নারী ঃ শোষণ ও তার মুক্তির পথ

লেখক
পত্রিকা প্রিতিনিধি

 

‘‘বিশ্বে যাহা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণ কর

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,

অর্ধেক তার নর৷৷’’

কাজী নজরুল ইসলামের এই উক্তি মানুষের সমাজের জন্যে অত্যন্তই গুরুত্বপূর্ণ৷ এইভাবে মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন–‘‘সমানম্ এজতি ইতি সমাজঃ’’৷ সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চলার নামই হচ্ছে সমাজ৷ মানুষের গড়া এই সমাজ আসলে নারী–পুরুষের মিলিত রূপ৷ নারী ও পুরুষকে এই সমাজের সমাজরূপী পাখীর দু’টি ডানা বলতে পারি৷ আর এই সমাজকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে গিয়ে নারী–পুরুষ একে অন্যের ওপর সমনির্ভরশীল৷ একজনকে বাদ দিয়ে যেমন আর একজন নয় তেমনি কাউকে ছোট করে কাউকে বড় করাও নয়৷ নারী–পুরুষ উভয়েই পরমপুরুষের সন্তান৷ পরমপুরুষ উভয়ের মধ্যে শক্তি, সামর্থ্য, বুদ্ধি সমানভাবেই দিয়েছেন৷ তাই নারী–পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক৷ অন্যথায় পরমপুরুষের এই সৃষ্টি ধ্বংস ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷

বর্তমানে নারী স্বাধীনতা, স্বাধিকার, প্রগতি প্রভৃতি নিয়ে সারা বিশ্বে তোলপাড় চলছে৷ পক্ষে–বিপক্ষে তর্ক–বিতর্কের অন্ত নেই৷ প্রকাশিত হয়ে চলেছে অজস্র পুস্তক, পত্রিকা৷ আবার মিছিল, মিটিং, আন্দোলন তো লেগেই রয়েছে৷ নারীর জন্যে বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থাও চলছে৷ কিন্তু এটাই নারী শোষণ বন্ধ করার একমাত্র পথ নয়৷ এজন্যে দরকার ইতিহাসকে পর্য্যালোচনা করে প্রকৃত ও স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজা৷

প্রাক্ ঐতিহাসিক যুগে নারী–পুরুষ অন্যান্য জীবের মতই স্বৈরী–স্বৈরিণীর জীবনযাপন করত৷ তখনও সমাজ সংরচনা হয়নি৷ কিন্তু সে যুগে নারী–পুরুষের মধ্যে বিভেদ বৈষম্য বিন্দুমাত্র ছিল না৷ একে অন্যের সঙ্গে নির্দ্বিধায় ভাব বিনিময় করত৷ এরপর আসে প্রথম মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা৷ মানুষের সামাজিক মান–মর্য্যাদা, দায়াধিকার ব্যবস্থা সব কিছুই ছিল মাতৃতান্ত্রিক রীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে৷ সে যুগের নারীর কদর ছিল ষোল আনা কিন্তু পুরুষের অধিকার ছিল সংকুচিত৷ এরপর এল পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষ শাসিত সমাজব্যবস্থা৷ আজ থেকে প্রায় ৭০০০ বছর আগে ভগবান সদাশিব ছিলেন প্রথম বিবাহিত পুরুষ৷ তার আগে কোন বিবাহিত পুরুষ ছিল না৷ তাই কোন পুরুষই পারিবারিক দায়িত্ব বলতে যা বোঝায় তা বড় একটা নিত না৷ হয়তো বা পশুদের মত অল্প–স্বল্প দায়িত্ব নিত৷ ভগবান সদাশিব কিন্তু নারী–পুরুষকে সমান অধিকার দিয়ে গেলেন৷ শুধু সমান অধিকার নয় আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রেও তার সন্তান ভৈরব ও ভৈরবীকে তিনি একই তন্ত্র সাধনা শিখিয়েছিলেন৷

ক্ষত্রিয় যুগের দাম্পত্য ব্যবস্থায় নারী ছিল পুরুষের সাহায্যকারিনী তথা সহকর্মীনি অর্থাৎ এই যুগে নারী ছিল পুরুষের ছায়া৷ এমন কি সে যুগে নারী–পুরুষের পাশে বসে যজ্ঞে আহুতি দিয়েছে, মন্ত্র সংরচনা ও শাস্ত্র পাঠ করেছে, সেই সঙ্গে নারী সমাজের মধ্যে জ্ঞান বিতরণও করেছে৷ তাই সে যুগে নারীকে পুরুষের মূল্যবান সম্পদ বলে মনে করা হত৷

