প্রভাতী

‘কাঁচা বেঁশো হ্যাংলামি

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘ক্রুড্’ ধাতুর একটি অর্থ ‘হ্যাংলামি করা’ বা ‘ন্যালা খ্যাপামি করা’ –কাঁচা বাঁশের মত হ্যাংলামি বা ন্যালা খ্যাপামি যা শুণলেই বোঝা যায়, দেখলেই ধরা যায় অথবা এমনও কেউ কেউ থাকে যারা ধরা পড়বার জন্যেই এই রকম হ্যাংলামি বা ন্যালাখ্যাপামি করে থাকে৷ যেমন নেম্তন্ন বাড়ীতে তোমার আরও কয়েকটা রসগোল্লা খাবার ইচ্ছে হল৷ তুমি পাশের ভদ্রলোকটির পাত দেখিয়ে বললে......ও দাদা, এদিকে, এদিকে, এঁর পাতে কয়েকটা রসগোল্লা দিন৷

রসগোল্লা পরিবেশনকারী কাছে এলে তাকে বললে–আমায় আর দেওয়া কেন! আমার পাতে পরে দেবেন (আসলে পরিবেশনকারী তাকে দিতে আসেন নি, এসেছিলেন পাশের লোকটিকে দিতে)৷ পরিবেশনকারী দিতে গেলে বললে–না, আমার আর চাই না, পেট ভরে গেছে৷ আবার হ্যাংলামি করে বললে–তা দেবেন যখন অন্ততঃ চারটে দিন৷ একগণ্ডার কমে কি ভাল দেখায়! এতে পরিবেশনকারী বুঝে নিলেন, যিনি পরিবেশনকারীকে ডেকেছিলেন তাঁরই রসগোল্লা দরকার......আর চারটে দরকার৷ এই ধরণের হ্যাংলামির জন্যে ক্রুড/ক্রুড়, শব্দটি চলবে৷ চলবে ক্রুূযৎ ঞ্চ ক্রড্য শব্দটিও (ক্রুড়া হয় না)৷ একবার দেখেছিলুম জনৈকা মহিলা–তিনি ছিলেন একজন মস্তবড় অফিসারের মাতাঠাকুরাণী–একজন মধ্যবিত্তের বাড়ীতে গিয়ে তার লক্লকে লাউগাছটি দেখে বলেছিলেন–লাউ–এর ডগাগুলো ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো৷ পোস্ত–বাটার সঙ্গে লাউডগা সেদ্ধ খেতে খুব ভাল লাগে৷ চাকরটাকে রোজই বাজারে পাঠাই৷ এসে বলে বাজারে আজকাল লাউডগা পাওয়া যাচ্ছে না৷ লাউডগা–পোস্ত সেই যে কোন মান্ধাতার আমলে খেয়েছিলুম, আজও যেন জিবে লেগে আছে৷ লাউ–ডগার মালিক কি আর করেন! মহিলার সঙ্গে কিছু লাউডগা পাঠিয়ে দিলেন৷ যাই হোক, এই কাঁচাবেঁশো হ্যাংলামি ভালভাবেই বুঝলে৷ সুতরাং ওই হ্যাংলা মহিলা হচ্ছেন ‘ক্রুড্যা’৷

আমার পরিচিত ভোলা মোড়লের ভাল রকমের বেগুনের চাষ ছিল৷ বর্ষার শেষে একদিন সে তার বেগুনবাড়ী থেকে বছরের প্রথম ফসলটি তুলে নিয়ে বাড়ীর দিকে যাচ্ছিল৷ আশা করেছিল, বর্ধমানের বাজারে নতুন মুক্তকেশী বেগুনের ভালই দর পাবে........তার একটু টেনেটুনে সংসার চলত৷ রাস্তায় সে পড়ে গেল হরু ভটচাজের খপ্পরে৷ হরু ভট্চাজ্ বললে–কি রে ভোলা, আজকাল তোর দেমাগে যে মাটিতে পা–ই পড়ে না৷ বামুন–বোষ্টমের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি হারালে ফল কি ভাল হয় জানিস তো মাথার ওপর নারায়ণ রয়েছেন৷ তিনি আমাকেও দেখছেন, তোকেও দেখছেন, বেগুনগুলোকেও দেখছেন৷ যাই হোক, বেগুনগুলো বেশ তেল কুচকুচে৷ কম আঁাঁচে পোড়াতে গেলে গায়ে তেলও মাখাতে হবে না৷ তা তু’ এক কাজ কর গা৷ আমাকে বেগুনগুলো দিতে হবে না৷ তু’ ওগুলো পুড়িয়ে যেন আমার প্রসাদ খাচ্ছিস ভেবে নিজেই খা গা যা৷ ভোলা মোড়ল আর কি করে! তার বুকের পাঁজর–ভাঙ্গা আট–দশটা বেগুন হরু ভটচাজকে দিয়ে দিলে৷ এই হরু ভটচাজ ছিল একটি নির্ভেজাল ‘ক্রুডা’৷

