ঈৎর / আতর

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘কোরক’ শব্দের অপর অর্থ হ’ল গন্ধসার–ফার্সীতে ‘ঈৎর্’ (বাংলায় ‘আতর’ শব্দটি চলে)৷

গন্ধসার বা ঈৎর্ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে একটা কথা মনে পড়ে গেল৷ গন্ধসার ভারতের প্রাচীন জিনিস৷ প্রাচীন ভারতে মালাকাররাই ফুল থেকে এই জিনিসটি তৈরী করতেন৷ ফুলেল তেলও তাঁরাই তৈরী করতেন৷ ফুলেল তেল ও ফুলের তেলের তফাৎ তোমরা নিশ্চয় জান৷ ফুলের পাপড়ি চেঁচে অথবা ফুলের বীজ থেকে যে তেল পাওয়া যায় তাকে বলে ফুলের তেল৷ আর ফুলের গন্ধের নির্যাস তেলে মিশিয়ে দিয়ে (এ কাজে সাধারণতঃ তিলতৈল ব্যবহার করা হয় কারণ বাইরের গন্ধ আত্মসাৎ করবার শক্তি তিলতেলেরই সবচেয়ে বেশী) তাকে ফুলেল তেল বলা হয়৷  মালাকাররা ফুল ও শোলার চাষ করতেন, ফুল ও শোলার অলংকারও তৈরী করতেন, ফুল থেকে গন্ধসার ও ফুলেল তেলও তৈরী করতেন৷ সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতে চামেলী (জাতীফুল ও চামেলী একই গোষ্ঠীভুক্ত–তফাৎটা শুধু বর্ণগত), বেল, যুঁই (যুথিকা), চাঁপা (চম্পক) ফুলের নির্যাস থেকে ফুলের তেল ও ফুলের গন্ধসার তৈরী করা হত৷ কিন্তু গোলাপ থেকে নির্যাস (গোলাপ–জল) ও গোলাপের ঈৎর্ তৈরী করেছিলেন ভারত–সম্রাজ্ঞী নূর জাহাঁ যাঁর আসল নাম মেহেরউন্নিসা৷ তিনি ছিলেন পারস্য দেশীয় জনৈক ধনী ব্যবসায়ীর কন্যা৷ পরে ডাকাতের দ্বারা ইনি অপহৃতা হন ও ভারতে বিক্রীতা হন৷ এঁর বিবাহ হয়েছিল শের আফ্গানের সঙ্গে৷ শের আফ্গানকে কেউ কেউ বাংলার নবাব বলে অভিহিত করলেও এখন অনেকের মতেই তিনি বাংলার নবাব ছিলেন না.....ছিলেন সুবাদার৷ বর্ধমান ছিল এককালে মোগল যুগের গোড়ার দিকে বাংলার রাজধানী৷ শহরটির প্রাচীন নাম ছিল আস্তিকনগর (অত্থিনগর)৷ জৈন যুগে নাম হয় বর্দ্ধমান৷ ‘বর্ধমান’ নামটি দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত থাকে৷ পাঠান যুগের শেষ দিকে শহরটি যখন বাংলার রাজধানী হয় তখন তার নাম করে দেওয়া হয় ‘বার–এ–দীবান’৷ এই ‘বার–এ–দীবান’ থেকে ইংরেজীতে ভুল করে ‘Burdwan’  শব্দটি এসেছে৷ শহরের নাম যখন ‘বর্দ্ধমান’ তখন ইংরেজীতে বানান হওয়া উচিত Vardhamana৷ যাই হোক মেহেরউন্নিসার স্বামী শের আফগান ছিলেন এই বর্দ্ধমানের শাসনকর্ত্তা৷ আকবরের হিন্দু স্ত্রীর পুত্র সেলিম বিবাহ করতে চেয়েছিলেন এই অনিন্দ্যসুন্দরী মেহের–উন্নিসাকে কিন্তু আকবরের আপত্তিতে তা সম্ভব হয়নি৷ আকবরের মৃত্যুর পর সেলিম যখন জাহাঙ্গীর নাম নিয়ে দিল্লীর মসনদে বসলেন তিনি শের আফগানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন ও শের আফগানকে হত্যা করে মেহেরউন্নিসাকে দিল্লীতে নিয়ে গেলেন৷ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিবাহ হবার পরে মেহেরউন্নিসার নাম হ’ল নূরজাঁহা....জগজ্জ্যোতি৷ ‘জাহাঙ্গীর’ শব্দটার অর্থ কতকটা তাই.....বিশ্বের আলোক–স্তম্ভ৷

