কোদণ্ড ঃ কঃ+দণ্ড = কোদণ্ড, যার ভাবাঢ়ার্থ হ’ল জলের বা মাটির সঙ্গে সংযোগরক্ষাকারী দণ্ড৷ প্রাচীন সংস্কৃতে ‘ক’ শব্দের একটি অর্থ ছিল ধনুকের ছিলা, চাক বা চাপ যা সেই ছিলার সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলত৷ তাই ধনুকের চাক (চক্র বা arc)–কে বলা হ’ত কোদণ্ড৷
প্রাচীন মহাযানী বৌদ্ধ ও পৌরাণিক হিন্দুদের যে সকল দেবতার সঙ্গে ধনুক থাকত তাদেরও কাউকে কাউকে চাপধারী বা কোদণ্ডধারী বলা হত৷ শিবের সম্বন্ধেও বলা হ’ত ‘‘কোদণ্ডদণ্ডপাশহস্ত্’’৷ বামাচারী তান্ত্রিক দেবী তথা বৌদ্ধতন্ত্রে স্বীকৃতা ষোড়শী বা রাজরাজেশ্বরী সম্বন্ধে (আধুনিক যুগের জগদ্ধাত্রী এরই একটি বিবর্ত্তিত রূপ৷ জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাস একটু পরে বলছি) বলা হয়েছে–‘‘পাশাঙ্কুশচাপধারিণী শিবা’’৷
জগদ্ধাত্রী পূজা সম্বন্ধে এই প্রসঙ্গে দু’চারটে কথা বলছি৷ তোমরা নিশ্চয়ই জান যে দুর্গাপূজা কোন প্রাচীন পূজা নয়৷ এমন কি, মুখ্যতঃ যে পুরাণের ওপর দুর্গাপূজা নির্ভরশীল সেই মার্কণ্ডেয় পুরাণও বৌদ্ধোত্তর যুগের৷ এ ই মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে নির্বাচিত ৭০০ শ্লোককে বলা হয় দুর্গাসপ্তশতী বা শ্রীশ্রীচণ্ডী৷ অন্যান্য যে সকল গ্রন্থের ওপর নির্ভর করে বিশেষ বিশেষ স্থানে দুর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হয় সেগুলি হচ্ছে দেবীপূরাণ ও দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী৷ এরা কেউই ১৫০০ বছরের চেয়ে পুরোণো পুস্তক নয়৷ আর বলা বাহুল্য যে পাঠানযুগের পূর্বে বিভিন্ন শাস্ত্রে উল্লিখিত দুর্গা ছিল অষ্টভূজা৷ দশভূজা বা বাংলার এই শরৎকালীণ পূজার প্রবর্তন করেন বরেন্দ্রভূমির রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায় (সম্ভবতঃ আসল পদবী ছিল ‘স্যান্ন্যাল’)৷ শরৎকালীন সেই দুর্গাপূজা বাংলায় অল্পকালের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে–প্রথমে তৎকালীন জমীদারদের মধ্যে, তারপর অন্যান্যদের মধ্যে৷ শেষ পর্যন্ত জিনিসটা হয়ে দাঁড়ায় টাকার খেলার প্রতিযোগিতা৷ তাহেরপুরের জমীদার কংসনারায়ণ দুর্গাপূজায় খরচ করেছিলেন সাত লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা৷ পরবর্ত্তীকালে একটাকিয়ার রাজা জগৎ–নারায়ণ খরচ করেন সাড়ে আট লাখ টাকা৷ বলা বাহুল্য মাত্র, সেকালের নামী জমীদারী নদীয়া এষ্টেটের রাজারাও দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন খুব ধুমধাম করে৷ ধর্মগত বিশ্বাসে তাঁরা ছিলেন শাক্ত (নদীয়া কিন্তু বৈষ্ণব–ধর্মের বন্যাতেই ভেসে ছিল)৷
‘‘নাটোরের দানখয়রাৎ
কাসিমবাজারের দীপ্তি৷
বর্ধমানের দেবোত্তর নদীয়ায় কীর্তি৷৷’’
সুতরাং কীর্ত্তিমান নদীয়ার রাজারা বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজা করতে লাগলেন৷ একবার আশ্বিনের কিস্তিতে মালগুজারীর টাকা বাকী পড়ায় বাংলার নবাব কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করেন৷ দুর্গাপূজার সময় তাঁকে আটকে থাকতে হ’ল মুর্শিদাবাদের কারাগারে৷ মালগুজারীর বকায়া (এই থেকে বাংলায় ‘বকেয়া’ শব্দ এসেছে) রাখা জমীদারদের শাঈস্তা করবার জন্যে মুর্শিদাবাদের নবাব যে বিশেষ ধরণের কারাগার তৈরী করেছিলেন জমীদারদের ক্লেশ দেবার জন্যে সেটির নাম ছিল বৈকুণ্ঠ৷ দুর্গাপূজার সময় রাজা থেকে গেলেন সেই বৈকুণ্ঠে৷ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ফিরে এলেন কোজাগরী পূর্ণিমার পরে৷ তখন তো আর নূতন করে দুর্গাপূজা করা যায় না৷ তিনি বললেন, স্বপ্ণে তিনি এক দেবীমূর্ত্তি দেখেছেন৷ রাজার মুখ থেকে যে বর্ণনা পাওয়া গেল তা তন্ত্রোক্ত রাজরাজেশ্বরী বা ষোড়শীদেবীর সঙ্গে মেলে যা হিন্দু ও মহাযানী বৌদ্ধ উভয় তন্ত্রেই স্বীকৃতা৷ তখন তিনি ঘটা করে এই পূজো করলেন–দেবীর নাম রাখলেন জগদ্ধাত্রী৷ পূজোটি অনুষ্ঠিত হ’ল দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবার ঠিক এক মাস পরের শুক্লপক্ষে৷ কিন্তু সময় অল্প থাকায় দেবীপক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পূজা একসঙ্গে নবমীতে সারা হল৷ দুর্গাপূজা যেখানে পাঁচ দিনের, জগদ্ধাত্রী পূজো সেখানে দু’দিনের৷ তোমরা ডি. এল রায়ের ‘ যেদিন সুনীল জলধি হইতে’ কবিতাটিতে ‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দের উল্লেখ পেয়েছ (‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে জগতের যিনি ধাত্রী (care taker— কিন্তু ডি.এল. রায় ‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সম্ভবতঃ তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা এই কারণে৷ তাছাড়া তাঁর পিতা কার্ত্তিকেয় চন্দ্র রায় ছিলেন নদীয়া এষ্টেটের দীবান৷ যাই হোক, কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজোর এই ধূমধাম দেখে সেই সময়কার নদীয়া এষ্টেটের দীবান সম্ভবতঃ গঙ্গাগোবিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের শহর চন্দননগরে এই পূজোর প্রবর্ত্তন করেন৷ তবে কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজোর বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে কৃষ্ণনগরের পূজোর সংখ্যা ছিল বেশী, জাঁকজমকও বেশী, কিন্তু চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী ছিল অতি বৃহদাকারের৷ এটাই চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীর মুখ্য বৈশিষ্ট্য৷ যাই হোক, দুর্গাপূজা যেমন প্রাচীন নয়, পাঠান আমলের পূর্বার্ধের জিনিস তেমনি জগদ্ধাত্রী পূজাও বাংলার নবাবী আমলের অন্তিম কালের৷ এই ষোড়শীর হাতে চাপ থাকায় বলা হত ‘‘পাশাঙ্কুশচাপধারিণী শিবা’’৷
(শব্দ চয়নিকা, ৮/২৯)