এই নদী মাতৃক রাজ্যে কেন এতো জলের অভাব–এই প্রশ্ণের উত্তর খুঁজতে বেশীদূর যাওয়ার দরকার আছে বলে মনে হয় না৷ তাছাড়া এই পশ্চিমবঙ্গে এককালে কত যে খালবিল, বড় বড় পুষ্করিণী, হ্রদ ছিল তা বলার নয়৷ অতীত কালে রাজারা ও বড় বড় জমিদাররা পুণ্য কর্মের নামে জলাশয় খনন করে প্রজাদের জলের অভাব মিটিয়ে গেছেন৷ কিন্তু পরবর্তীকালে দেখা যায় অনেক খাল বিল, নদী–নালা এমন কি পুষ্করিণী সংস্কারের অভাবে মজে গেছে৷ ফলে বৃষ্টির জল ধারণের ক্ষমতা ওই সব জলাশয়ের একেবারেই নেই৷ তাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ স্বরূপ যে বৃষ্টিধারা বর্ষায় ও অন্য ঋতুতে বর্ষিত হয় তার অধিকাংশই সমুদ্রে গিয়ে মেশে৷ ফলে বর্ষার কয়েক মাস পরেই দারুণ জলের অভাব হয়৷ চাষাবাদের জল, পানীয় জল এক এক স্থানে এমনই অভাব হয় যার দরুণ প্রচণ্ড জলকষ্টে মানুষ কাহিল হয়৷এর উপর বহুমুখী নদী উপত্যকা পরিকল্পনার আওতায় স্বাধীনতার পর বড় বড় নদনদীতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেই বাঁধে এমনই সমস্যার সৃষ্টি হয় যার ফলে বাঁধ যাতে না ভেঙ্গে যায় তাই বর্ষায় হাজার হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয় কিন্তু বাঁধের নিম্নাঞ্চলে জলাভাবে পলি পড়ে নদনদীগুলি একেবারে জল ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে বসেছে৷ এতে প্রতি বছর কৃত্রিম বন্যায় পশ্চিমবঙ্গের নিম্নাঞ্চলের মানুষ দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ ফলে বহুমুখী নদী উপত্যকা পরিকল্পনা অনেক ক্ষেত্রে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ডিভিসি দামোদরে প্রতি বছর নিম্ন এলাকায় বন্যা বন্যা হচ্ছে৷ তাই যে উদ্দেশ্যে এই পরিকল্পনা তা ব্যর্থই বলা যায়৷ গঙ্গার বুকে ফারাক্কায় যে বাঁধ সে বাঁধ গঙ্গাকে একেবারে অকেজো করে ছেড়েছে কারণ শুখা মরশুমে অত্যধিক জল বাংলাদেশকে দেওয়ার দরুণ ভাগীরথী (হুগলী) নদী যেন একটি খালে পরিণত হয়েছে৷ যার দরুণ বিখ্যাত কলকাতা বন্দর–যে বন্দর পূর্ব ভারতের বিখ্যাত বন্দর যার পশ্চাদভূমি সমগ্র পূর্ব ভরত তা আজ অকেজো হয়ে পড়েছে৷ নদীর গর্ভদেশ মজে যাওয়ার দরুণ মুর্শিদাবাদ মালদহের বিস্তৃর্ণ এলাকায় নদী ভাঙ্গনে নদীর দুই তীরের বহু জনপদ ধবংস হচ্ছে৷ হুগলী, হাওড়া, ২৪ পরগণা ও নদীয়া নদীভাঙ্গনে দারুণ ক্ষতি হচ্ছে৷ এই নদীর সংলগ্ণ খালগুলিও মজে গেছে যার দরুণ চাষী ও বাসিন্দারা দিশেহারা ও উদ্বাস্তু হচ্ছে প্রতি বছরই৷ যদিও নদী সংস্কারে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো মাথা ব্যাথা নেই৷ বাঙলাকে যে কোনভাবে জব্দ করাই যেন যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের লক্ষ্য৷ তাই কাজের কাজ যে কী হচ্ছে ওই সব এলাকার হতভাগ্য মানুষজন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে৷ এদিকে প্রমোটাররা রাজ্যের অভ্যন্তরে নিম্ন ও চাষযোগ্য এলাকার উঁচু স্থানের জলাশয়, পুকুর বুজিয়ে আকাশ চুম্বি বাড়ি নির্মাণ করে এলাকাগুলোকে এমনই বদ্ধ এলাকায় পরিণত করেছে
