তোমরা জান এমন কিছু কিছু জায়গা পৃথিবীতে রয়েছে যেখানে এককালে কোন বিশেষ মহান পুরুষ বাস করতেন অথবা যেখানে একাধিক মহাপুরুষের অবস্থিতি ছিল, যেখানে আজও লোকেরা শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান৷ যেমন ধরো মুঙ্গের শহরের কষ্টহারিণী ঘাটে মিথিলার নামজাদা কবি বিদ্যাপতির সঙ্গে বাঙলার নামজাদা কবি চণ্ডীদাসের সাক্ষাৎকার হয়েছিল৷ সেই কষ্টহারিণী ঘাটটি আজ যে কেবল ধর্মপিপাসু মানুষেরই তীর্থক্ষেত্র তাই নয়, সাহিত্যের ব্যাপারেও যাঁরা একটু–আধটু উঁকি–ঝুঁকি মারেন তাঁরাও স্থানটিকে একবার দেখে যান......শোনা যায় সাক্ষাৎকারের সময় চণ্ডীদাস ছিলেন যুবক, বিদ্যাপতি ছিলেন বৃদ্ধ৷ উভয়ের মধ্যে বয়সের পার্থক্য ছিল অনুমানিক চল্লিশ বৎসর৷ বিদ্যাপতি ছিলেন বিস্পী (বিসর্পীঃ বর্ত্তমান মধুবনী জেলায়) গ্রামের অধিবাসী৷ গঙ্গাস্নান করতে তিনি খুৰ ভালবাসতেন৷ তাই তিনি মিথিলার সিমারিয়া ঘাটে (প্রাক্তন মুঙ্গের জেলায় ও অতি আধুনিক কালে নবগঠিত বেগুসরাই জেলায়) স্নান করতে আসতেন৷ কবি বিদ্যাপতির নাম–যশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় চণ্ডীদাস নৌকাযোগে গঙ্গা পার হয়ে মুঙ্গের শহরে কষ্টহারিণী ঘাটে আসেন৷ কাশী পার হবার পর গঙ্গা পূর্ববাহিনী অর্থাৎ পশ্চিম দিক থেকে পূর্বে চলেছে৷ আর সাহেবগঞ্জের পর থেকে গঙ্গা দক্ষিণবাহিনী৷ গঙ্গা যতক্ষণ পূর্ববাহিনী ততক্ষণ গঙ্গার উত্তরে থাকে কাশীরাজ্য, মিথিলা ও অঙ্গদেশ৷ কিন্তু গঙ্গা যখন দক্ষিণাভিমুখী তখন গঙ্গার পশ্চিমে এসে যায় রাঢ় ও পূর্বে এসে যায় বরেন্দ্র ও সমতট৷
যাই হোক এই যে চণ্ডীদাসের কথা বলছি তিনি ছিলেন রাঢ়ের বর্জ্যভূমি বা বীরভূমের নানুর গ্রামের কবি৷ তিনি ছিলেন রাঢ়ের বর্জ্যভূমি বা বীরভূমের নানুর গ্রামের কবি৷ তিনি ছিলেন দুর্গাদাস বাগচীর পুত্র (বরেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ)৷ চণ্ডীদাস বাগচী তাঁর সাহিত্য–ভণিতায় নিজের নাম রেখেছিলেন দ্বিজ চণ্ডীদাস৷ বাঙলায় মোটামুটি নাম–করা আরও দু’জন চণ্ডীদাস ছিলেন৷ একজন ছিলেন বাঁকুড়ার ছাতনার (মতান্তরে মানভূমের হুড়া থানায়) চণ্ডীদাস পাণিগ্রাহী (তিনি ছিলেন উৎকল শ্রেণীর ব্রাহ্মণ)৷ সাহিত্য–ভণিতায় তিনি নিজেকে বড়ু চণ্ডীদাস নামে পরিচিত করেন৷ আধুনিক বাঙলা ভাষায় লিখিত সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন’ তাঁরই রচিত৷ তবে সাহিত্য কৃতিতে অথবা সাহিত্য কীর্ত্তিতে দ্বিজ চণ্ডীদাসের নামই বেশী জেল্লাদার৷ বাঙলার সাহিত্যাকাশে আরও একজন চণ্ডীদাস ছিলেন–তিনি চণ্ডীদাস ভট্টাচার্য্য–বর্দ্ধমান জেলার পশ্চিমাংশের অধিবাসী৷ তিনি সাহিত্য–ভণিতায় নিজেকে দীন চণ্ডীদাস নামে আখ্যাত করেন৷
আসল কথায় আসা যাক৷ এই দ্বিজ চণ্ডীদাস রাঢ়ের বন্ধুর উপত্যকা পেরিয়ে এসেছিলেন মুঙ্গের শহরে৷ বাঙলায়–মিথিলায় তখন সুর বংশের রাজত্ব শেষ হয়ে সেন রাজত্ব সবে শুরু হয়েছে৷ পণ্ডিতেরা বাংলায় সাহিত্যকর্ম না করে সংস্কৃতে করাই তখনও বেশী পছন্দ করে চলেছেন৷ সেই সময়কার কবি জয়দেব পমার বাঙলায় সাহিত্য চর্চা না করে সংস্কৃতেই সাহিত্য চর্চা করে গেছেন৷ সম্ভবতঃ তিনিই রাঢ়ের শেষ বনেদী সংস্কৃতে সাহিত্যসেবী ছিলেন৷ তাঁর রচনার ভাষা সরল সংস্কৃত–ৰৌদ্ধ মহাযানী সংস্কৃতের অনুরূপ অর্থাৎ সংক্ষেপে অনুস্বার–বিসর্গযুক্ত্ বাংলা৷
