মনে পড়ে !

লেখক
পথিক বর

২৪শে সেপ্ঢেম্বর ১৯৩২ সাল, রাত্রি ১১টা৷ চারিদিক নিস্তব্ধ, নিঃঝুম৷ শুধু চট্টগ্রাম শহরে পাহাড়তলী ইনষ্টিটিউট নামের ইয়ূরোপিয়ন ক্লাবে মত্ত একদল ইয়ূরোপীয়নের নাচগান আর কোলাহলের শব্দ রাতের নিস্তব্ধতাকে ভেদ করে ভেসে আসছে৷

পরাধীনতারজ্বালা, জালিয়ান- ওয়ালাবাগের ক্ষত বুকে নিয়ে জনা দশেক তরুণ চুপি চুপি রাতের অন্ধকারে ক্লাবের সামনে এসে পৌঁছালো৷ নিরপরাধ দেশবাসীর রক্তে যারা দেশমাতৃকার কোল ভিজিয়েছে আজ তাদের জবাব দেবার সময় আসন্ন৷ বাঙালী শুধু মার খেতে জানে না, মার দিতেও জানে৷ প্রহরীদের চোখে ফাঁকি দিয়ে ক্লাব ঘরে প্রবেশ করল তরুণের দল৷

প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল পাহাড়তলীয় আশপাশ৷ বোমা, গুলির শব্দে মত্ত কোলাহল তখন আতঙ্ক আর আর্তনাদে পরিণত হয়েছে৷ আহত, নিহত বেশ কয়েকজন৷ জালিয়ান- ওয়ালাবাগের জ্বালা একটু বুঝুক শেতাঙ্গগুলো৷ পাল্টা মারের বাঙলাকে দেখে সেদিন সূর্য অস্ত না যাওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসকেরও বুকে কাঁপন ধরেছিল৷ রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে বোমা, গুলি আর আহত শেতাঙ্গদের আর্তনাদ জানিয়ে দিয়ে গেল বাঙলা কখনও মাথা নত করে না৷ মুখ বুজে মারও খায় না৷

কাজ শেষ করে ফিরে গেল সবাই৷ কিন্তু না! একজন আর ফিরে যাননি৷ দেখতে দেখতে ক্লাবের চারিদিক ঘিরে ফেলল মিলিটারীর দল৷ হঠাৎ মিলিটারীর চোখে পড়ল ক্লাবের বাইরে একটু দূরে কে যেন পড়ে আছে৷ ছুটে গেল মিলিটারীর দল৷ যদি পাওয়া যায় একটাকে৷ না, জীবিত গ্রেপ্তারের কোনও সুযোগ নেই৷ কিন্তু চোখ কপালে উঠল মিলিটারীর! এতো পুরুষ পোষাকে সজ্জিতা একটি মেয়ে৷

হ্যাঁ, সেদিন ইয়ূরোপীয়ান ক্লাবে আক্রমণে অংশগ্রহণকারী দলের সর্বাধিনায়িকা পরাধীন ভারতবর্ষে প্রথম নারী  শহীদ চট্টগ্রামের অগ্ণিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার৷ বয়স মাত্র ২০ বছর৷ পিতা জগৎবন্ধু ওয়াদ্দেদার৷ পরাধীন দেশের মুক্তির জন্যে আত্মবিসর্জন দেবার আগের দিন প্রীতিলতা গোপন আস্তানা থেকে মাকে লিখেছিলেন---

মাগো, তুমি আমায় ডাকছিলে? আমার মনে হ’ল তুমি আমার শিয়রে বসে কেবলি আমার নাম ধরে ডাকছ৷ ..... আমার অভাব যে তোমাকে পাগল করে তুলেছে তা আমি জানি৷ মাগো, আমি শুনেছি, তুমি ঘরের দরজায় বসে সবাইকে ডেকে ডেকে বলছ---‘ওগো তোমরা আমার রাণী শূন্য রাজ্য দেখে যাও৷’

তোমার সেই ছবি আমার চোখের ওপর দিন-রাত ভাসছে৷ তোমার এই কথাগুলো আমার হৃদয়ের প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে কান্নার সুর তোলে৷

মাগো, তুমি অমন করে কেঁদ না৷ আমি যে সত্যের জন্যে---স্বাধীনতার জন্যে প্রাণ দিতে এসেছি, তুমি কি তাতে আনন্দ পাও না?

কী করবে মা? দেশ যে পরাধীন! দেশবাসী যে বিদেশীর অত্যাচারে জর্জরিত! দেশমাতৃকা যে শৃঙ্খলভারে অবনতা, লাঞ্ছিতা, অবমানিতা!

তুমি কি সবই নীরবে সহ্য করবে মা? একটি সন্তানকেও কি তুমি মুক্তির জন্যে উৎসর্গ করতে পারবে না? তুমি কি কেবলই কাঁদবে?

মায়ের কান্না কী আজও থেমেছে? এত আত্মত্যাগের পরিণতি কি এই! আজ  স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার জন্যে বাঙালীকে  রেশন কার্ড ভোটার কার্ড হাতে লাইনে দাঁড়াতে  হচ্ছে৷ আত্মবিস্মৃত বাঙালীর  একবার কি মনে পড়ে না , স্বাধীনতার  জন্যে তার পূর্ব পুরুষের  আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জনের  ইতিহাস!