মহান ব্যক্তিদের অধিকারী বাবা সাহেব আম্বেদকরের স্মরণে

লেখক
প্রভাত খাঁ

আমরা আজ বয়েসে কিছুটা প্রবীন তাই দেখা যাচ্ছে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব জ্ঞানহীন আচরণ যা আমাদের সত্যিই লজ্জিত করে৷ পবিত্র লোকসভায় বেশ কিছুটা আত্মহংকারীর মতো সংসদের মর্যাদাহানি করে কাজ করেন নিছক পদের লোভে ক্ষমতার মোহে৷ সংসদে আসার আগে নির্র্বচনে জয়ী হতে জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এরা সহজেই ভুলে যায়৷ সংসদে বসে সেকথা মনে করার প্রয়োজন বোধ করেন না৷

বিরোধী দলের সাংসদরাও ভাবেনা তাদের উৎশৃঙ্খল অসংযম আচরণে লোকসভার আসল কাজটি বন্ধ হবে৷ তাতে বিশেষ করে শাসকদেরই লাভ৷ কারণ দেশ শাসনের ক্ষেত্রে দলতান্ত্রিক সরকারগুলো একেবারেই ব্যর্থ! তাদের লক্ষ্যটা শুধু গদীতে বসে দাদাগিরি করা আর দলের স্বার্থসিদ্ধি করা৷ বিরোধী দলের প্রধান কাজ তাদের নিজ এলাকার জনগণের অভাব অভিযোগ ও তাদের প্রয়োজনের কথা সংসদে তুলে ধরা৷  

ভারতের ৭৫ বছর সংবিধান দিবস উপলক্ষ্যে  রাজ্য সভায় আলোচনা সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাননীয় অমিত শাহ বলেন--- এখন একটা ফ্যাশন হয়েছে আম্বেদকর, এত বার ভগবানের নাম নিলে সাত জন্ম পর্যন্ত স্বর্গ লাভ হত৷ শাহের এই মন্তব্যে ৰাৰা সাহেব আম্বেদকরকে তাচ্ছিল্য ও অসম্মান করা হয়েছে৷ এই নিয়ে বিরোধীরা সাংসদ তোলপাড় করছে ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করছেন৷ বিরোধীদের প্রতিবাদ ও দাবী অযৌক্তিক নয়৷ কারণ ৰাৰা সাহেব আম্বেদকর শুধুমাত্র  দেশের একজন সাধারণ নাগরিক নন, আজ রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে যে সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে  আম্বেদকর সেই সংবিধানের অন্যতম স্থপতি৷ তাই তাঁর সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে গেলে তাঁর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সম্মান রেখে করা উচিত৷ বিশেষ করে যাঁরা সাংসদের প্রতিনিধি তাঁদের সংবিধানের প্রতি আস্থা জানিয়ে শপথ নিতে হয়৷ অমিত শাহ সংসদের একজন সাধারণ সদস্য নন, তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও৷ সংবিধান মেনে রাষ্ট্র চলছে কিনা সেটা দেখারও দায়িত্ব তার৷ সেই সংবিধানের প্রণেতার প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর যদি শ্রদ্ধা না থাকে তাহলে সেই সংবিধানের প্রতি তিনি কতটা দায়বদ্ধ আছেন এ নিয়ে প্রশ্ণ তোলা অবান্তর নয়৷ আমার মনে হয় এক দেশ এক নির্বাচনের আইন প্রণয়ণ করতে সংসদে প্রয়োজনীয় সাংসদের সমর্থন না পাওয়ার ব্যর্থতায়  ধৈর্য্য হারিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দায়িত্ব জ্ঞান হীন মন্তব্য করেছেন৷

যাই হোক সাংসদে শাসক বিরোধী দলে বাঘবিতণ্ডা চলতে থাকুক৷ আমি এই অবসরে এরই উপর অন্য প্রসঙ্গে কিছু বলতে চাই৷ তা হলো এদেশের অন্ধ জাত-পাতের এতটাই নির্মম অত্যাচার ছিল সেই অতীতে যা কহতব্য নয়৷ দেশের বর্তমান শাসক দলের অনেক নেতা মন্ত্রীও  এখনও সে জাতপাতের ঊধের্ব উঠে নিজেকে বৃহৎ মানব সমাজের একজন মনে করতে পারেন না৷ তাই আজও বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিম ভারতে সামান্য কারণেই দলিতদের ওপর উচ্চবর্ণের নির্যাতন নেমে আসে, তাদের আজও সমাজে অচ্যুত করে রেখে দেওয়া হয়৷

