‘কাঁচা বেঁশো হ্যাংলামি
‘ক্রুড্’ ধাতুর একটি অর্থ ‘হ্যাংলামি করা’ বা ‘ন্যালা খ্যাপামি করা’ –কাঁচা বাঁশের মত হ্যাংলামি বা ন্যালা খ্যাপামি যা শুণলেই বোঝা যায়, দেখলেই ধরা যায় অথবা এমনও কেউ কেউ থাকে যারা ধরা পড়বার জন্যেই এই রকম হ্যাংলামি বা ন্যালাখ্যাপামি করে থাকে৷ যেমন নেম্তন্ন বাড়ীতে তোমার আরও কয়েকটা রসগোল্লা খাবার ইচ্ছে হল৷ তুমি পাশের ভদ্রলোকটির পাত দেখিয়ে বললে......ও দাদা, এদিকে, এদিকে, এঁর পাতে কয়েকটা রসগোল্লা দিন৷
রসগোল্লা পরিবেশনকারী কাছে এলে তাকে বললে–আমায় আর দেওয়া কেন! আমার পাতে পরে দেবেন (আসলে পরিবেশনকারী তাকে দিতে আসেন নি, এসেছিলেন পাশের লোকটিকে দিতে)৷ পরিবেশনকারী দিতে গেলে বললে–না, আমার আর চাই না, পেট ভরে গেছে৷ আবার হ্যাংলামি করে বললে–তা দেবেন যখন অন্ততঃ চারটে দিন৷ একগণ্ডার কমে কি ভাল দেখায়! এতে পরিবেশনকারী বুঝে নিলেন, যিনি পরিবেশনকারীকে ডেকেছিলেন তাঁরই রসগোল্লা দরকার......আর চারটে দরকার৷ এই ধরণের হ্যাংলামির জন্যে ক্রুড/ক্রুড়, শব্দটি চলবে৷ চলবে ক্রুূযৎ ঞ্চ ক্রড্য শব্দটিও (ক্রুড়া হয় না)৷ একবার দেখেছিলুম জনৈকা মহিলা–তিনি ছিলেন একজন মস্তবড় অফিসারের মাতাঠাকুরাণী–একজন মধ্যবিত্তের বাড়ীতে গিয়ে তার লক্লকে লাউগাছটি দেখে বলেছিলেন–লাউ–এর ডগাগুলো ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে তো৷ পোস্ত–বাটার সঙ্গে লাউডগা সেদ্ধ খেতে খুব ভাল লাগে৷ চাকরটাকে রোজই বাজারে পাঠাই৷ এসে বলে বাজারে আজকাল লাউডগা পাওয়া যাচ্ছে না৷ লাউডগা–পোস্ত সেই যে কোন মান্ধাতার আমলে খেয়েছিলুম, আজও যেন জিবে লেগে আছে৷ লাউ–ডগার মালিক কি আর করেন! মহিলার সঙ্গে কিছু লাউডগা পাঠিয়ে দিলেন৷ যাই হোক, এই কাঁচাবেঁশো হ্যাংলামি ভালভাবেই বুঝলে৷ সুতরাং ওই হ্যাংলা মহিলা হচ্ছেন ‘ক্রুড্যা’৷
আমার পরিচিত ভোলা মোড়লের ভাল রকমের বেগুনের চাষ ছিল৷ বর্ষার শেষে একদিন সে তার বেগুনবাড়ী থেকে বছরের প্রথম ফসলটি তুলে নিয়ে বাড়ীর দিকে যাচ্ছিল৷ আশা করেছিল, বর্ধমানের বাজারে নতুন মুক্তকেশী বেগুনের ভালই দর পাবে........তার একটু টেনেটুনে সংসার চলত৷ রাস্তায় সে পড়ে গেল হরু ভটচাজের খপ্পরে৷ হরু ভট্চাজ্ বললে–কি রে ভোলা, আজকাল তোর দেমাগে যে মাটিতে পা–ই পড়ে না৷ বামুন–বোষ্টমের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি হারালে ফল কি ভাল হয় জানিস তো মাথার ওপর নারায়ণ রয়েছেন৷ তিনি আমাকেও দেখছেন, তোকেও দেখছেন, বেগুনগুলোকেও দেখছেন৷ যাই হোক, বেগুনগুলো বেশ তেল কুচকুচে৷ কম আঁাঁচে পোড়াতে গেলে গায়ে তেলও মাখাতে হবে না৷ তা তু’ এক কাজ কর গা৷ আমাকে বেগুনগুলো দিতে হবে না৷ তু’ ওগুলো পুড়িয়ে যেন আমার প্রসাদ খাচ্ছিস ভেবে নিজেই খা গা যা৷ ভোলা মোড়ল আর কি করে! তার বুকের পাঁজর–ভাঙ্গা আট–দশটা বেগুন হরু ভটচাজকে দিয়ে দিলে৷ এই হরু ভটচাজ ছিল একটি নির্ভেজাল ‘ক্রুডা’৷
