জাতির নামে বজ্জাতি

লেখক
একর্ষি

(পূর্বপ্রকাশিতের পর )

কৃষ্ণের জন্মের মোটামুটি ৩০০ বছর পর, আনুমানিক ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এলেন এক ধর্মগুরু--- জেরোষ্টার৷ আর তাঁর ঈশ্বর ভাবনাকে বলা হয় জরোথ্রুসের ধর্মমত৷ জন্ম তাঁর উত্তর-পূর্ব পারস্য (বর্তমান ইরাণে)৷ পশ্চিমী পণ্ডিতেরা দাবী  করেন যে তিনিই নাকি পৃথিবীর আদি ধর্মগুরু, তাহলে ঐতিহাসিক পুরুষ শিব ও কৃষ্ণ গেলেন কোথায়? এসব ইয়ূরোপীয়দের প্রাচীনত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রচারের কারসাজি৷ যাইহোক, জোরোষ্টারের সমসাময়িক কালটা সম্বন্ধে কয়েকটা কথা ভাববার আছে৷ যথা

ক) এটা শিবের সময়ের সাড়ে তিন থেকে চার হাজার বছর পরের ঘটনা৷

খ) আর্যরা পারস্য আফগানিস্তান হয়েই ভারতে আসে৷ তৎকালীন...আফগানিস্তান ও রাশিয়ার কোন কোন অংশকে তৎকালীন জম্বুদ্বীপ বা প্রাচীন ভারতবর্ষের অঙ্গরূপে গ্রহণ  করা হোত৷

গ) জনশ্রুতি এই যে সদাশিব নাকি তাঁর বাহনে  (ষাঁড়ে) চড়ে সেই সময়ের এশিয়া, ইয়ূরেশিয়া-দক্ষিণভাগ, ইয়ূরোপের  আল্পস পর্বতের  পূর্বভাগ পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেছিলেন৷ অর্থাৎ সেই সময়ের  পৃথিবীর সভ্য মানুষের বসতি এলাকায় তাঁর যাতায়াত ছিল৷ ফলে ওই সব অঞ্চলে শৈবাদর্শ ছড়িয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক

ঘ) পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়--- জড়থ্রুসের ধর্ম ভাবনার ভিতটা শৈব, ব্যবহারিক অনুষ্ঠান বৈদিক সংস্কৃতি প্রভাবিত, আচার-বিচার পারস্যীয়৷

শিবের সময়ের প্রায় সাড়ে চার পাঁচ হাজার পরে এলেন গৌতম বুদ্ধ৷ তাঁর প্রবর্তিত  ধর্ম হল বৌদ্ধধর্ম৷ প্রায় একই সময়ে এলেন জৈনধর্মের শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর৷ তাঁর আগেই  এসে গেছেন তেইশ জন তীর্থঙ্কর (?)৷ বৈদিক ধর্মের প্রার্থনা ও আচার সর্বস্বতার বিরুদ্ধে ও ব্যবহারিক সুসংবদ্ধ শৈবধর্ম বদ্ধমূল সংস্কারের জালে আটকে যাওয়াতেই প্রতিবাদী ধর্মরূপে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান৷ এখানেও কয়েকটা জিনিস লক্ষ্যনীয়---

অ) উভয় ধর্মেই এ পর্যন্ত সাধনাবিজ্ঞান কিছুটা থাকলেও গোড়ার গলদটা পেয়ে বসল৷ এঁরাও আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতার আবিলতায় ঢাকা পড়ল৷ সাধারণ মানুষকে ধর্মসাধনাবিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত করল, আধ্যাত্মিকতা ব্যবহারিক জীবনের আড়ালে চলে গেল৷ আবার শৈবতন্ত্রের ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে তৈরী হইয়েছিল বৌদ্ধতন্ত্র, জৈনতন্ত্র--- আসলে সব একই তন্ত্র৷

আ) ধর্মগুরুদের তিরোধানের শতবর্ষ উদ্‌যাপন হতে না হতেই উভয় ধর্মই শতধা ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল৷ তাদের কে  মূলের সঙ্গে সূত্রবদ্ধ মেলানই দুষ্কর৷

ই) ধর্ম দ্বয়ের শুরুটা শৈবতন্ত্রকে আশ্রয় করে হলেও বৈদিক ধর্ম, ব্রাহ্মণ্যধর্ম, স্থানীয় কৌমধর্ম, অনেক লৌকিক ধর্ম ও পারস্পরিক প্রভাবে আচার-অনুষ্ঠানে, দেব-দেবী সৃষ্টিতে অনেক ভোল বদল করেছে৷ তাই বৌদ্ধ-জৈন দেব-দেবী সৃষ্টিতে, আচার অনুষ্ঠানে কার কতটা প্রভাব, কার থেকে কতটা নেয়া--- তা বের করাও অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার৷ মানুষের ধর্ম বৈশিষ্ট্য বা মানবধর্মের সঙ্গে এদের কোন সম্পর্কই নেই, মানুষের সাধন ভজন সংক্রান্ত মতামত মাত্র৷