কোন একটা বিয়ে বাড়ীতে ভিয়েন বসেছে৷ অনিমন্ত্রিত পুণ্ডরীকাক্ষ ভট্টাচার্য্য হঠাৎ সেখানে পৌঁছে গেলেন৷ পুণ্ডু ভট্চাজ্ ছিলেন আমাদেরই বর্ধমান জেলার পুতুণ্ডু গ্রামের বাসিন্দে৷ মস্ত বড় ভিয়েন, কলকাতা থেকে বাছাইকরা হালুইকারেরা এসেছে৷

পুণ্ডু ভটচাজ্ বললেন–খাওয়াদাওয়ায় আমার তেমন আগ্রহ নেই৷ কিন্তু রান্নাবান্না দেখতে বড্ড ভালবাসি.....সেই ছোটবেলাকার স্বভাব৷

সবাই বললে–এসো, এসো, বসো, বসো৷ দেখো, কেমন খাবার তৈরী হচ্ছে৷

দেখে বোঝা গেল হালুইকারেরা খুব উন্নত মানের চমচম (সংস্কৃতে ‘চম্’ ধাতু হ’ল গোগ্রাসে গিলে খাওয়া৷ একপক্ষের সৈন্য অন্য পক্ষের দেশে গিয়ে সব কিছুকে গোগ্রাসে গিলে খায়৷ এই অর্থে চম্ ধাতুূউস্ প্রত্যয় করে ‘চম্’ শব্দটি পাচ্ছি৷ ‘চমু’ মানে সৈন্যবাহিনী৷ ‘চমূড্ণ্’ করে ‘চম্’ শব্দটি পাচ্ছি, অর্থাৎ যা দেখে গোগ্রাসে গিলে খেতে লোকের ইচ্ছে হয়৷) তৈরী করছে৷ পুণ্ডু ভট্চাজ্ আর নোলা সামলাতে পারছে না৷ প্রাণে আকুতি জেগেছে, চমচম একেবারে খোলা থেকে নোলায় চলে আসুক৷ সে তখন স্বগতভাবে বললে, (বললে এমন ভাবে যাতে আর পাঁচটা লোকের বধির কর্ণেও তা প্রবেশ করে)–এককালে চমচম খেতে খুবই ভালবাসতুম৷ কবে সেই খেয়েছিলুম.......বাহাৰপুরের ঘোষেদের বাড়ীতে৷ এখনও যেন ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারছি না৷ মন বারে বারে সেই চমচমে ফিরে যেতে চায়৷ এখন দু’চারটে চাখতে পারতুম কিন্তু সন্ধ্যে হয় হয়৷ সন্ধ্যে আহ্ণিক না করে খাই বা কি করে– তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে–সে কথাও ভুলি কি করে৷

হালুইকারেরা বললে–সন্ধ্যে হতে এখনও একটু দেরী আছে৷

পুণ্ডু ভটচায্ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললে–হ্যাঁ মনে হয় আধঘন্টাটাক সময় আছে৷

হালুইকারেরা বললে–তৰে দুটো সন্দেশ চেখেই দেখুন৷ আমার মনে হয় গণ্ডাখানেক চেখে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফেলাও সম্ভব৷

হালুইকারেরা কি আর করে! পুণ্ডু ভট্চাজ্কে একটা শাল পাতায় মুড়ে চারটে চমচম দিলে৷ এও সেই কাঁচা বেঁশো হ্যাংলামি৷ পুণ্ডুরীকাক্ষ ভট্টাচার্য হলেন একটি ডাকসাইটে ‘ক্রুড্ড’৷ যাই হোক, তোমরা ‘ক্রুড্’ ধাতুর রকমারি ব্যবহার দেখলে তো৷    (শব্দ চয়নিকা)