মাননীয় বাবা সাহেব আম্বেদকর ছিলেন সেই দলিত নিম্নবর্ণের একজন অতি প্রতিভাবান সন্তান৷ সেই সময়ে তিনি শুধু বুদ্ধিতে  উন্নতমানের ছিলেন তাই নয় আচার-আচরণ ও চাল-চলনেও উচ্চ মনের ছিলেন৷ যে কারণে শিক্ষার জগতে তিনি ছিলেন এক চরম বিস্ময়!  কিন্তু জীবনে বিশেষ করে সমাজ জীবনে  তাঁকে প্রতিক্ষেত্রে চরম অবহেলিত হতে হতো! তৃষ্ণার পানীয় জলটুকু পর্যন্ত খেতে পারতেন না৷  তাঁকে  উচ্চ বর্নের কৃপার পাত্র হয়ে অপেক্ষা করতে হত৷ এতটাই অন্ধবিশ্বাস জাতপাত কুসংস্কার এই হিন্দুস্থানে বিরাজ করতো৷ কিন্তু কোন অশুভ শক্তি প্রতিভাকে দমিয়ে রাখতে পারেনা৷ তাই সব রকম সামাজিক বাধাকে অতিক্রম করে ঈশ্বরের আশীর্বাদে ও প্রতিভাগুণে ভারতবর্ষের একজন বিখ্যাত আইনজ্ঞ হয়ে ওঠেন স্থানীয় মহারাজার সাহায্যে৷ তাঁর পিতৃদেব ছিলেন একজন সৈনিক৷ আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী মাননীয় জহরলাল নেহেরু দেশের সংবিধান রচনার জন্য যে গণ পরিষদ ঘটন করেন সেখানে বাবাসাহেব আম্বেদকরকে সভাপতি করেন৷ ২৪৮ জন জ্ঞানীগুণী পুরুষ মহিলা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সংবিধান প্রায় তিন বছর ধরে সম্পাদন করেন৷ সেই পবিত্র সংবিধানকে লোকসভায় আলোচনান্তে গত ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয় ও গৃহীত হয় সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ও প্রজাতান্ত্রিক ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান হিসাবে৷ তাই প্রতি বছর ২৬শে জানুয়ারী প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয়৷

এই সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো--- বহু ভাষা-ভাষী ধর্মমতের দেশ হওয়ায় ভারতীয় সংবিধানে ভারতবর্ষকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু দুঃখের বিষয় সংবিধানের এই ধারাকে দেশের বর্তমান শাসক দল পদে পদে অবহেলা করে চলেছেন৷

বাবা সাহেব আম্বেদকর উচ্চ বর্ণের ঘৃণা, অবহেলা ও অত্যাচারে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হন৷

এই প্রসঙ্গে বাঙলার মহান সমাজ বিপ্লবী আধুনিক ভারতের জনক রাজা রামমোহন রায় কে স্মরণ করা যেতে পারে৷ যিনি হিন্দু ধর্মমতের নিষ্ঠুরতম কুপ্রথা সতীদাহ বন্ধ করেছিলেন শত অত্যাচার সহ্য করে ও কুসংস্কার মুক্ত ব্রাহ্মধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন৷

দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু দেশ চালনায় অনেক ত্রুটি থাকলেও সংবিধানের এই ধারাকে কখনও লঙ্ঘন করেননি৷ তাই আম্বেদকরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে সম্মানিত করেছিলেন৷ পরিশেষে বলি--- ভারতীয় জনগণের সার্বিক বিকাশ নিয়ে আলোচনা ও পরিকল্পনা গ্রহণের পবিত্র স্থান লোকসভা রাজ্যসভা ও রাজ্যস্তরে বিধানসভা৷ কিন্তু আমার প্রশ্ণ সংসদ চলাকালীন বিকাশ নিয়ে আলোচনা হয় কি?