কলকাতার কাহিনী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

ইংরেজরা যখন এই দেশ দখল করেন তখন কলকাতা ছিল সুন্দরবনের উত্তর প্রত্যন্ত অংশ৷ মারাঠা আক্রমণের হাত থেকে কলকাতাকে বাঁচানোর জন্যে ইংরেজরা কলকাতার উত্তর–পূর্ব দিকে একটা খাল কেটেছিলেন যা ‘মারাঠা ডিচ্’ নামে পরিচিত৷ এই মারাঠা ডিচের সঙ্গে টলী সাহেব আদি গঙ্গাকে সংযুক্ত করে দেন৷ প্রাচীনকালে এই আদি গঙ্গা ছিল গঙ্গার মূল প্রবাহ ও সে বহে চলত বারুইপুরের মহাপ্রভুডাঙ্গার পাশ দিয়ে ছত্রশালের দিকে৷ মহাপ্রভু খড়দায় ভাগীরথীকে ডান হাতে রেখে বারুইপুরে বর্তমান মহাপ্রভুডাঙ্গায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ছত্রশালের কাছে গঙ্গা পার হয়ে পৌঁছুতেন শ্যামপুর৷ তারপর গোপীবল্লভপুরের পথ ধরে যেতেন পুরীর দিকে৷ এই টলী সাহেবের নামেই খালের এই অংশ, এমনকি আংশিকভাবে আদি গঙ্গাও ‘টলী নালা’ নামে পরিচিত৷ ঝোপ–জঙ্গল–মশায় ভর্তি, নোনা জলের অস্বাস্থ্যকর এলাকা৷ চাষবাসও ভাল রকম চলত না৷ পরে যখন নতুন জনপদের পত্তন হ’ল তখন এর নাম দেওয়া হ’ল টালীগঞ্জ৷ বেহালা ও বরিষার মত প্রাচীনত্বের কোন গৌরব এর নেই৷

বাঙলার মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের গা ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য খাড়ি৷ এগুলো সবই নোনা জলে ভর্ত্তি ও হিংস্র কুমীরের বাসস্থান৷ এই হিংস্র কুমীরকে ইংরেজীতে বলে ‘ক্রোকোডাইল গ্যাঞ্চেলাইটিস্’৷ এরা এ্যালিগেটর জাতীয় কুমীর নয়৷ এ্যালিগেটর জাতীয় কুমীর পৃথিবীর বিভিন্ন বিষুবরেখীয়, কর্কটক্রান্তীয় ও মকরক্রান্তীয় এলাকায় বাস করলেও তাদের মুখ্য বাসভূমি ব্রেজিলের আমাজন অববাহিকা অর্থাৎ এরা গ্যাঞ্জেলাইটিস নয়–আমাজনিকা৷ এককালে রূপনারায়ণ অববাহিকায় শ্যামপুর, বাগনান, গেঁয়োখালি*(প্রাচীন নাম জীবনখালি বা জাহ্ণবীখালি৷ মহিষাদলের রাণী জাহ্ণবীদেবীর নামে সম্ভবতঃ জাহ্ণবীখালি নাম হয়েছিল৷ জাহ্ণবী দেবী মারাঠা নৌ–সেনার হাত থেকে মহিষাদলকে বাঁচাবার জন্যে ব্যণ্ডেল বা বোনাডেল থেকে–পোর্তুগীজ ভাষায় যার মানে সুন্দর গ্রাম–কিছু সুদক্ষ পোর্তুগীজ নৌ–সেনা এনে নিজের জমিদারী মির্জাপুর গ্রামে বসবাস করান৷ সেদিনের সেই পোর্তুগীজদের উত্তর পুরুষেরা আজ ক্ষাঙালী খ্রীষ্টানদের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে৷ ছেলের নাম সুনীলকুমার, মেয়ের নাম সৌদামিনী বিয়েতে পাকা দেখা হয়৷) প্রভৃতি অঞ্চল, বিশেষ করে শীতকালে রূপনারায়ণের চড়ায় এই ক্রোকোডাইল গ্যাঞ্চেলাইটিস্ প্রজাতির কুমীর প্রচুর সংখ্যায় দেখা যেত৷ শীতকালের দুপুরে এরা নদীর চড়ায় হাঁ করে শুয়ে থাকত আর ছোট ছোট পাখীরা এদের মুখের মধ্যে ঢুকে দাঁতে আটকে থাকা মাংসের টুকুরো খুঁটে খুঁটে খেত৷ কুমীরে–পাখীতে প্রত্যুতপকারের আর পারস্পরিক স্বার্থ সাধনের একটি অলিখিত সন্ধি থাকত৷ কুমীরের দাঁত পরিষ্কার হয়ে যেত, পাখীদের খাদ্য জুটত৷ মুখে পাখী থাকলে কুমীর মুখ বন্ধ করত না৷

