লিপির ইতিকথা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

লিপি বা অক্ষরের ক্ষেত্রেও এমানেশনের প্রভাব রয়েছে৷ আমরা আগেই বলেছি যে এক একটি ভাষা আনুমানিক এক হাজার বছর বাঁচে কিন্তু এক একটি লিপি বাঁচে আনুমানিক দু’ হাজার বছরের মত৷ যজুর্বেদের যুগের গোড়ার দিকে কোন লিপি ছিল না৷ শেষের দিকে অর্থাৎ আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতে লিপির আবিষ্কার হয়৷ অক্ষর আবিষ্কারের সময় ঋষিরা ভেবেছিলেন যে অ–উ–ম অর্থাৎ সৃষ্টি–স্থিতি–লয় নিয়ে এই জগৎ রয়েছে৷ কিন্তু ব্যক্ত জগৎটা হচ্ছে চৈতন্যের ওপর প্রকৃতির গুণপ্রভাবের ফল–ক্গনিটিব্ ফ্যাকাল্টির ঙ্মচৈতন্যসত্তারৰ ওপর বাইণ্ডিং ফ্যাকল্টির ঙ্মপরমা প্রকৃতিৰ আধিপত্যের ফল৷ অর্থাৎ এক্ষেত্রে পরমপুরুষ প্রকৃতির ৰন্ধনী শক্তির আওতায় এসে গেছেন৷ এই যে ব্যক্ত জগৎ, একে ৰৌদ্ধ ভাষায় বলমা হয়েছে ‘সংবৃত্তিৰোধিচিত্ত’ ও আর্যভাষায় ‘কার্যব্রহ্ম’ (ন্দ্বপ্রহ্মব্জন্দ্বব্দ ব্ভুন্লন্দ্বব্জব্দন্দ্ব)৷ পুরুষ ও প্রকৃতির এই অবস্থাকে ৰোঝাবার জন্যে পুরুষের ক্ষেত্রে একটি দাঁড়ানো রেখা ও প্রকৃতির জন্যে একটি শোয়ানো রেখা–দু’য়ে মিলে একটি ‘যুক্ত চিহ্ণ’ () তৈরী হ’ল যা’ কার্যৰ্রহ্মের অর্থাৎ সৃষ্ট জগতের দ্যোতক৷ কার্যৰ্রহ্মের ৰীজমন্ত্র ‘ক’৷ তাই এই যুক্ত চিহ্ণটি হ’ল ৰ্রাহ্মীলিপির ‘ক’ অক্ষর৷ সেই ৰ্রাহ্মী ‘ক’–ই দ্রুতলিখনের মাধ্যমে বিবর্তিত হতে হতে আজকের ‘ক’ অক্ষরে রূপান্তরিত হয়েছে৷ যেমন–

       ক

সুতরাং দেখা যাচ্ছে লিপির ক্ষেত্রেও এই উৎসারণ বজায় আছে৷ ভারতের মানুষ প্রথম যে লিপি আবিষ্কার করলেন তার নাম ৰ্রাহ্মী লিপি৷ কালক্রমে ৰ্রাহ্মী–খরোষ্ঠী লিপি বিবর্তিত হয়ে তিনটি লিপির উদ্ভব হ’ল৷

এলাহাবাদের দক্ষিণ–পশ্চিমের বিবর্তিত লিপির নাম হ’ল নারদা লিপি এলাহাবাদের উত্তর–পশ্চিমে বিবর্তিত লিপির নাম হ’ল সারদা লিপি  এলাহাবাদ ও তার পূর্ব দেশে যে লিপির উদ্ভব হ’ল তার নাম হ’ল কুটিলা৷ নারদা লিপির ক্ষেত্র ছিল বর্তমান মদ্যপ্রদেশের পশ্চিমাংশ, রাজস্থান, সিন্ধু, গুজরাত ও মহারাষ্ট্র৷ নারদা লিপিতে সংস্কৃত লিখনে উদ্যোগী ছিলেন গুজরাতের নাগর পণ্ডিতেরা৷ তাঁদের নাম থেকেই পরবর্তীকালে লিপিটির নাম হ’ল ‘নাগরী’৷ তাঁরা যখন এই লিপিতে স্থানীয় ভাষা লিখতেন তাকে দেশী নাগরী বা ‘মোড়ি’ বলা হত৷ আর যখন সংস্কৃত (দেবভাষা) লিখতেন, মাত্রা যুক্ত করে যুক্তাক্ষর সহ লিখতেন৷ তখন সেই লিপিকে বলা হত ‘দেবনাগরী’৷ বর্তমান গুজরাতী লিপি যদিও দেশী নাগরী ও তাতে ‘মাত্রা’ নেই কিন্তু তাতে যুক্তাক্ষর আছে৷ রাজস্থানের বিভিন্ন ভাষা (মাড়োয়ারী, মেবারী, হড়ৌতি, ঢুনঢ়ারু, মেবাতী প্রভৃতি), পশ্চিম মধ্য প্রদেশের ভাষা (মালবী, ৰুন্দেলী) ও মহারাষ্ট্রের ভাষা (মারাঠী, বরাড়ী, খান্দেশী, কোঙ্কনী) লিখিত হ’ত যে মোড়িতে তাদের মধ্যে মহারাষ্ট্রের মোড়িতে অবস্থাবিশেষে যুক্তাক্ষর ছিল৷ কিন্তু বাকী মোড়িগুলিতে যুক্তাক্ষর ছিল না বা নেই৷ বর্তমান মারাঠী ভাষায় পুস্তকাদি দেবনাগরীতে মুদ্রাঙ্কিত হলেও দেবনাগরী মহারাষ্ট্রের নিজস্ব লিপি নয়৷ রাজস্থানের মোড়ি লিপিগুলি (চুরুওয়ালী, যোধপুরী, ঝুনঝুনওয়ালী প্রভৃতি) এখনও সাধারণের মধ্যে বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে৷ সিন্ধীর নিজস্ব লিপি বর্তমান পুস্তকাদিতে ব্যবহূত হয় না৷ সিন্ধী ভাষায় পুস্তক এখন ফার্সী হরফে ছাপানো হয়৷ কিন্তু ব্যবসায়ীদের মধ্যে সাবেকী সিন্ধি লিপি বা ‘লাহাণ্ডেই’ এখনও প্রচলিত রয়েছে৷