নামের উৎপত্তি হালিশহর

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

অনেকের ধারণা, হালিশহরের আগের নাম ছিল হাবেলি শহর৷ ‘হাবেলিশহর’ নাম মুসলমান যুগের৷ ‘হাবেলিশহর’ নামের অপভ্রংশ হালিশহর৷ উর্দূভাষায় হাবেলী অর্থে দালান, অট্টালিকা বা প্রাসাদ বোঝায়৷ অট্টালিকা বহুল নগরী ছিল বলে ‘হালিশহর’ নাম৷

শ্রীচৈতন্য গয়াতে ঈশ্বরপুরীর কাছে মন্ত্র দীক্ষা নিয়ে ছিলেন৷ এই ঈশ্বরপুরীর জন্মস্থান হালিশহর৷ হালিশহরে ঈশ্বর পুরীর বাস্তুভিটাই ‘চৈতন্য ডোবা’ নামে খ্যাত৷ এই হালিশহরে শ্রীবাস পণ্ডিতও বসবাস করতেন৷ পদাবলী রচয়িতা বাসুদেব ঘোষ, কীর্ত্তনীয়া মাধব ও গোবিন্দনন্দও থাকতেন হালিশহরে৷ চৈতণ্যের সময় থেকেই হালিশহরে বৈষ্ণবধর্ম বিস্তার লাভ করে৷ ঈশ্বরপুরীর স্মৃতিমন্দির, ‘চৈতন্য ডোবা’, শ্রীবাসের আবাস, চৌধুরী পাড়ার শ্যাম রায়, ঠাকুর পাড়ার রাধাগোবিন্দ, মল্লিক বাড়ির মদনমোহন ইত্যাদি বৈষ্ণব দেবদেবী বৈষ্ণব ধর্ম চর্চার নিদর্শন৷ তার আগে এখানে জঙ্গলের মধ্যে ও শ্মশানে বামাচারী তন্ত্র সাধক কাপালিক ও নামপন্থী শৈব যোগীদের শক্তি সাধনার আস্থানা ছিল৷ পরবর্ত্তী অনেক শাক্তধর্মী, বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করেছিলেন৷

হালিশহরে যে এককালে শাক্তধর্ম প্রসার লাভ করেছিল জীর্ণ শিব মন্দিরগুলি আজো তার নির্দশনরূপে বিদ্যামান৷ অনেক মন্দিরে শিবলিঙ্গও প্রতিষ্ঠিত আছে৷ শিব ছাড়াও আরো অনেক শক্তি দেবীর পূজা হতো৷ যেমন, বালিঘাটার সিদ্ধেশ্বরী দেবী, অকিঞ্চন ব্রহ্মাচারী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত খাস বাটীর শ্যামা সুন্দরী, শ্মশান ঘাটের শ্মশানকালী ইত্যাদি৷ কার্ত্তিক গণেশের পূজাও এখানে হতো৷

এছাড়া লৌকিক দেবদেবীদের পূজার প্রচলনও ছিল৷ ঝাঁপান, চড়কপূজা, ব্রহ্মপূজা, শীতলাপূজা, পবন দেবের পূজা ইত্যাদি লৌকিক ধর্মানুষ্ঠান, মুসলমানযুগের আগে থেকেই শুরু হয়েছে৷ শাক্তধর্মের ঢেউ এসেছে তারপরে৷ তার ওপরে এসেছে বৈষ্ণবধর্মের বন্যা৷

১৯৫০ সালের আগে সাবর্ণ চৌধুরীদের আদিপুরুষ ‘পাঁচুশক্তি খান’ হাবেলি শহর পরগণার কর্তৃত্ব লাভ করেন৷ তিনি বিক্রমপুর থেকে বৈদ্যপরিবার, কোন্নগরের কায়স্থ পরিবার ইত্যাদি এনে ‘হালিশহর সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেন৷ তারপর থেকে অনেক পণ্ডিত বংশ এখানে বসবাস করতে শুরু করেন৷ আইন-ই আকবরীতে সরকার সাতগাঁ-র অন্তর্গত পরগণার মধ্যে ‘হাবেলীশহরের নাম পাওয়া যায়৷ যাইহোক, বহু প্রাচীন শহর এই হালিশহর৷ একাধারে শাক্তধর্মের পীঠস্থান ও বহু স্মৃতিবিজড়িত এই শহরে৷

