নেতাজীর স্বপ্ণকে সার্থক করতে প্রাউটের পতাকাতলে সমবেত হও

লেখক
প্রভাত খাঁ

আমরা আমাদের দেশের মনীষী ও দেশ প্রেমিকদের জীবনাদর্শ ও ত্যাগের কথা যতটা না বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করি তার চেয়ে বেশী আগ্রহ দেখিয়ে কেবলমাত্র তাঁদের জন্ম ও মৃত্যুদিনে প্রতিকৃতিতে ফুল ও ফুলের মালা দিয়ে ও তাঁদের সম্বন্ধে দু’চার কথা বলে আমাদের কর্ত্তব্য পালন করি মাত্র৷ ২৩শে জানুয়ারী নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ১২৭তম জন্মদিনে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে জন্মদিন পালিত হবে সারা দেশে কিন্তু যে দেশ–প্রেমিক আজীবন দেশ মাতৃকার পূর্ণ স্বাধীনতার জন্যে জীবন উৎসর্গ করে গেলেন তাঁর মূল্যায়ণ অদ্যাবধি কি এদেশের সরকার ও দেশবাসীরা করেছেন মুখার্জী কমিশন শত বাধাবিপত্তিকে অস্বীকার করে তাঁর অন্তর্ধান রহস্য উদঘাটন করলেন ও ‘গত ১৯৪৫ সালে তাইহকু বিমান বন্দরে তাঁর বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়নি’ বলে যুক্তিপূর্ণ তথ্য দিয়ে গেলেন, সেই তথ্যকে কেন্দ্রীয় সরকার স্বীকার করে তো নিলেনই না তার উপর এক লাইনের মন্তব্যে মুখার্জী কমিশনকে নির্লজ্জের মতো বাতিল করে দিয়ে নিছক দলবাজীকেই প্রাধান্য দিয়ে গেলেন৷ অদ্যাবধি নেতাজীর জন্মদিনকে জাতীয় ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয় নি৷ তাছাড়া আজ যে নেতাজীর জন্মদিনকে দেশবাসী ‘দেশপ্রেম’ দিবস হিসাবে পালন করছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার যেহেতু কংগ্রেসী সরকার কংগ্রেস ত্যাগ করে নেতাজী ফরোয়ার্ড ব্লক নামে নোতুন দল গঠন করেন সেই কারণে নেতাজীকে দেশপ্রেমিক হিসাবে সরাসরি ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করছেন৷ মনে পড়ে কোন এক অদৃশ্য কারণে মহান দেশনেতা নেতাজী সুভাষচন্দ্রের আইএনএ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক রূপে যে প্রতিকৃতি সেই ছবিকে সারা দেশবাসী জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বরণ করে নিয়ে নেতাজীকে দেশপূজ্য হিসাবে সম্মান দিতে থাকে, অথচ স্বাধীন দেশের সরকার সরকারী কার্য্যালয়ে নেতাজীর ওই প্রতিকৃতিই রাখাকে নিষিদ্ধ করে দেন৷ সরকারী অফিসে জাতির জনক হিসাবে একমাত্র গান্ধীজীর প্রতিকৃতিই রাখা হচ্ছে৷ তবে দেশবাসী তাঁকে শ্রদ্ধা করে তাই নেতাজী সম্বন্ধে রাজনৈতিক দলগুলি সঠিক সিদ্ধান্ত আজও নিতে পারেনি৷ আসলে সত্য যাতে প্রকাশনা হয়, তাই নেতাজীকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি আজও আতঙ্কিত৷

দুঃখের বিষয় সেদিন পশ্চিম বাঙলার সকল সাংসদ কিন্তু একযোগে মুখার্জী কমিশনকে মান্যতা দিতে লোকসভায় দাবী তোলেননি৷ দেশপূজ্য নেতাজী ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের মানসপুত্র৷ ত্যাগ, সেবা ও আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ বিশ্বাস৷ তিনি প্রতিদিন এমনকি আইএনএ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়েও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেও গীতা ও একটি রুদ্রাক্ষের মালা ও সন্ন্যাসীর গেরুয়া বস্ত্র ছিল তাঁর নিত্য সাথী ও নিত্য ধ্যানধারণা করতেন৷ তিনি ছিলেন বিশ্বের আদর্শ মানবতাবাদী ও আধ্যাত্মিক সাধক ও দেশনেতাও৷ দেশের মুক্তিই ছিল তাঁর মুখ্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য৷ দেশ ভাগ তিনি কোনদিন চাননি৷ পূর্র্ণ স্বাধীনতাই ছিল তাঁর কাম্য৷ শ্রদ্ধেয়া পূরবী রায়ের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সুভাষচন্দ্রে জীবনের অনেক ঘটনা তাঁর লেখায় জানতে পেরেছেন দেশবাসী৷

সৌভাগ্যবশতঃ আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল জনৈক বর্মা ফেরত একজন টেলিফোন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে৷ তিনি নেতাজীর আইএনএ–র হয়ে কাজ করতেন৷ যখন দারুণ খাদ্যাভাব আইএনএ বাহিনীর তখন বাহিনীর সৈন্যদের মাথাপিছু যে কয়েকটি করে রুটি দেওয়া হয়, নেতাজীকে কয়েকটি রুটি বেশী দেওয়া হলে তিনি বলেন যে তাঁর ভাগে কেন বেশী রুটি দেওয়া হয়েছে৷ তিনি যেমন দেশের জন্যে সেবা দিচ্ছেন ঠিক তেমনি প্রিয় বন্ধুরা সকলে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন৷ তাই খাদ্য বন্টনে যেন পার্থক্য না থাকে৷ তাঁর কাছে এই সংবাদটি পেয়েছিলাম৷ এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের প্রিয় নেতাজী কত বড় মাপের ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন৷