উত্তর–পশ্চিমে সারদা লিপি বিবর্তিত হয়ে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়৷ হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের টেক্ড়ি, টেগ্ড়ি বা টেংড়েই (এই লিপিটি তিববতী লিপির অতি নিকট আত্মীয়), লাদাকী লিপি (এটিও তিববতী লিপির নিকট আত্মীয়), কাশ্মীরী সারদা (বর্তমানে কশ্মীরের পণ্ডিতেরা যে লিপিতে সংস্কৃত লিখে থাকেন) ও ডুগ্গরদেশীয় সারদা (জম্মুর ডোগরী ভাষার লিপি) প্রভৃতি সবই সুপ্রাচীন সারদা লিপিরই বিবর্তন৷ বর্তমানে পাঞ্জাবী ভাষা যে লিপিতে লিখিত হয় তা ‘গুরুমুখী’ লিপি নামে পরিচিত৷ এটি সারদা লিপির স্বাভাবিক বিবর্তন নয়৷ শিখগুরু অর্জনদেব (এ ব্যাপারে একটু মতভেদ আছে) এই লিপির প্রবর্তন করেন৷ এই লিপিতে পুরোপুরি যুক্তাক্ষর নেই৷ তবে একটু চেষ্টা করলে যুক্তাক্ষর প্রবর্তন করা যেতে পারে৷ তখন স্কুল, ষ্টপ, ষ্টেশন প্রভৃতির জন্যে ‘সকুস্’, সটাপ্’, ‘সটেশন’ প্রভৃতি লেখবার দরকার পড়বে না৷

লিপি আবিষ্কৃত হওয়ার পরেও অনেকদিন পর্যন্ত পণ্ডিতেরা বেদ লিপিবদ্ধ করেন নি৷ তাঁরা ভাবতেন যেহেতু পূর্ব পুরুষেরা বেদ লিপিবদ্ধ করেননি, তাই তা করতে নেই৷ একটু তলিয়ে দেখলে তাঁরা দেখতে পেতেন যে অতি প্রাচীনকালে লিপি ছিল না বলে তাঁরা বেদ লিপিবদ্ধ করেন নি৷ পরে যখন বেদকে আর কণ্ঠস্থ করে রাখা যাচ্ছে না তখন এই বিবর্তিত সারদা লিপিতেই কশ্মীর* দেশীয় পণ্ডিতগণ প্রথম লিপিবদ্ধ করেন৷   (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

* (দেশটির নাম কাশ্মীর নয়–কশ্মীর৷ ‘কশ্’ নামীয় জনগোষ্ঠী যে মেরুতে বা দেশে বাস করতেন তাঁদের দেশ ‘কশ্মেরু’৷ এই কশ–মেরু থেকে সংস্কৃত ‘কশ্মীর’ শব্দটি তৈরী হয়৷ তাই ‘কাশ্মীর’ মানে কশ্মীর দেশীয় আর কাশ্মীরী মানে কশ্মীর দেশীয়া নারী৷ তাই কোন মানুষকে কাশ্মীরী পণ্ডিত বলতে যাওয়ার অর্থ হ’ল তিনি নারী, এই কথাটাই ৰোঝানো৷ কহ্লনের ‘রাজতরঙ্গিনী’–তে রয়েছে–

‘‘সারদামঠমারভ্য কুমকুমাদ্রিতটাংতক৷

তাবৎ কশ্মীরদেশস্যাদ্

পঞ্চাশৎযোজনাত্মক৷৷’’

অনুরূপভাবে ‘অজেয়মেরু’ অর্থাৎ না–জেতা দেশ৷ তাই থেকে তৈরী হয়েছে অজমীর’ আজমীর বা আজমীড় নয়–দু’টোই অশুদ্ধ৷)