পবিত্রতা অর্জন

লেখক
কেয়া সরকার

মন থেকে মুছে ফেল যত অবিশ্বাস

তোমাকে যেন বিশ্বাস করি৷

মন থেকে মুছে ফেল যত সংশয়

তোমাকেই যেন বিশ্বাস করি৷৷

মনের কোণে জমে থাকা আবিলতা

সব কিছু মুছে দিয়ে শুদ্ধ করে দাও,

তোমার প্রতি ঐকান্তিক প্রেম

একবার শুধু হৃদয়েতে ধরে দাও৷

আর কিছু চাই না শুধু

তোমাকেই যেন অর্জন করি৷

আমি প্রকৃতির সন্তান

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

মাথার উপর মুক্ত আকাশ

 উদারতার প্রতীক,

সকল সৃষ্টি নিকট আত্মীয়

 প্রিয়জন প্রাণাধিক৷

সূর্য কিরণে উজ্জীবিত হই

 রত থাকি কাজ-কর্মে,

স্নিগ্দ সুষমা মাধুরী ছড়ায়

 তারও কথা জাগে মর্মে৷

বিনিদ্র তারা অলক্ষে দেয়

 সঠিক পথের নির্দেশ,

ভূমিষ্ঠ হয়েছি ধরার ধূলায়

 তাই ভূবন আমার দেশ৷

ঋতুগুলি আসে মোরে ভালবেসে

 ভিন্ন তাদের মাহাত্ম,

বৈচিত্র্যময় ষড়ঋতু গুলি

 পুলকিত করে চিত্ত!

সাগর আমায় হাতছানি দেয়

 চির উচ্ছ্বল তরঙ্গে,

উদ্দীপনায় ঊর্মিমালায়

 নৃত্যের নানা বিভঙ্গে৷

পাহাড় আমায় পরামর্শ দেয়

 উচ্চ রাখিতে শির,

শত ঝঞ্ঝায় অটল থাকিতে

 মৌন ও ধীরস্থির৷

আমার তরে শ্রাবণ ঝরে

 করি পূর্ণ অবগাহন,

 শিস দিয়ে বলে দখিনা পবন

 চির সুন্দর মহাজীবন!

বজ্রপাতে, তুষার ঝড়ে

 যবে মুখোমুখি হই বিপদে,

পরমা প্রকৃতি অতি কৃপা করে

 রাখে মোরে নিরাপদে৷

আঁকাবাঁকা নদী উচ্ছ্বল গতি

 জীবনে লক্ষ্য সিন্ধু,

আমি অনুমন অসীমের মাঝে

 হারানো একটি বিন্দু৷

আমি প্রকৃতির স্নেহের পুত্র

 মানব ধর্ম, শিব গোত্র,

ধর্ম প্রচারে যত্রতত্র

 কীত্তনে মজে অহ-রাত্র৷

‘প্রকৃতি’ যে তাঁর প্রেমের রচনা,

 রচিয়াছে এক অবিচ্ছিন্ন বাঁধন,

এ ভূবন তাঁর লীলার ভবন

 ব্রহ্মান্ডের অমৃতসদন৷

অগস্ত্যপত্নী–কৌশিতকী

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কৌশিতকী ছিলেন মহর্ষি অগসেত্যর পত্নী৷ মহর্ষি অগস্ত্য তাঁর জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন আদর্শের প্রচারে, মানবিকতার সম্প্রসারণে৷ তাঁকে এই কাজে প্রতি পলে বিপলে সাহায্য করে থাকতেন তাঁর স্ত্রী কৌশিতকী৷ কৌশিতকী ছিলেন অত্যন্ত বিদুষী মহিলা ও ব্যাপক মানব হূদয়ের অধিকারিণী৷ কখনও অগস্ত্য তাঁকে নির্দেশনা দিয়ে কাজ করাতেন, কখনও বা তিনিও নব নব ভাব–তত্ত্ব উদ্ভাবনের দ্বারা মহর্ষি অগস্ত্যকে নির্দেশনা দিতেন৷ এই ভাবে উভয়ে মিলেমিশে কাজ করে গেছলেন মানব জীবনে দেবত্ব ভাবের উত্তরণের জন্যে৷