যাই হোক, এই নূরজাঁহা ছিলেন শৌখিন মহিলা৷ সেই সময় ভারতে ফুলের প্রাচুর্য ও প্রসিদ্ধি ছিল বটে কিন্তু গোলাপের প্রাচুর্য ও প্রসিদ্ধি ছিল কিনা.......রকমারি রঙের গোলাপ ছিল কিনা বলা শক্ত৷ তবে শাদা রঙের গোলাপ ছিল (বর্ত্তমান সংস্কৃতে ‘সীবন্তী’ শব্দের ভাবারূঢ়ার্থ হ’ল যা সেলাই করে তৈরী৷ গোলাপ দেখে মনে হয় এর পাপড়িগুলি যেন সেলাই করা রয়েছে৷ তাই তাকে ‘সীবন্তী’ বলা হয়)৷ পরবর্ত্তীকালে পারস্য থেকে রঙ–বেরঙের গোলাপের আমদানি হয় ভারতে৷ এ কাজে অগ্রণীর ভূমিকা নিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর ও নূরজাহাঁ৷

তাই ভারতে অন্যান্য ফুলের নির্যাস ও গন্ধসার তৈরীর ব্যবসায় প্রচলিত থাকলেও গোলাপ থেকে তা তৈরী করা হত না৷ নূরজাহাঁ তারই প্রবর্ত্তন করলেন৷ তিনি স্নান করতেন গোলাপের নির্যাসে, স্নানান্তে ব্যবহার করতেন গোলাপের গন্ধসার বা ঈৎর্৷

(শব্দ চয়নিকা, ৮/৮২)

কোণার্ক

কোণূর্ক > কোণার্ক৷ ‘অর্ক’ মানে সূর্য্য৷ ‘কোণার্ক’ শব্দের একটি অর্থ হ’ল সূর্য্যরশ্মি৷ ‘কোণার্ক’ শব্দের অপর অর্থ হ’ল সৌরকরের প্রতিফলন বা প্রতিবিম্বন৷ সমুদ্রতীরস্থিত সুপ্রসিদ্ধ ‘কোণার্ক’ মন্দিরটিও একটি সৌর মন্দির৷ ভারতের বিভিন্ন স্থানে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণেরা (কেউ কেউ শাকল দ্বীপীও বলেন৷ এঁরা আসলে দক্ষিণ রাশিয়ার স্যাকডোনিয়া অর্থাৎ শাকদ্বীপ–এর অধিবাসী ছিলেন৷ পরে ধর্মগত চাপে তাঁরা দেশত্যাগী হতে বাধ্য হন ও ভারতে আশ্রয় নেন) ছিলেন জ্যোতিষ চর্চাকারী৷ এঁরা একাধারে ছিলেন জ্যোতিষী ও জ্যোতির্বিদ৷ গ্রহদেবতা সূর্য্য ছিলেন এঁদের উপাস্য অর্থাৎ ধর্মমতে এঁরা ছিলেন সৌর৷ ভারতের যে সকল অঞ্চলে এককালে যথেষ্ট সংখ্যা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণেরা ছিলেন সেই সমস্ত অংশে আজও প্রাচীনকালের নির্মিত সূর্য্যমন্দির রয়ে গেছে৷ এঁরা যে অঞ্চল থেকে এসেছিলেন সে অঞ্চলের পোষাক ছিল ঢিলেঢালা পায়জামা......মাথায় ফেজটুপী......মানুষের হাতে থাকত তসবী বা জপমালা (Rosary)৷ তাই সূর্য্যমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত সূর্য্যমূর্ত্তিগুলির পোষাক হত এই ধরণের৷ ভারতের কোণার্ক মন্দিরের সংখ্যা খুব বেশী না হলেও খুব কমও নয়৷ এদের মধ্যে স্থাপত্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হ’ল উৎকলের কোণার্ক মন্দির ও প্রাচীনতায় ও বিভূষণে যতদূর মনে হয় সবচেয়ে আকর্ষক হচ্ছে কশ্মীর উপত্যকার অনন্তনাগ জেলার মার্তণ্ডমন্দির৷ মগধের গয়া জেলাতেও (বর্ত্তমানে সাবেকী গয়া জেলা ত্রিধাবিভক্ত) এই ধরণের সূর্য্যমন্দির রয়েছে৷ তার পাশেই শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণদের বাস৷

(শব্দ চয়নিকা, ৮/২৬)