তখন রূপনারায়ণ ছিল প্রকাণ্ড নদী৷ বর্ষার ইলীশ আর শীতে তপ্সে (এই মাছের মুখে সামনের দিকে দাড়ির মত একটু থাকায় সংস্কৃত নাম ‘তপস্বী’ মাছ৷ তার থেকে বাংলায় ‘তপ্সে’ মাছ) মাছের ভীড়৷ ‘ইলীশ’ শব্দটির মানে হ’ল তেলাল বা চক্চকে৷ কথ্য বাংলায় কোথাও কোথাও ইলশা বা ইলশে বলা হয়৷ তবে শব্দটি প্রাকৃত–সঞ্চাত৷ ইলীশ যদি তার স্বাদ হারিয়ে ফেলে তখন তাকে বলা হয় বীলীশ (বি–ইলীশ)৷ সমুদ্রের বানে অথবা গঙ্গার বন্যায় ইলীশ যদি মূল নদী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারও পুকুর–ডোবায় এসে পড়ত তবে তারা আকারে বড় হত ঠিকই কিন্তু তৈলাংশ কমে যাওয়ায় স্বাদ কমে যেত৷ সাধারণের কাছে সেই ইলীশ বীলীশ নামে পরিচিত হ’ত৷

ইংরেজরা এদেশে এসে প্রথম দফায় নবাবের কাছ থেকে ২৭০০ টাকায় (এই নিয়ে মতভেদ আছে৷ কারও কারও মতে বাড়তি কয়েক শ’ টাকা সেলামী হিসেবে দিতে হয়েছিল) কালীঘাট, সুতানুটি, গোবিন্দপুর নামে যে তিনটি গ্রামের বন্দোবস্ত নেন তাদের মধ্যে সুতানুটি ছিল উত্তর দিকে তন্তুজীবীদের গ্রাম৷ তাদের কাজ কারবার ছিল সুতো আর নুটি (ইংরেজীতে ‘ববিন’) নিয়ে৷ তাই স্বাভাবিক নিয়মে গ্রামটির নাম হয়েছিল ‘সুতোনুটি’৷ এখন যেটা দক্ষিণ–ঘেঁষা মধ্য কলকাতায় ডালহৌসী স্কোয়ার*(বর্তমান নাম বি.বা.দী. বাগ৷ এখানেও ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে৷ যে তিন বীর সন্তানের নামে বি.বা.দী. বাগ নাম রাখা হয়েছে তাদের নামে নোতুন কোন কিছু তৈরী করে দিলে বেশী ভাল হ’ত না কি? লর্ড ডালহৌসী ছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মূর্ত প্রতীক৷ তবুও ভারতের ইতিহাস থেকে তো তাঁকে মুছে ফেলা যায় না৷ শব্দটিকে আমরা উচ্চারণ করি ডালহৌসী কিন্তু ইংরেজীতে এর শুদ্ধ উচ্চারণ হবে ‘ডালউজী’, যেমন ইংরেজীতে বানানটা Dal-oozee¼— থেকে গড়ের মাঠের দক্ষিণ প্রত্যন্ত সেটাই ছিল গোবিন্দপুর৷ সম্ভবতঃ জমিদার গোবিন্দরাম বসুর নাম থেকেই গোবিন্দপুর নাম এসেছিল৷ গোবিন্দপুরের দক্ষিণে ছিল কালীঘাট৷ বলাই হয়েছে সুতানুটি ছিল মুখ্যতঃ তন্তুজীবীদের বাস৷ কলকাতার সুপ্রাচীন বাসিন্দা তন্তুবণিকেরা মুখ্যতঃ সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের মাঝামাঝি জায়গায়* (এখন বড়বাজার নামে পরিচিত, আসলে তার সাবেকী নাম বুড়াবাজার–সেখানকার বুড়ো শিবের