তোমরা জান, প্রাকৃতিক বিচারে ভারতের দক্ষিণাংশ দক্ষিণাপথ বা দাক্ষিণাত্য নামে পরিচিত ও উত্তরাংশ উত্তরাপথ বা আর্যাবর্ত নামে পরিচিত৷ দক্ষিণাপথের মধ্যমাংশ সুপ্রাচীন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ আর্যাবর্তের দক্ষিণ দিকের কিছুটা অংশও প্রাচীন গণ্ডোয়ানাল্যাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ বাকী অংশ হিমালয় বা তার পাললিক উপাদানে গঠিত ছিল৷ দক্ষিণাপথের মূল স্রোত এসেছিল দ্রাবিড়ী সাংস্কৃতিক অভিস্রোত থেকে যা’ রাঢ়ীয় সভ্যতার দ্বারা হয়েছিল ব্যাপক ভাবে সম্পৃক্ত৷ উত্তর ভারতীয় সভ্যতা এসেছিল ককেশীয় অভিস্রোত থেকে যা’ রাঢ়ীয় সভ্যতার দ্বারা ছিল প্রতি অনুপলে অভিস্পন্দিত৷ উত্তরাপথের নিম্নাংশ ছিল সম্পূর্ণভাবে রাঢ়ীয় সভ্যতার উৎসারণ৷ আমরা আজকাল যাকে বাঙালী সভ্যতা বলি তা–ই রাঢ়ীয় সভ্যতার সঙ্গে গাঙ্গেয় তথা ব্রহ্মপুত্র সভ্যতার ত্রিবেণীসঙ্গম৷ বাঙালীর সভ্যতা অনেক দিনের পল্লবিনী রূপ, তা এতটা মাধুর্যময় হয়ে উঠেছিল এই কারণে যে তাতে ঘটেছিল নানান ধরণের বৈপরীত্যের মাধ্বী সংস্থিতি৷

হ্যাঁ, আসল কথায় ফিরে আসা যাক৷ মহর্ষি অগস্ত্য ঠিক করলেন তিনি বিন্ধ্য পর্বত পার হয়ে দক্ষিণাপথে গিয়ে সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘটাবেন, দক্ষিণাপথকে উত্তরের কাছে টেনে আনবেন৷ তিনি নাকি কৌশিতকীকে বলেছিলেন–‘‘চলো, আমরা দুজনেই যাই’’৷ কৌশিতকী নাকি বলেছিলেন–‘‘না, সেটা ঠিক হবে না৷ দু’জনে এক প্রত্যন্তে গেলে অন্য প্রত্যন্ত খালি থেকে যাবে৷ দক্ষিণাপথে যাবার প্রয়োজন রয়েছে৷ তাই তুমি দক্ষিণাপথে নারী–পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকার সঙ্গে ভাব বিনিময় করো৷ আর আমি উত্তরাপথে থেকে সকলের সঙ্গে ভাব বিনিময় করে যাই’’৷ তাই কৌশিতকী অগস্ত্যের সঙ্গে দক্ষিণাপথে গেলেন না৷ তিনি আর্যাবর্তেই থেকে গেলেন৷

তোমরা জান যে সঙ্গীতের (নৃত্য, বাদ্য ও গীত তিনে মিলে সঙ্গীত) স্রষ্টা শিব আর এ ব্যাপারে তাঁর প্রথম শিষ্য ছিলেন মহর্ষি ভরত৷ এই ভারতীয় সঙ্গীত বা শিবদত্ত সঙ্গীত উত্তর ভারতে একটি ধারায় ও দক্ষিণ ভারতে আরেকটি ধারায় প্রবাহিত৷ তোমরা নিশ্চয়ই জান, গাছ–ফুল–ফল–বীজ সবই দীর্ঘকাল ধরে এক পরিবেশে থাকলে তার মধ্যে একটি পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য জেগে যায়৷ একই ল্যাংড়া আম কাশীতে, বারুইপুরে ও মালদায় দেখবে, ১০০০ বছর পরে তাদের পাতায় বর্ণে স্বাদে গন্ধে অনেক পরিবর্তন এসে যাবে৷ এই পরিবর্তনকে বলি পরিবেশগত পরিবর্তন (environmental change) শিবদত্ত সঙ্গীতও তাই উত্তর ভারতে এক খাতে ও দক্ষিণ ভারতে আরেক খাতে বইছিল৷ উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতকে আর্যাবর্ত সঙ্গীত বা হিন্দুস্তানী সঙ্গীত ও দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতকে দাক্ষিণাত্য সঙ্গীত বা কর্ণাটক সঙ্গীত বলা হয়৷ তেমনি চাল–চলনে, আচার–ব্যবহারে দুয়েতেই কিছুটা environmental change বা পরিবেশগত পরিবর্তন এসেছিল...যা আসা খুবই স্বাভাবিক৷

