে পদহস্তাসনের পরিবর্তে কর্মাসন অভ্যাস করতে হবে৷
ব্যাপক স্নানবিধিও রোগীকে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে৷
পথ্য ঃ দুধ ও ফল এই রোগের একমাত্র খাদ্য ও পানীয় সকাল–বিকালের জলখাবার দুধ ও ফলেই সম্পন্ন করতে হবে৷ দ্বিপ্রহরেও কোষ্ঠপরিষ্কারক ও লঘুপাচ্য খাদ্য খুব অল্প পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে৷ ভাত বা রুটি বর্জন করতে পারলেই ভাল, অন্যথায় অল্প পরিমাণ সিদ্ধ চালের ভাত খাওয়া যেতে পারে৷ রাত্রির আহারে দুধ ও ফল ছাড়া আর কিছুই না থাকা উচিত৷ সূর্যাস্তের পর রোগী যেন কলা না খায়৷ দুধ যাদের সহ্য হয় না বা অন্য যে কোন কারণে দুধ সংগ্রহ করতে পারে না তারা দুধের পরিবর্ত্তে ঘোল ব্যবহার করতে পারে৷ পাতে খাবার জন্যে লবণ ব্যবহার করা রোগীর পক্ষে ক্ষতিকর৷ আহারান্তে কিছু সময় দক্ষিণ নাসায় শ্বাস বইয়ে রাখতে হবে৷
বিধিনিষেধ ঃ পাকস্থলীকে পরিষ্কার রাখা, রক্তের ক্ষার ভাগ বাড়ানো ও হূদ্যন্ত্রকে অতিরিক্ত পরিশ্রমের হাত থেকে রক্ষা করাই উচিত৷ রোগের বাড়াবাড়ি অবস্থায় সব সময় শবাসনে শুয়ে থাকা উচিত৷ এমনকি মলমূত্র ত্যাগ করার জন্যও শয্যা ত্যাগ করা উচিত নয়৷ রোগীর কখনই এক সঙ্গে অধিক পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ করা উচিত নয়৷ অর্থাৎ অল্প অল্প করে অনেকবার খাওয়া উচিত৷ রোগের বাড়াবাড়ি অবস্থায় কেবল মাত্র দুধ, ফলের রস (বিশেষ করে কমলা ও টমেটোর রস), দুধ–মধু বা জলমধু, পালং, কলমী, বেতো, পুনর্ণবা, শুশুনি বা শুলফা শাকের ক্কাথ ব্যতিরেকে আর কোন কিছুই খাওয়া উচিত নয়৷ পিপাসার সময় অল্প নেবুর রস মিশ্রিত জলই পান করা উচিত৷ দিবানিদ্রা, রাত্রি–জাগরণ, লোভের বশে উদর পূর্ণ করে’ খাওয়ার অভ্যাস রোগীর পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক৷ ভোজ বাড়ীতে সাধারণতঃ গুরুভোজন হয়ে থাকে৷ তাই ভোজবাড়ীতে না খাওয়াই উচিত৷ রোগীর রাত্রি ৮টা/৮–৩০র মধ্যেই শয়ন করা উচিত৷ মনে রাখা উচিত অল্প পরিমাণে পালং, বেতো, কলমী, শুল্ফা, শুশুনি বা পুনর্ণবা শাক ওই রোগে অত্যন্ত হিতকর৷ বড় এলাচও রোগমুক্তিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে৷ এই রোগীর কোষ্ঠ পরিষ্কারের দিকে অত্যন্ত নজর দিতে হবে রোগীর অন্ততঃ ৯ ঘণ্ঢা নিদ্রা যাওয়া প্রয়োজন৷ ক্রোধ ও কাম রিপু থেকে মনকে সর্বদা দূরে সরিয়ে রাখতে হবে৷ শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম, অতিকথন ও মৈথুন কঠোরভাবে পরিত্যজ্য৷
কয়েকটি ব্যবস্থা ঃ–
১) প্রত্যহ সকালে ও শয়নকালে মধুসহ এক চামচ বড় এলাচের গুঁড়া (খোসা সহ গুঁড়া) সেবন করলে ভাল ফল পাওয়া যায়৷
২) শুলফা শাকের ক্কাথ মধু মিশিয়ে পান করলে হূদ্রোগে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়৷
৩) দারুচীনী–চূর্ণ এক চামচ কিঞ্চিৎ মধু দু’বেলা সেবন করলে এই রোগে ভাল ফল পাওয়া যায়৷
৪) ভূমিকুষ্মাণ্ড–চূর্ণ এক আনা কিঞ্চিৎ মধু সহ দুই বেলা সেব্য৷
(যৌগিক চিকিৎসা ও দ্রব্যগুণ ঃ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার)