আন্না হাজারের দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল হিসেবে ভারতের লোকপাল নিয়োগ হ’ল৷ ভারতের প্রথম লোকপাল চেয়ারম্যান হলেন সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বাঙালী বিচারপতি পিনাকী চন্দ্র ঘোষ৷
লোকপাল আইনে কী আছে? লোকপাল নিয়োগে কি সত্যই কেন্দ্রীয় প্রশাসন দুর্নীতিমুক্ত হবে? প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সমস্ত মন্ত্রী ও আমলাদের পুরোপুরি দুর্নীতি বন্ধ হবে?
প্রথমে, লোকপাল বিল ব্যাপারটার ইতিহাস সংক্ষেপে বলা যাক৷ কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্যে সংসদে লোকপাল নিয়োগের দাবী উঠেছিল আজ থেকে ৫৬ বছর আগে ১৯৬৩ সালে৷ কিন্তু তা ওই আলোচনা পর্যন্তই থেকে যায়৷ কোনও সরকারই আন্তরিক ভাবে এই আইন পাশ করতে আগ্রহী হয়নি৷ এই কারণে লোকপাল নিয়োগ আর হয়নি৷ মাঝে মাঝে একটু-আধটু হাল্লা হয় মাত্র৷
তারপর দীর্ঘ ৪৮ বছর পর ২০১১ সালে সমাজসেবী আন্না হাজারে এই আইন পাশের দাবীতে আন্দোলন শুরু করেন৷ তিনি দিল্লীতে এই দাবীতে আমরণ অনশনও করেন৷ আন্দোলনের চাপে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার এই বিল পাশে রাজীও হন৷ কিন্তু তারপরও নানাভাবে গড়িমসি করে দু’বছর পর ২০১৩ সালে ভারতীয় সংসদে লোকপাল বিল পাশ হয়৷ পরের বছর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় এই বিলে সই করে বিলটিকে আইনে পরিণত করেন৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সময় প্রধান বিরোধী দল বিজেপি ও বাম দলের বিরোধিতায় সংসদের দুই-তৃতীয়াংহের সমর্থন না পাওয়ায় তা সাংবিধানিক মর্যাদা পেতে অসুবিধা হয়৷ এইভাবে নানান বাঁধা বিপত্তির নুড়ি ঠেলে শেষ পর্যন্ত আন্না হাজারের পুনর্বার অনশন আন্দোলন ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির চাপে বর্তমান সরকারের উদ্যোগে গত ১৫ই মার্চ(২০১৯) লোকপাল চেয়ারম্যানের পদে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি পিনাকী চন্দ্র ঘোষকে নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়৷
এরপর দেখা যাক লোকপাল নিয়োগের উদ্দেশ্য কতখানি সফল হয়৷ লোকপাল আইনে কী আছে? কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও রাজ্য প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে যথাক্রমে কেন্দ্রে লোকপাল ও রাজ্যে অনুরূপভাবে লোকায়ুক্ত নিয়োগ হবে৷ লোকপালের কাছে কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, সংসদ ও সরকারী সমস্ত কর্মীদের বিরুদ্ধেই যে কেউ দুর্নীতির অভিযোগ আনতে পারে৷ এই জন্যে কারোর (রাষ্ট্রপতিরও) অনুমতি লাগবে না৷ তবে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিদেশ, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, পরমাণুশক্তি ও মহাকাশ সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ আনা যাবে না৷ অভিযোগের ভিত্তিতে লোকপাল প্রধানমন্ত্রী সহ কেন্দ্রীয় সরকারের অন্যান্যদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচার করতে পারবেন৷ লোকায়ুক্তের ক্ষেত্রেও রাজ্যপালের অনুমতি না নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যের অন্যান্য মন্ত্রী ও বিধানসভার সদস্য ও আমলাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনলে লোকায়ুক্ত তার বিচার করতে পারবেন৷ লোকপালের চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বা বিচারপতি বা কোনও সেই ধরণের বিশিষ্ট ব্যষ্টি হতে পারেন৷ লোকপাল কমিটির ৫০ শতাংশ থাকবেন বিচারবিভাগীয় সদস্য৷ অন্য ৫০ শতাংশ হবেন তপশিলী জাতি, উপজাতি, অন্যান্য পশ্চাদ্পদ জনগোষ্ঠী, মহিলাদের ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি৷
চেয়ারম্যান নিয়োগ করবেন যে কমিটি তাতে থাকবেন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার অধ্যক্ষ, লোকসভার বিরোধী দলনেতা, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও রাষ্ট্রপতি মনোনীত একজন বিশিষ্ট ব্যষ্টি৷ এর মেয়াদ হবে পাঁচ বছর৷ এই ভাবে লোকপাল কমিটিরও নিয়োগের বিধি নির্দিষ্ট করা আছে৷ একইভাবে লোকাযুক্ত নিয়োগও হবে৷
শেষ পর্যন্ত লোকপাল নিয়োগর সিদ্ধান্ত পাকা হ’ল৷ লোকপাল নিয়োগ কমিটি চেয়ারম্যানের নামও ঘোষণা করেছেন৷ এখন,পুরো কমিটি সহ লোকপালের আনুষ্ঠানিক নিয়োগই কেবল বাকি৷
সরকারের এই সিদ্ধান্তে আন্না হাজারে স্বাভাবিকভাবেই খুবই খুশী হয়েছেন৷ তার মন্তব্য ‘লোকপাল নিয়োগ হচ্ছে শুনে আমি খুব খুশী৷ ৪৮ বছর পর জনতার আন্দোলন সফল হয়েছে৷ লোকপালের কাছে কোনও একজন সাধারণ মানুষও দুর্নীতির প্রমাণ দিলে প্রধানমন্ত্রী বা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রী বা আমলার বিরুদ্ধে তদন্ত হবে৷ অচিরেই মানুষ এর শক্তি বুঝতে পারবেন৷’
মানুষ অবশ্য খুবই উদ্বিগ্ণ হয়ে থাকবে এর শক্তি দেখার জন্যে৷ না আঁচালে বিশ্বাস নেই৷ কেননা বহু ভাল ভাল কঠোর আইন আছে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় না৷ এক্ষেত্রে প্রশাসনের শীর্ষস্তরে দুর্নীতিরোধের অভিযান পুরোপুরি সফল হবে তো!
- Log in to post comments