কোন একটা বিয়ে বাড়ীতে ভিয়েন বসেছে৷ অনিমন্ত্রিত পুণ্ডরীকাক্ষ ভট্টাচার্য্য হঠাৎ সেখানে পৌঁছে গেলেন৷ পুণ্ডু ভট্চাজ্ ছিলেন আমাদেরই বর্ধমান জেলার পুতুণ্ডু গ্রামের বাসিন্দে৷ মস্ত বড় ভিয়েন, কলকাতা থেকে বাছাইকরা হালুইকারেরা এসেছে৷
পুণ্ডু ভটচাজ্ বললেন–খাওয়াদাওয়ায় আমার তেমন আগ্রহ নেই৷ কিন্তু রান্নাবান্না দেখতে বড্ড ভালবাসি.....সেই ছোটবেলাকার স্বভাব৷
সবাই বললে–এসো, এসো, বসো, বসো৷ দেখো, কেমন খাবার তৈরী হচ্ছে৷
দেখে বোঝা গেল হালুইকারেরা খুব উন্নত মানের চমচম (সংস্কৃতে ‘চম্’ ধাতু হ’ল গোগ্রাসে গিলে খাওয়া৷ একপক্ষের সৈন্য অন্য পক্ষের দেশে গিয়ে সব কিছুকে গোগ্রাসে গিলে খায়৷ এই অর্থে চম্ ধাতুূউস্ প্রত্যয় করে ‘চম্’ শব্দটি পাচ্ছি৷ ‘চমু’ মানে সৈন্যবাহিনী৷ ‘চমূড্ণ্’ করে ‘চম্’ শব্দটি পাচ্ছি, অর্থাৎ যা দেখে গোগ্রাসে গিলে খেতে লোকের ইচ্ছে হয়৷) তৈরী করছে৷ পুণ্ডু ভট্চাজ্ আর নোলা সামলাতে পারছে না৷ প্রাণে আকুতি জেগেছে, চমচম একেবারে খোলা থেকে নোলায় চলে আসুক৷ সে তখন স্বগতভাবে বললে, (বললে এমন ভাবে যাতে আর পাঁচটা লোকের বধির কর্ণেও তা প্রবেশ করে)–এককালে চমচম খেতে খুবই ভালবাসতুম৷ কবে সেই খেয়েছিলুম.......বাহাৰপুরের ঘোষেদের বাড়ীতে৷ এখনও যেন ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারছি না৷ মন বারে বারে সেই চমচমে ফিরে যেতে চায়৷ এখন দু’চারটে চাখতে পারতুম কিন্তু সন্ধ্যে হয় হয়৷ সন্ধ্যে আহ্ণিক না করে খাই বা কি করে– তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে–সে কথাও ভুলি কি করে৷
হালুইকারেরা বললে–সন্ধ্যে হতে এখনও একটু দেরী আছে৷
পুণ্ডু ভটচায্ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললে–হ্যাঁ মনে হয় আধঘন্টাটাক সময় আছে৷
হালুইকারেরা বললে–তৰে দুটো সন্দেশ চেখেই দেখুন৷ আমার মনে হয় গণ্ডাখানেক চেখে নিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফেলাও সম্ভব৷
হালুইকারেরা কি আর করে! পুণ্ডু ভট্চাজ্কে একটা শাল পাতায় মুড়ে চারটে চমচম দিলে৷ এও সেই কাঁচা বেঁশো হ্যাংলামি৷ পুণ্ডুরীকাক্ষ ভট্টাচার্য হলেন একটি ডাকসাইটে ‘ক্রুড্ড’৷ যাই হোক, তোমরা ‘ক্রুড্’ ধাতুর রকমারি ব্যবহার দেখলে তো৷ (শব্দ চয়নিকা)