নাম থেকে৷ স্থানটি সম্ভবতঃ বড়িষার সাবর্ণ চৌধুরীদের মালিকানায় ছিল৷ এঁরাই ছিলেন বড়বাজারের শেঠদের আদিপুরুষ৷) বাস করতেন৷ সুতানুটিরই গঙ্গার ধার–ঘেষাঁ এলাকা থেকে শুরু করে দক্ষিণ বরাবর কালীঘাটের পশ্চিমে গঙ্গার তীর পর্যন্ত ছিল মৎস্যজীবীদের বাস বা জেলেপাড়া৷ এই জেলেপাড়া সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কালীঘাট তিন মৌজাতেই বিভক্ত ছিল৷ আমাদের মনে রাখা দরকার, শুধু গোবিন্দপুর, কালীঘাট ও সুতানুটি নিয়েই কলকাতা শহর তৈরী হয়েছিল বলে যে শোণা যায় তা’ ঠিক নয়৷ এই তিনটি গ্রামের উত্তরে  ও পূর্বে এক বৃহৎ অংশে মুখ্যতঃ আরও সাতাশটি ও গৌণতঃ পঁয়ত্রিশটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহরের পত্তন হয়৷ পটোলডাঙ্গা, ডিহি, হেঁতালি (এন্টালি), চিত্রপুর (চিতপুর), হোগলকুঁড়ে, পটুয়াপাড়া, বাগমারী, মোগলবাগান, বেলেঘাটা, তালতলা প্রভৃতি গ্রামগুলিও কলকাতার অংশ হয়ে দাঁড়ায়৷ গরাণহাটা, আহিরিটোলা, মোহনবাগান, হর্তুকিবাগান, হালসিবাগান, হাটখোলা, কুমারটুলী, শোভাবাজার প্রভৃতি পাড়াগুলি কিছুটা পরবর্তীকালের৷ তবে এরাও খুব নতুন নয়৷

দক্ষিণে কালীঘাট ছিল একটি মন্দির–কেন্দ্রিক ছোট্ট গ্রাম৷ এখানে অল্প কয়েক ঘর ব্রাহ্মণ ও পটুয়াদের (পটুয়া বা চিত্রশিল্পী) বসবাস ছিল৷ এই পটুয়ারাই সুবিখ্যাত কালীঘাটের পটের শিল্পী৷ এই কালীঘাটের পট শিল্পকে ধ্রুপদী মর্যাদা দিয়ে গেছেন বাঁকুড়ার বেলেতোড় নিবাসী যামিনীরঞ্জন রায়৷ কালীঘাটের পটশিল্প কত দিনের পুরোনো তার কোন লিখিত ইতিহাস নেই৷ তবে পাঠান আমলের গোড়ার দিকেও এখানে পটুয়াদের বসবাস ছিল৷ সেকালের ক্ষাঙলার লোক হাটে গিয়ে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে পটও কিনে আনত৷ বিশেষ করে নানান ধরনের হিন্দু দেবদেবীর পটেরই বিক্রিবাটা বেশী হ’ত৷ যেসব মেয়েরা বারমেসে লক্ষ্মী পূজো করতেন তাঁরা পটেতেই তা’ করতেন৷ পাঠান আমলে যখন দুর্গাপুজোর প্রবর্তন হয় তখন মূর্তি গড়ে দূর্গাপূজো করতেন কেবল জমিদারেরাই৷ আর যে সকল মধ্যবিত্ত মানুষ বাড়ীতে দুর্গাপূজো করতেন তাঁরা পটেতেই করতেন৷ যাদের পট কেনার সামর্থ্য ছিল না তাঁরা তা করতেন ঘটে৷ আজ থেকে আনুমানিক একশ’ বছর আগেও সরস্বতী পূজো মুখ্যতঃ ঘটেতেই করা হ’ত৷ পরে সাহেবরা উৎসাহ দিয়ে সরস্বতীর মূর্তিপূজা প্রবর্তন করেন৷