উত্তর ভারতেও পশ্চিমে ও পূর্বে এই পরিবেশগত পার্থক্য খুবই প্রকট৷ আর এই প্রকটতা বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছিল বাঙলায় যেখানে সভ্যতায় ঘটেছিল ত্রিবেণীসঙ্গম৷ জাত হিসেবে বাঙালী মুখ্যতঃ অষ্ট্রিকো–মংগলো–নিগ্র্৷ যত দূর জানা যায় মহর্ষি অগস্ত্য বাঙলায় আসেননি৷ এলে উত্তর ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে বাঙলার ভাব–বিনিময় অনেকটা বেশী হয়ে যেত৷

যাই হোক, এবার একটু গল্পকথায় আসা যাক৷ গল্পে আছে যে এই বিন্ধ্য পর্বতের শির ছিল উত্তুঙ্গ৷ এ কথা ঠিকই যে প্রাচীন গণ্ডোয়ানাভূমির পাহাড়গুলি ছিল খুবই উঁচু–চির তুহিনাবৃত৷ জলে ঝড়ে উপলসংঘাতে তারা ক্ষয়প্রাপ্ত eroded হতে থাকে৷ তাই আজকের যে বিন্ধ্য তা’ এককালে যে খুবই উঁচু ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই৷ যাই হোক, গল্পকথা অনুযায়ী বিন্ধ্য পর্বত খুবই উঁচু ছিল৷ তাই উত্তর থেকে দক্ষিণে যাওয়া সহজসাধ্য ছিল না৷ মহর্ষি অগস্ত্য যখন বিন্ধ্যের কাছে এলেন, বিন্ধ্য তাঁকে সম্মান জানাবার জন্যে আভূমি প্রণত হ’ল৷ অগস্ত্য চেয়েছিলেন উত্তর–দক্ষিণের ভাব বিনিময়৷ তিনি বিন্ধ্যকে বললেন–জীতে রহো বেটা৷ কিন্তু যতদিন না আমি ফিরছি ততদিন তুমি মাথা নীচু করে থাক৷ আমি দক্ষিণ ভারত থেকে ফিরে এলে এই প্রণামটিতেই তোমার সেই সময়কার প্রণাম সেরে নেওয়া হবে৷

অগস্ত্য দক্ষিণে গেলেন, আর ফিরলেন না৷ বিন্ধ্য মাথা নীচু করে রয়ে গেল, আর উঁচিয়ে উঠল না৷ উত্তরে–দক্ষিণে ভাব বিনিময় অব্যাহত গতিতে চলতে লাগল৷ অগস্ত্য ফিরে এলেন না৷ তাই সেই থেকে কেউ যদি কোথাও গিয়ে আর না ফেরে আমরা তাকে বলি অগস্ত্য–যাত্রা৷

 