সদাশিবের আবির্ভাবের অনুমানিক পাঁচ হাজার ও সাড়ে পাঁচ হাজার বছর পরে এলেন দুই সেমেটিক গোষ্ঠীভুক্ত আদি ইব্রাহিমের উত্তর পুরুষ--- ধর্মগুরু যীশুখ্রীষ্ট ও হজরত মহম্মদ৷ তাঁদের ধর্মমত খ্রীষ্টান ধর্ম ও ইসলাম ধর্ম৷ একই গোষ্ঠীভুক্ত হওয়ায় দুইয়ের মধ্য সাদৃশ্যও লক্ষ্যনীয়৷ আরো স্মরণীয়, অঞ্চলটি আগে থেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শৈবধর্ম চর্যিত অঞ্চল৷ পরে ভারত সম্রাট অশোকের সময় বৌদ্ধ ধর্মেরও প্রচার প্রসার হয়৷ কাজেই উভয়ই শৈবতন্ত্র আশ্রিত ধর্ম, যদিও সাধনাবিজ্ঞানের চর্চা ক্ষীণ, আচার-অনুষ্ঠান সর্বস্বতাই বিশেষত্ব, মানবধর্ম থেকে বহু দূরে এদের অবস্থান, নেহাতই ঈশ্বর সাধনা বিষয়ক  মতামত৷ তবে ভারত তথা বাঙলায় এই দুই ধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটে অনেক পরে৷

ভারতে তথা বাঙলায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের শেষের দিকে খ্রীষ্টীয় ২য়-৩য় শতক থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝে বৈদিক ধর্ম শিবকে আশ্রয় করে বিবর্তিত-রূপান্তরিত ও নানাভাগে বিভক্ত  হয়ে আত্মপ্রকাশ করে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকৃত পুরাণাশ্রয়ী পৌরাণিক ধর্ম৷ আবার সেই সময়ে পৌরাণিক ধর্ম ও বৌদ্ধ যোগাচার--- এই দু’য়ের মিশ্রণে নাথধর্ম নামে একটা মতবাদ এসেছিল৷ এতে শিবের আবেগ থাকলেও শৈবধর্ম বা পৌরাণিক শৈবাচারের কোন সম্পর্ক নেই৷ ভারতে সুলতানি যুগে শিখ ধর্মের উদ্ভব-একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা৷ পৌরাণিক বৈষ্ণবাচার চৈতন্যদেবের হাত ধরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম নামে প্রসার লাভ করে৷ উপধর্মের সংখ্যাও অগুনতি৷

প্রসঙ্গে  ক্রমে মনে রাখা দরকার যে ধর্ম আর রিলিজন’ সমার্থক নয়৷ রিলিজন এর প্রকৃত বাংলা প্রতিশব্দ ‘ধর্মমত৷ যাইহোক শৈবধর্মকে বাদ দিলে জগতে বৈদিক ধর্ম থেকে শুরু করে (হাজার হাজার বছর ধরে বিবর্তন হলেও আদির সঙ্গে অন্ত্যের মিল না থাকলেও পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম বৈদিকধর্ম--- অন্ততঃ দশ হাজার বছরের পুরানো, শুরুটা ভারতের বাইরে, পরিণত হয় অধ্যাত্মবিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে ভারতে) পৃথিবীর  সব রিলিজনেই বা ধর্মমতেই অবহেলকরা হয়েছে যে মানুষ একটা স্বতন্ত্র প্রজাতি (স্পিশীজ), ও তার একটা অন্যান্য জীব-প্রজাতি থেকে আলাদা সত্তাগত বৈশিষ্ট্য আছে৷ আর আগেই বলা হয়েছে যে ‘ধর্ম’ জিনিসটা হচ্ছে কোন সত্তার স্বভাবেরই সূক্ষ্মতর ক্ষেত্রে অনুশীলনের মাধ্যমে আনন্দভাবে স্থিতিলাভ বা স্থিতিলাভের চেষ্টা৷ শৈবধর্র্মেত্তর প্রচলিত ধর্মগুলোর সবের মধ্যেই তা অনুপস্থিত৷ ওগুলোকে মানুষের ধর্ম (প্রপার্টি বা ক্যার্যা কটারিসটিকস্‌) বলা যায় না ওগুলো আদতে ব্যাষ্টি বা গোষ্ঠী বিশেষের কিছু পাওয়ার জন্য ঈশ্বর-তুষ্টির  প্রার্থনা ও আচার-অনুষ্ঠান৷ সত্যি কথা বলতে গেলে তথাকথিত রিলিজন-এর জন্যে ধর্ম শব্দটা প্রায়ই আলগাভাবে ব্যবহার হয়ে থাকে৷ তার কারণ প্রায় প্রতিটি রিলিজনের প্রবর্ত্তকরা নিজেদের মতবাদকে , ঈশ্বরের বাণী আখ্যা দিয়ে জনসাধারণের কাছে পরিবেশন করে গেছেন৷ তাঁরা কেউই যুক্তি তর্কের  পথ মাড়ান নি৷ এর পিছনে তাঁদের উদ্দেশ্য যাই থাকুকনা কেন, মানুষ তার পরম সম্পদ বিচারশীলতাকে খুইয়ে বসেছিল--- সমস্যাটা এখানেই৷ (ক্রমশঃ)