কালীঘাটের মন্দিরটি অনেকবারই ভাঙ্গাগড়ার মধ্য দিয়ে গেছে৷ শেষের দিকে বড় মন্দিরটি তৈরী করে দেন বড়িষার সাবর্ণ চৌধুরীরা৷ যশোরের জগন্নাথপুর এলাকা থেকে কুশারী গাঞি–এর কিছু রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ এসে জেলেপাড়ার মাঝামাঝি অংশে গঙ্গার তীর ঘেঁষে বসবাস করতে শুরু করেন৷ এঁরাই হলেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত পাথুরেঘাটা ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ৷ জেলেরা এঁদের সম্মানে ‘ঠাকুর’ নামে সম্বোধন করত৷ সেই থেকে এঁরা ঠাকুর নামে প্রসিদ্ধ৷

সেকালের কায়স্থরা থাকতেন গোবিন্দপুর এলাকায়৷ পরে যখন রাঢ় অঞ্চলের ওপর মারাঠা বর্গীদের আক্রমণ হয় তখন মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও দুমকা জেলার অবস্থাবান কায়স্থরা চলে যান ভাগলপুর জেলার দত্তবাটির দত্ত জমিদারদের, চম্পানগরের ঘোষ মহাশয়দের ও ঝউয়াকুঠির ঘোষ জমিদারদের আশ্রয়ে৷ তাঁরা বসবাস করতে শুরু করলেন ভাগলপুর, মুঙ্গের জেলার শতাধিক গ্রামে৷ ঘোষ, মিত্র, দত্ত, দাস ও সিংহ পদবীধারী রাঢ়ীয় কায়স্থদের উত্তর পুরুষেরা এখনও সেখানে রয়েছেন৷ ওঁরা ওঁদের সঙ্গে নিজেদের রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ পুরোহিতদেরও নিয়ে যান৷ আবার মারাঠা বর্গীদের আগমণের সময় বাঁকুড়া, বর্ধমান, হাওড়া ও হুগলী অঞ্চলের অবস্থাপন্ন কায়স্থেরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ইংরেজদের এই কুঠি শহর কলকাতায় চলে আসেন৷ এঁরা কিন্তু যে–কোন কারণে হোক, গোবিন্দপুরে বসবাস করেন নি৷ এঁরা এলেন হাটখোলা, শোভাবাজার, শ্যামবাজার, শ্যামপুকুর, কম্বুলেটোলা, কুমুরটুলী, চিৎপুর প্রভৃতি অঞ্চলে৷

সপ্তগ্রাম বন্দরের পতনের পর সেখানকার গন্ধবণিক ও সুবর্ণক্ষণিকেরা চলে এলেন মুখ্যতঃ চুঁচড়োয় ও গৌণতঃ ভাগীরথীর তীরের অন্যান্য শহরগুলিতে৷ কলকাতায় যখন ইংরেজদের ব্যবসা জমে উঠল তখন চুঁচড়োর সুবর্ণবণিকেরা অনেকে চলে এলেন কলকাতায়৷ তাঁরা বাস করতে লাগলেন শহরের ভাগীরথীর কোলঘেঁষা পশ্চিমাঞ্চলে৷ কলকাতার ব্যবসা তখন ভাগীরথী দিয়ে মুখ্যতঃ নদীপথে চলত৷ সেকালকার চুঁচড়োর নামজাদা মানুষ ছিলেন গৌরী সেন৷ তাঁর অর্থপ্রাচুর্যের, দরাজদিল্ ও দরাজহস্তের খ্যাতি তখন দেশজোড়া৷ এখনও লোকে বলে থাকে ‘‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’’৷ এই মৎস্যজীবী, পিরালী ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, তন্তুবায়, তন্তুবণিক ও সুবর্ণবণিকেরাই ছিলেন কলকাতার সাবেকী বাসিন্দা৷ 

(ক্রমশঃ)