যা ভাবছ তা নয়

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘মৃগী’ শব্দের একটি অর্থ হচ্ছে একটি স্নায়ু–সংক্রান্ত মানসিক ব্যাধি, ইংরেজীতে (epilepsy)৷ যদি কোনো কম বয়সের ছেলে বা মেয়ে হঠাৎ কোনো অভাবনীয় কিছু দেখে বা শোনে তাহলে অনেক সময় তার স্নায়ুর ওপর বা মনের ওপর হঠাৎ একটা ৰড় রকমের চাপ এসে পড়ে৷ সেই চাপ সে যদি সহ্য করতে না পারে তখন তার এই মৃগী রোগ দেখা দেয়৷ যেমন ধরো, একটি ১২/১৪ বছরের ছেলের ধারণা ছিল, অমুক লোকটি কোনো নেশার ধারেকাছে যান না৷ হঠাৎ সে দেখলে সেই সংশ্লিষ্ট লোকটি বোতলের পর বোতল মদ খাচ্ছে৷ ফলে তার আগেকার ধারণার ওপর বিরাট একটা হাতুড়ির আঘাত লাগল৷ এর ফলে তার মৃগী রোগ দেখা দিতে পারে৷ কোনো একটি ছেলের ধারণা ছিল যে সে সদ্বংশজাত কিন্তু হঠাৎ সে শুনতে পেলে তার বংশ পরিচয় নেই৷ এই অবস্থায় তার মৃগী রোগ দেখা দিতে পারে৷ মৃগী রোগীর জীবনে স্নায়ুতন্তুর ওপর হঠাৎ কোনো আরামদায়ক পরিস্থিতি এলেই রোগ ফুটে ওঠে৷ কোনো মৃগী রোগীর অনেকক্ষণ ধরে মূত্র ত্যাগের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে৷ কিন্তু উপযুক্ত স্থান না পাওয়ায় মূত্র ত্যাগের সুযোগ পায়নি৷ এখন সে যখন মূত্র ত্যাগের সুযোগ পায় তখন তার স্নায়ুতে একটা আরামের অবস্থা আসে৷ এমন সময় মৃগী রোগী মূত্র ত্যাগ করতে করতে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে যায়৷ কোনো মৃগী রোগী হয়তো দারুণ গরমে কষ্ট পাচ্ছে, এমন সময়ে সেই কষ্ট থেকে বাঁচার জন্যে সে পুকুরে বা নদীতে স্নান করতে গেল৷ জলের সংস্পর্শে এসে তার আরাম ৰোধ হল৷ এমন অবস্থায় রোগগ্রস্ত হয়ে সে জলে পড়ে মৃত্যুমুখে পতিত হতে পারে৷ এই কারণে কোনো মৃগী রোগীকে একলা কখনই কোনো জলাশয়ে স্নান করতে যেতে দিতে নেই৷

‘মৃগী’ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল৷ একবার কৃষ্ণনগরের এক পাঁড় মাতাল ৰেশী মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে রাত্তিরটা নালীতে শুয়ে কাটালে৷ শেষ রাতের মিষ্টি মিষ্টি ফুরফুরে হাওয়া ও ঠান্ডা নালীর জলের মধুর স্পর্শে তার নেশার ঘোর যখন কিছুটা কেটে গেল সে চোখ মেলে চেয়ে দেখলে তাকে ঘিরে লোকের ভীড় জমেছে৷ তার তখন একটু একটু লজ্জা করতে লাগল৷ সে আবার চোখ বুজে ফেললে৷ খানিক বাদে আবার সে চোখ খুলে চাইল৷ চেয়ে দেখলে ভীড়ের লোকেদের ভেতর তার বেয়াই মশায়ও (বৈবাহিক) রয়েছেন৷

এবার তার লজ্জার মাত্রা গেল আরও ৰেড়ে৷ বেয়াই তাহলে আসল ব্যাপারটা জেনেই ফেলেছে৷ এবার কী হবে! সে তখন বেয়াইয়ের দিকে চেয়ে বললে–বেয়াই, ও বেয়াই, বেয়াই গো, শুনছ, তুমি যা ভাবছ এটি তা নয়–এ আমার মৃগী রোগ৷

                                       (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘গল্প সঞ্চয়ন’ থেকে)

পরোপকারী

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

কোলকাতার বউবাজারের পথে দাঁড়িয়ে এক সবজিওয়ালা চেঁচাতে লাগলো---বাবু, আমার ঝাঁকাটা একটু মাথায় তুলে দিন না..? ও বাবু, একবারটি ধরুন-না ঝাঁকাটা?...

সবজিওয়ালা যাচ্ছিল বাজারে৷ পথে এক ক্রেতার কথামতো ঝাঁকাটা নামিয়েছিল৷ ক্রেতা জিনিস কিনে চলে যাবার পর আর সে পারলো না ঝাঁকাটা তুলতে৷ ঝাঁকাটা বেশ ভারি ছিল কিনা৷

সামনে দিয়ে যেই যায় তাকেই সবজিওয়ালা অনুরোধ করে, বাবু, ঝাঁকাটা একটু তুলে দিন-না?

কিন্তু কেউই তার কথায় কান দিল না৷ সকলেই ব্যস্ত৷ বিশেষত একটা মুখ্যু গেঁয়ো চাষীর ঝাঁকা তুলে মান হারাতে এগিয়ে এলোনা কেউই, পরোপকারের চাইতে আত্মসম্মানটা এতোই বড়!