যার দরুণ বৃষ্টির জল বেরুতে পারে না৷ ফলে বৃষ্টির সময় বহু ক্ষেত্রে (যেখানে অত্যধিক জনসংখ্যা) মানুষ জলবন্দী হয়ে পড়ছে৷
সমীক্ষায় দেখা যায় শতকরা প্রায় ৯৫ শতাংশ বৃষ্টির জল আমরা ধরে রাখি না৷ সেই বৃষ্টির জল ধরে রাখার কোন ব্যবস্থা নেই৷ ফলে সরকার অনেকক্ষেত্রেই গভীর নলকূপ ও অগভীর নলকূপ খনন করে জনগণের জলের অভাব দূর করার ব্যবস্থা করে থাকে৷ তাছাড়া বড় বড় ফ্ল্যাট এলাকায় ওই নলকূপ নির্মাণ করে জলের যোগান দেওয়া হয়৷ এতে দারুণ ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে অদূর ভবিষ্যতে৷ কারণ মাটির নীচের জলের যোগান কমে যাবে৷ এলাকা শুষ্ক হয়ে পড়বে৷ তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা চিন্তা করে আমাদের এই ব্যাপারে অবশ্যই ভাবতে হবে৷ এই দায়িত্ব যৌথভাবে সরকার ও জনগণের৷ অরণ্য যেমন নির্মম ভাবে ধবংস করে পরিবেশকে দূষিত করা যাবে না ঠিক তেমনই গভীর নলকূপ ও যত্রতত্র অগভীর নলকূপ খনন করে এলাকাকে শুষ্ক করা যাবে না৷ বৃষ্টির জলকে ধরে রাখতে হবে নানা ভাবে৷ ব্যাপকভাবে জলাশয় সংস্কার করতে হবে৷ নদনদীর সংস্কার করে নদীর দুপাশের ভাঙ্গন রোধ করতে হবে৷ তাছাড়া ব্যাপক খাল কেটে বিভিন্ন নদনদীর সঙ্গে যোগ করে দিতে হবে যাতে জল দেশের অভ্যন্তরে থেকে যায়৷ বিভিন্ন নদনদী ও জলাশয়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে জল সঞ্চিত করতে হবে৷ আর ওই সঞ্চিত জলকে শোধন করে পানীয় জল হিসাবে সরবরাহের ব্যবস্থা করাটাই বিধেয়৷ মাটির নীচের জলে অনেক সময় অনেক দূষিত খনিজ বস্তু থাকে যা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়৷ তাছাড়া চাষাবাদের ক্ষেত্রেও মাটির উপরিভাগের জলে চাষাবাদ যেমনটি হয় মাটির নীচের জলে তেমনটি হয় না৷ মাটির নীচের সঞ্চিত জলের ভাণ্ডারের ওপর সব সময় হাত দেওয়া অনুচিত৷ প্রাকৃতিক নিয়মকে মান্যতা দিয়ে আমরা যদি চলতে পারি তাহলে পরিবেশ রক্ষিত হবে ও আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে কিছু ভালো করে যেতে সক্ষম হবো৷ কোন অবস্থাতেই বড় বড় পুষ্করিণী ভরাট যাতে না হয় তা দেখতেই হবে সকলকে৷ যে কথাটা সকলকে স্মরণে রাখতে হবে তাহলো খাদ্য, পানীয় জল ও জ্বালানীর দারুণ অভাব ঘটছে ও ঘটবে৷ ভবিষ্যতে তাই আমাদের সকলকে ভেবে চিন্তে এই জিনিসের সদ্ব্যবহার অবশ্যই করতে হবে৷
সমবায়ের মাধ্যমে চাষের প্রচলন যাতে হয় সেদিকে সরকার ও চাষীরা ভাবুন৷ খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সুষম বন্টন বড়ই প্রয়োজন৷ মাটির নীচের মূল্যবান কয়লা ও মাটির ওপরের গাছপালা যাতে নির্মমভাবে ধবংস না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে৷ সৌর শক্তি ও অব্যবহূত জ্বালানী যা পরিত্যক্ত হয় সেগুলিকে সংগ্রহ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহার করার ব্যবস্থার মাধ্যমে গরিব মানুষের জ্বালানীর সমস্যা দূর করতে হবে৷
- Log in to post comments