নেতাজীর সঙ্গে যাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিনি হলেন মহান বিপ্লবী রাসবিহারী বসু৷ তিনি জাপানে আত্মগোপন করে থাকেন ও জাপানে থাকার জন্যেই জাপানী মহিলাকে বিবাহ করে জাপানের নাগরিক হন৷ কিন্তু সারাটি জীবন তিনি ভারতবর্ষ তথা পূর্ব এশিয়ার মুক্তি সাধনায় ব্রতী ছিলেন৷ তাঁর অনুরোধে জাপান বন্দী ভারতীয় সৈন্যদের মুক্তি দেন ও তাঁর প্রচেষ্টায় আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠিত হয়৷ তিনি (রাসবিহারী বসু) নেতাজীকে আই এন এ–র সর্বাধিনায়ক হিসাবে মনোনীত করেন৷ নেতাজী বাহিনী নিয়ে ১৫০মাইল পাড়ি দিয়ে মণিপুরে এসে ভারতের মাটিতে জাতীয় পতাকা প্রোথিত করেন৷

 নেতাজী জাপানের সাহায্য নেন ইংরেজ শোষকদের ভারত থেকে বিতাড়িত করতে৷ কোন আনুগত্যের চুক্তিতে তিনি আবদ্ধ ছিলেন না৷ জাপান ইংরেজ সৈন্যদের পরাজিত করে বার্মা, আন্দামান, নিকোবর জয় করে৷ নেতাজীকে জাপান আন্দামান ও নিকোবরের সার্বভৌমত্ব দান করে তাঁকে সার্থক আইএনএর সর্বাধিনায়ক রূপে ঘোষণা করেন৷ নেতাজী এই দুই দ্বীপের নাম রাখেন শহীদ ও স্বরাজ৷ অদ্যাবধি এই দুটি দ্বীপের জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার তেমন কিছু উন্নয়নের দিকে নজর দেননি কিন্তু এই দুটি দ্বীপ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ পূর্বদ্বার৷

নেতাজীর সমাজতন্ত্র ছিল ভারতীয় আধ্যাত্মিকতায় প্রতিষ্ঠিত সমন্বয়বাদ যার কথা স্বামীজী বলতেন৷ বিদেশের কোন জড়বাদী তত্ত্ব ভারতের সমাজতন্ত্রের ভিত্তি নয়৷ তিনি বলতেন নেতা আকাশ থেকে পড়ে না৷ নেতা তৈরী হয় এই মাটি থেকে৷ ত্যাগ, সেবা, তিতিক্ষা, আন্তরিক প্রচেষ্টা, নিষ্ঠা, নৈতিকতা যাঁদের মধ্যে আছে তাঁরাই প্রকৃত দেশ নেতা হতে পারেন৷ তিনি ছিলেন বিপ্লবের জীবন্ত প্রতিমূর্ত্তি৷ সারা ভারত তথা বিশ্ব আজও প্রতীক্ষা করছে তাঁর মতো মানবিক মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ সন্ন্যাসী দেশ প্রেমিকের জন্যে৷ মহান দার্শনিক শ্রদ্ধেয় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার মানব সমাজের সার্বিক মুক্তির এষণায় তিনি প্রাউট দর্শন দিয়ে গেছেন৷ অনেকদিন আগে দেওয়ালে দেখেছি–দীগন্ত হতে ভাসিয়া আসিছে নেতাজীর নির্দেশ, প্রাউটের ডাকে হও সবে এক বাঁচাও আজিকে দেশ–এই শ্লোগান৷

মনে হয় দেরী না করে সকল তরুণ তরুণী প্রাউটকে জেনে বুঝে নেতাজীর আরব্ধ অসমাপ্ত কাজ করে সমস্যা সংকূল ভারতকে সার্থক করে তুলুক৷ তাঁর আলোকে বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করে বিশ্বের সার্বিক মুক্তি আনয়ন করুক৷ সমাজতন্ত্রই হ’ল মানব সমাজের ইপ্সিত লক্ষ্য৷

প্রাউটের একটি শ্লোগান সকলের স্মরণে রাখা দরকার–‘ধনতন্ত্র ভাতে মারে আর আঁতে মারে কমিউনিষ্ট তাই তো মোরা প্রাউটিষ্ট’৷ প্রাউট বলছে যে প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে বিশ্বে অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে৷ আর সেই সমাজতন্ত্রে কোন শোষণ থাকবে না৷ নিছক রাজনৈতিক স্বাধীনতায় মানুষের মুক্তি নেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতাই হ’ল বেঁচে থাকার উপায়৷ স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলতে হবে সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে থেকে৷ কারণ মানব সমাজ এক ও অবিভাজ্য৷’ আজ আর কাল হরণের সময় নেই৷ সারা বিশ্ব আজ ভয়ংকর সংকটের মধ্য দিয়েই চলছে৷ সেই সংকট মোচন করতে হবে সার্বিক শোষণ মুক্তির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে৷ তাই আহ্বান জানাই দেশপ্রেম’ দিবসে সবাই এক হয়ে সেই মহান নেতার লক্ষ্যকে সার্থক করে তুলতে৷