অগত্যা কি আর করা যায়৷ দেরি হলে বাজারে জায়গা মিলবে না আনাজও বিক্রি হবে না৷ সবজিওয়ালা তাই হতাশ মনে নিজেই ঝাঁকাটা তুলতে লাগলো৷ কিন্তু বারবারই সে বিফল হলো৷

এমন সময় চোগা চাপ কান-পরা এক ফিটফাট ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন বললেন, নাও তোলো আমি ধরছি৷

সবজিওয়ালা তো অবাক! এমন ঝকঝকে তকতকে বাবু কিনা তার ময়লা ঝুড়িতে হাত লাগালো৷

ঝাঁকাটা মাথায় তুলে সবজিওয়ালা বাবুকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানালো৷

জানো, কে এই বাবুটি? ইনিই হলেন রাজা রামমোহন রায়৷ মানুষের সেবা, মানুষের উপকারে তিনি কখনো পরাঙ্মুখ হতেন না৷ মানুষ যখন অসহায় তখন তাকে সাহায্য করাই তিনি পবিত্র কর্তব্য মনে করতেন---সেক্ষেত্রে ঠুনকো আত্মমর্যাদা বা বাবুয়ানাতে তিনি মোটেই প্রশ্রয় দিতেন না৷ এটাই যথার্থ শিক্ষা৷ আশা করি, এই শিক্ষাই রাজা রামমোহনের জীবন থেকে তোমরা গ্রহণ করবে৷

মধুময় প্রীতি

লেখক
সুকুমার রায়

রাতের কালোয় খুঁজি আলো

আর সহে না, প্রদীপ জ্বালো

মন মানে না চলব দুলে,

অনিত্য ধরার, দোয়ার খুলে

নবিন আশায়, নবিন দেশে

নন্দনলোকের ছন্দে মিশে৷

তুমি হে, প্রিয়তম মোর এসেছ ধরায়

প্রীতিতে বেঁধেছ সবারে স্নেহচ্ছায়,

জানিনা কত আনন্দ ওগো, তোমার তরে

দাও সে নয়ন জোরে দেখি প্রাণভরে,

সুখে-দুঃখে তুমি সবার চিরসাথী

যুগে যুগে এসেছ নিয়ে মধুময় প্রীতি৷

 

জাগাও মানবতা

লেখক
কৌশিক খাটুয়া

তিরিশে এপ্রিল আসে--------

ভারাক্রান্ত মনে স্মরণ বেলায় অশ্রুতে আঁখি ভাসে৷

অসহায় প্রাণ জর্জরিত হল

নির্মম আঘাতে,

মর্ত্যভূমির বীর পুঙ্গবেরা ছিল নাতো রাজপথে!

পরমাত্মা ও মহাত্মার মাঝে পাপাত্মা করে খেলা,

অহংকারের মিথ্যা দম্ভে অপকর্ম সারা বেলা৷

জড়বাদী মন থাকে সর্বক্ষণ

পাপাচারে আবদ্ধ,

কোনো বিরোধিতা মানিতে নারাজ

শুনিলেই হয় ক্ষুব্ধ!

পরের স্বার্থে দধীচির দান

দেবাত্মারই ধর্ম,

ধরনীতে তাঁরা আসা যাওয়া করেন

সারিতে আপন কর্ম৷

প্রাতঃস্মরণীয় চির বরনীয়

মহারণে জয়ী বীর,

মহাপ্রেরণায় তাঁহাদের ন্যায়

উন্নত হোক শির৷

তিরিশে এপ্রিল আসে বারেবারে --

ডাক দিয়ে যায় মানবতার দ্বারে

জাগ্রত হোক সুপ্ত মানবতার,

আসুরিক শক্তি বিলোপ সাধনে

জীবন উৎসর্গ হোক বারংবার৷

ব্যথিত হৃদয়ে মানুষের আজ শপথ নেওয়ার দিন,

সময় হয়েছে শুধিতে হবে অতীতের রক্ত ঋণ৷

গাওয়াও আমায় গান

লেখক
প্রণবকান্তি দাশগুপ্ত

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান--       

যেই গানেতে প্রাণে প্রাণে জাগবে মহাপ্রাণ--

যেই গানেতে ফুটবে আশা

মধুর হবে ভালবাসা---

যেই গানেতে আমার তো নয় তোমারি সম্মান৷

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান৷৷

আড়াল হতে বাজিয়ে বাঁশী

জীবনে মোর দাঁড়াও আসি,

সংঘাতে সংঘাতে তোলো এগিয়ে চলার তান৷

গাওয়াও আমায় জীবন ভরে গাওয়াও আমায় গান৷৷