কবি জয়দেবের সময় তথা চণ্ডীদাসের সময় রাঢ়–বাঙলায় কেন্দুবৃক্ষের (ছোটগাব) জঙ্গল ছিল.........ছিল বুনো বেলেরও৷ তবু কতকটা এই রকমের অবস্থা রাঢ়ের পার্শ্ববর্ত্তী মগধ, কৌশল, উৎকলেরও ছিল৷ তাই এই তিন দেশেই ‘কেন্দুবিল্ব’ নামে একাধিক গ্রাম ছিল৷ কবি জয়দেবের গ্রাম যে কেন্দুবিল্বে ছিল, তা ছিল অজয় নদীর উত্তরপাড়ে–বর্দ্ধমান জেলার ঠিক বিপরীত দিকে৷ জয়দেব সংস্কৃতের কবি ছিলেন বটে কিন্তু তাঁর সংস্কৃত এতই সহজ বোধ্য ছিল যে তিনি রাঢ়ের মানুষের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন৷ তাঁর গ্রামটিকে অশিক্ষিত গ্রাম্য লোক আজও বলেন ‘জয়দেব–কেঁদুলি’৷ সুপ্রাচীনকাল থেকে সেখানে যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, গ্রামের মানুষ আজও তাকে জয়দেব–কেন্দুলির মেলা বলে থাকেন৷
জয়দেবের সঙ্গে বিদ্যাপতির সাক্ষাতের কোন নজির বা দন্তকথা প্রচলিত নেই যদিও কবি বিদ্যাপতি কেবল মৈথিলীতেই নয়, সংস্কৃতেও অনেক কিছু লিখে গেছেন৷ সংস্কৃতে রচিত ‘দুর্গাভক্তি–তরঙ্গিনী’ গ্রন্থটিও তাঁরই সাহিত্যকৃতি৷
এখন মূল বক্তব্যে ফিরে আসা যাক্৷ মুঙ্গেরের এই কষ্টহারিণী ঘাটে গঙ্গা উত্তরবাহিনী, অথচ তার পূর্বে বা পশ্চিমে গঙ্গা পূর্ববাহিনী৷ গঙ্গা এখানে উত্তর বাহিনী হওয়ায় গঙ্গা–ভক্তসমাজে এর একটা বিশেষ মাহাত্ম্য ছিল৷ তাই সম্ভবতঃ এখানে বাঙলার কবি চণ্ডীদাসের সঙ্গে মিথিলার কবি বিদ্যাপতির সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়েছিল৷ এই ধরণের যেসব বিশেষ স্থানে নামজাদা মানুষেরা একত্রিত হন লোকে সেই স্থানগুলিকে মনে রাখেন৷ যেমন রাণাঘাট শহরের উত্তরের দিকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তৎকালীণ ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট নবীনচন্দ্র সেনের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার হয়েছিল (নবীনচন্দ্র সেন ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার নোয়াপাড়া গ্রামের অধিবাসী) যেমন হয়েছিল রাজশাহীতে সেখানকার উকিল লব্ধপ্রতিষ্ঠ কবি রজনীকান্ত সেনের (কান্তকবি) সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের৷ রজনীকান্ত সেন ছিলেন পাবনা জেলার ‘ভাঙ্গাবাড়ী’ গ্রামের বাসিন্দা৷ রাজশাহীতে তিনি ওকালতি করতেন৷ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রীতির বন্ধন এতই গভীর ছিল যে শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ রাজশাহীতে তাঁর বাড়ীতে যেতেন৷ কান্তকবি নাকি–একবার রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন–আপনি কোমল ভাবের কবিতা তো অনেক লিখেছেন, এবার বীর রসের কিছু লিখুন৷ রবীন্দ্রনাথ তার পরের দিনই সন্ধ্যাবেলায় কান্তকবিকে সেই সুপ্রসিদ্ধ কবিতাটি শুণিয়ে দেন যা আজও অনেকের মুখে মুখে ফেরে–
‘‘পঞ্চনদীর তীরে বেণী পাকাইয়া শিরে
................................... নির্মম, নির্ভীক৷’’
এই ধরণের মহান পুরুষদের সাক্ষাৎকারের স্থানগুলির জন্যেও তোমরা ‘কোটী’ শব্দ ব্যবহার করতে পার৷ (‘কোটী’ মানে পূতভুমি
– শব্দ চয়নিকা, ৭/২১০)