নারীর মর্র্যদা

লেখক
ফরিদা নার্গিস

চলমান বিশ্বে কোনা কিছুই স্থির নয়৷ দেশকাল পাত্রের পরিবর্তনে সবকিছুই বদলায়৷ যা বদলায় না, তাই পরিণত হয় রক্ষণশীলতায়, সাম্প্রদায়িকতায়৷ সুতরাং বদলকে, পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোই যুগধর্ম৷

সম্প্রতি ভারতের সর্র্বেচ্চ আদালত মুসলীম মহিলাদের পক্ষে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা বন্ধের পক্ষে যে রায় দিয়েছেন তাকে প্রায় সমগ্র মুসলীম মহিলারা স্বাগত জানিয়েছেন৷ দু-একটি বাদে প্রায় বেশিরভাগ মুসলিম ধর্মীয় সংঘটনও এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন৷ খুশি হতে পারেনি কেবল কতিপয় গোঁড়া মুসলীম আর তাদের তাঁবেদার পুরুষতান্ত্রিকতার কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী যারা বলছেন, এই লড়াই মুসলীম মহিলাদের, রাষ্ট্র বা সরকারের তাতে নাক গলাবার এক্তিয়ার নেই৷

কিন্তু আজকের যুগধর্ম একথা মানতে নারাজ৷  আজকের যুগধর্ম চায় রাষ্ট্র তার সমস্ত নাগরিকের যাবতীয় সুরক্ষার ব্যবস্থা করুক৷ তা সে নাগরিক নর বা নারী যেই হোক না কেন৷ যে কেনো ধর্মমতেরই হোক না কেন৷ রাষ্ট্রের সুরক্ষা কবচ সবার জন্যেই থাক সমানুপাতিক৷ সেখানে ধর্মমতের দোহাই দিয়ে কেন নরনারীর জন্যে আলাদা আইন থাকবে? কেনই বা ধর্মমতের জন্যে আলাদা বিধান থাকবে? প্রাচীন ও মধ্যযুগে কী বা হয়েছে বা হয়নি সে দোহাই এই আধুনিক গণতান্ত্রিক বিজ্ঞানের যুগে কেন? আজ গণতন্ত্রের যুগে একজন নর বা একজন নারীর ভোটাধিকার যেমন সমান, আইনের অধিকারও তার সমান পাবার কথা৷ বিশেষ করে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে৷

বিবাহ একটি সামাজিক প্রথা৷ নর-নারী একে অপরের বিশেষ দায়ভার গ্রহণের  অঙ্গীকার৷  এখানে কেউ কারোর গলগ্রহ নয়৷ কারও পায়ের নীচে কারও বেহেস্ত নেই৷ সুতরাং কেউ একজন চাইলেই কাউকে ছঁুড়ে ফেলতে পারে না৷

কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে মুসলীম মহিলাদের জন্যে এতদিন এই জঘন্য ছঁুড়ে ফেলার তিন তালাক প্রথা প্রচলিত ছিল৷ যার থেকে বেরিয়ে আসতে মুসলিম মহিলারাই দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর এই জয় পেয়েছে৷ এর সঙ্গে ভোটের রাজনীতিকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না৷ এতে বিজেপির উচ্ছসিত হবার কিছুই নেই, কংগ্রেস তূণমূলের হতাশ হবারও কিছু নেই৷ তবে বিচার ব্যবস্থায় আদালতকে সাহায্য করার যে কর্তব্য এতদিন অবিজেপি সরকারগুলি করেনি নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি সরকার সেই দায়টুকু পালন করেছে৷ এইটুকুই নরেন্দ্রমোদির কৃতিত্ব৷

তবে এখানেই থেমে থাকলে চলবে না৷ ধর্মমতের দোহাই দিয়ে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ই যেন নারীদের শোষিত বঞ্চি ত করতে না পারে রাষ্ট্র বা আদালতকে সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকতে হবে৷ বিভিন্ন ধর্মমতের পণপ্রথা, নারীর জন্য অবমাননাকর নানান ধর্মীয় প্রথা, ডাইনী প্রথা, সম্পত্তি ও দায়াধিকারের ক্ষেত্রে নানান বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাও বন্ধ করতে হবে৷

মনে রাখতে হবে আজকের যুগ ধর্মমত Religion)-এর যুগ নয় আজকের যুগ ধর্ম Dharma)-যুগ৷ আজকের যুগ নব্যমানবতাবাদের যুগ৷  ধর্ম বলতে এখানে প্রথা পদ্ধতি নয় ধর্ম বলতে সত্তাগত বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে৷  সেই ধর্মে নর বা নারীর জন্যে কেন আলাদা বিধান থাকবে?  সেখানে কেন একে অপরের গলগ্রহ হবে? উভয়েই উভয়ের পরিপূরক থাকবে৷ রাষ্ট্র বা আদালত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে সেই ব্যবস্থাকেই মজবুত করবে৷ আজকের যুগধর্মে এটাই নারীদের মূলদাবী৷

ইসলাম ধর্মমতের সমাজে মুসলীম নারীদের জন্যে এই জঘন্য তিনতালাক প্রথা বন্ধের ঘোষণা তার প্রথম পদক্ষেপ ৷  আরও বহুবিধ জঘন্য প্রথা আছে৷ সে সব রদ করতেও আদালত বা রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে৷

বিবাহের ক্ষেত্রে পাত্র-পাত্রীর সমান অংশীদায়িত্ব, পণপ্রথা রদ, নারীর পক্ষে সাক্ষী দিতে চারজন নরের সাক্ষ্য, সম্পত্তি ও দয়াধিকারের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আইন প্রভৃতি সবকিছুর প্রতি সুনজর দিতে হবে৷ তবেই প্রকৃত গণতন্ত্র ও স্বাধীকার প্রতিষ্ঠিত হবে৷