কর্ষকদের দুর্দশা

সম্প্রতি রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় শিলাবৃষ্টির ফলে ধান, আম প্রভৃতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ বর্ধমানের এক চাষীভাই জানালো, এ বছর গ্রীষ্মের ধান খুব ভাল হয়েছিল৷ কিন্তু  শিলাবৃষ্টির ও অতি বর্ষণের ফলে প্রায় সম্পূর্ণ ধানই ঝরে গেছে৷ মালদার আম চাষীদেরও মাথায় হাত ৷ মানিকচক ও রতুয়া ব্লক থেকে সংবাদ এসেছে সম্প্রতি প্রবল শিলাবৃষ্টির ফলে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে৷ শিল লেগে আম কালো হয়ে গেছে ও ধীরে ধীরে এগুলির ভেতরে পচন দেখা দিচ্ছে৷ এই জেলার মূল অর্থনীতি আমের  ওপর নির্ভরশীল৷ মালদার আম বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান, মালয়েশিয়া, প্রভৃতি দেশে রফতানি হত৷ আমচাষীরা দুপয়সার মুখ দেখতেন৷ এখন শিলা বৃষ্টি তাদের সব আশায় জল ঢেলে দিল৷ আলু চাষীদেরও এই অবস্থা হয়েছিল৷ অন্যান্য রাজ্যেও চাষীদের একই দুর্ভোগে ভুগতে হয়৷ অনেক ঝুঁকি নিয়ে তাদের চাষ করতে হয়, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, ফসলে বিভিন্ন রোগাক্রমণ--- এই সব কিছুর সঙ্গে লড়াই করে  চাষীদের ফসল উৎপাদন করতে হয়৷ তারপর আবার দেখা যায়, উৎপাদন করতে যে ব্যয় হয়েছে, তার চেয়ে অনেক কম দামেই বাজারে ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে৷ বেশিরভাগ চাষী ঋণ করে চাষে টাকা লাগায়, কিন্তু ওই টাকা না উঠে এলে চরম হতাশায় শেষ পর্যন্ত হয়ত আত্মঘাতী হতে হয়৷ এভাবে প্রতি বছর শয়ে শয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে৷ অনেক সময় ,সরকার তথা প্রশাসন নিজেদের মুখ বাঁচানোর জন্যে আত্মহত্যার অন্য কারণ দেখানোর  চেষ্টায়  ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ রোগ, পারিবারিক বিবাদ , প্রেমজনিত ঘটনা--- এমনি নানান্ তত্ত্ব হাজির করেন৷ কিন্তু চাষীদের প্রকৃত দুর্দশা তা কেবল ভুক্তভোগীরা জানেন, আর জানেন, যাঁরা চাষীদের প্রতি সত্যিকারের সহানুভূতির ভাবনা নিয়ে নিরপেক্ষভাবে সমীক্ষা চালান৷

সরকার উন্নয়নের নানান ফানুষ ওড়ান, সাইনিং ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্মার্টসিটি প্রভৃতি করার সগৌরব ঘোষণা করে নিজেদের জয়ঢাক পেটান৷ কিন্তু যাঁরা দেশের সমগ্র মানুষকে খাদ্য যোগান, অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল কাঁচামাল উৎপাদন করেন---যেমন তূলা বা অন্যান্য-তন্তু, ঔষধীয় গাছ-গাছড়া--- এসব চাষ করেন তারা যে কীভাবে কষ্টের মধ্য দিয়ে নিত্যদিন প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে এই সব উৎপাদন করেন, আমরা কজনই  না তার খোঁজ রাখি? আমাদের রাজনৈতিক নেতারাও কতটুকু তার খোঁজ রাখেন? হয়তো এসব অজানা না থাকলেও এই সমস্যা এড়িয়ে বাতানুকূল গৃহে অবস্থান করেন বা সুসজ্জিত মঞ্চে আত্মপ্রচারে মগ্ণ থাকেন৷

আমাদের দেশ মূলত কৃষিনির্ভর৷ দেশের ষাট শতাংশেরও বেশি মানুষ কৃষিনির্ভর ৷ তাদের অবস্থার কীভাবে স্থায়ী উন্নতি হবে--- সে চিন্তা আগে করতে হবে৷ কেবল দেশ বিদেশের পুঁজিপতিদের হাতে পায়ে ধরে দুচারটে কলকারখানা করলেই দেশের উন্নতি হয়না বা দেশের দ্রারিদ্র ও বেকার সমস্যার আদৌ সমাধান করা যায় না৷ একথা ভুললে চলে না, মুনাফাবাজ পুঁজিপতিরা আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিল্প গড়েন, তাতে ওই কারখানা গড়তে যত মানুষকে ঘরবাড়ী জমি জায়গা ছাড়তে হয়, তার একটা ভগ্ণাংশের মাত্র কর্মসংস্থান হয়৷ বেকার ও দারিদ্র হ্রাস না পেয়ে ক্রমশ বৃদ্ধিই পেতে থাকে৷ ইউরোপ , আমেরিকার মতো দেশগুলিতে ও কৃষকদের দুর্দশার অন্ত নেই৷ এরা সবসময় বঞ্চনা ও হতাশার শিকার৷

চাষী তথা গরীব মানুষদের  কষ্ট দূর করতে গেলে সমবায়ই একমাত্র বিকল্প৷ বিশেষ করে কৃষির ক্ষেত্রে ধাপে ধাপে সমবায় পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন ও সমবায়ের মাধ্যমে বিপনন করার নীতিকেই বাস্তবায়িত  করতে হবে৷ সমবায়ের কথা উঠলে রাজনৈতিক নেতারা বা তথাকথিত একশ্রেণীর অর্থনীতির পণ্ডিত সমবায়ের ব্যর্থতার কথাই বেশী করে বলতে থাকেন৷ কিন্তু আসলে ব্যাপারটা হল, সমবায়কে সফল করতে গেলে যা করা বাধ্যতামূলক সেসব  কিছু করছেন না ৷ দেশবাসীর যথার্থ কল্যাণার্থে নয়, রাজনৈতিক জয়ঢাক পেটানোর লক্ষ্যে ওঁরা সমবায়ের শ্লোগান দেন ও ঘটা ঘরে সমবায় আন্দোলনের কথা বলেন৷

সমবায়কে সার্থক করতে গেলে ৩ টি প্রাথমিক জিনিস প্রয়োজন, তা হল---

(১) জনগণের সামবায়িক মানসিকতা,

(২) জনসাধারণের  উন্নত নৈতিকমান,

(৩) কড়া  তত্ত্বাবধান৷

এই তিনের দিকে যথেষ্ট ধ্যান না দিয়ে ,কেবল সমবায়ের ওপর লম্বা-চওড়া কথা বললেই সমবায় সফল হবে না ও গরীব মানুষের উপকার হবে না৷ ধনীদের দয়ার ওপর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছেড়ে দিলে ধনীরা নিজেদের পুঁজি বৃদ্ধি করে চলবে ও গরীব মানুষেরা ক্রমে পিছু  হটতে থাকবে৷

তাই দেশনেতাদের দৃষ্টিভঙ্গীর আমূল পরিবর্ত্তন চাই৷