এরপর এল বিপ্রযুগ৷ এই যুগে কাগজে কলমে নারীকে সহধর্মিনী বলা হলেও কার্যক্ষেত্রে নারী হয়ে দাঁড়ালো চাকরানী বা বাঁদী৷ বিপ্রযুগে নারীর বৌদ্ধিক পরাজয়ের সাথে সাথে হ্রাস পেল সামাজিক মর্য্যাদা৷ নারীর ইজ্জত হয়ে দাঁড়ালো পুরুষের হাতের খেলনা৷ এই যুগেই প্রথম গণিকা বৃত্তির সৃষ্টি হয়৷ ছিনিয়ে নেওয়া হ’ল নারীর জ্ঞানচর্চা, যাগযজ্ঞ প্রভৃতি করার অধিকার৷ নারীর জীবনে ঘনিয়ে এল দুর্বিষহ অন্ধকার৷ শুরু হ’ল পর্দাপ্রথা, নারীরা ঘরের বাহিরে বের হতে পারবে না৷ এমন কি গঙ্গাস্নান করতে হলেও নারীদের পাল্কিসহ চুবিয়ে আনা হত৷ সেই সঙ্গে এল বাল্যবিবাহ, সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি৷

বিপ্রযুগের পুরুষের এই দাপট বৈশ্য যুগেও অপরিবর্তিত থেকে গেল৷ এ যুগে নারী পুরুষের পণ্যে পরিণত হ’ল৷ বেড়ে চলল পণপ্রথার প্রকোপ৷ সেই সঙ্গে সমাজে এল নারীর অশ্লীল নগ্ণ চিত্র৷

আজকের এই বৈশ্য যুগে চরম নারী শোষণ থেকে মুক্তির প্রকৃত পথ দেখিয়েছেন মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ তিনি বলেছেন, ‘‘মানব ইতিহাসে আমরা দেখেছি, নারীরা কেবল নারীত্বকে গৌরবান্বিত করেনি, সমস্ত মানবজাতিকে গৌরবান্বিত করেছে৷ দর্শনে, আধ্যাত্মিকতায়, সমাজ সংস্কারে, শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে কোথাও নারীরা পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই৷ জটিল দার্শনিক তত্ত্বের সমাধানেই হোক বা সামাজিক শিক্ষা, নৈতিক সংস্কারই হোক–সর্বক্ষেত্রেই মেয়েরা পুরুষের মতই সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছে৷ বিপদে আপদে পুরুষকে প্রেরণা যোগাতেও নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য্য৷ পুরুষের মত নারীর মধ্যেও প্রভূত সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে৷ কিন্তু ইতিহাসের ধারা প্রবাহে আমরা দেখেছি সারা পৃথিবী জুড়ে নারীদের ওপর শোষণের মর্মান্তিক চিত্র৷ নারীদের ওপর এ ধরনের অবদমন ও ভাবজড়তার সাহায্যে তাদের ওপর মানস–র্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো উচিত৷ এই ভাবজড়তার বিলোপের জন্যেই ও মানসিক শোষণের কবল থেকে নারী ও নারীত্বকে মুক্ত করতে যা চাই তা হ’ল ঃ–

প্ত বিশ্বের সমস্ত দেশেই সমস্ত নারীর জন্যে অবৈতনিক শিক্ষা৷

প্ত সামাজিক, শিক্ষাগত ও ধর্মমতের ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার বৈষম্যের অবসান৷

প্ত সমস্ত নারীর অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা৷’’

একথা তিনি শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত হন নি৷ এর বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তিনি দিলেন গার্লস প্রাউটিষ্ট সংঘটন৷ এই গার্লস প্রাউটিষ্টদের প্রথম কাজ নারীর মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে এক বৈপ্লবিক সমাজ চেতনা৷ নারীদের নব প্রেরণায় উজ্জীবিত করে সর্বপ্রকার দাসত্বের বন্ধন ও ভাবজড়তাগুলোকে নিশ্চিহ্ণ করে মাথা উঁচু করে দাঁড় করাতে হবে৷ নারী–পুরুষের মধ্যে সমমৈত্রী ভিত্তিক সহযোগিতা ন্তুপ্স–প্সব্জস্তুনুত্র্ ন্তুপ্স–প্সহ্মন্দ্বব্জ্ত্ নূতন যুগের সূচনা করতে হবে৷

আজকের নারী জাতি হয়ে উঠুক বিপ্লবের অগ্রদূত৷ গৌরব উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে নারী জাতির এই অভূ্যত্থান আজ খুবই অত্যাবশ্যক৷