আজকাল আমরা একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলছি৷ সর্বস্তরেই এক অরাজগতা বিরাজ করছে---কেমন যেন একটি ডামাডোল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে৷ সমাজটা চরম নেতৃত্ব-সঙ্কটে ভুগছে৷ শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান-অর্থনীতি, ধর্ম-রাজনীতি সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্রে চলছে নেতৃত্বের চরম সংকট৷
একটা উদাহরণ নেওয়া যাক---আমরা সবাই জানি যে একটা মোটর গাড়ীকে ভালোভাবে চলতে হলে---
প্রথমত গাড়ীটিকে ভাল সচল অবস্থায় থাকতে হবে৷
২য়) গাড়ীতে পর্যাপ্ত জ্বালানী থাকতে হবে৷
৩য়) গাড়ীটি উন্নত প্রযুক্তির দ্রুতগতি সম্পন্ন হবে৷
৪থ) গাড়ী চলার রাস্তাটা ভালো হতে হবে৷
৫ম) গাড়ীর চালককে দক্ষ ও সুস্থ হতে হবে৷
৬ষ্ঠ) সর্র্বেপরি ট্রাফিক সিস্টেম থাকতে হবে৷
আজকের আধুনিক সভ্য জগতের হাইটেক সোসাইটির ডিজিটাল যুগের মানুষেরা এই বিষয়টি ভালভাবেই জানেন বুঝেন---তাই উন্নত দেশগুলো এই বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে৷ তাই দেখা যায় ওদের গাড়িগুলোর কন্ডিশন সবসময়ই ভালো থাকে৷ দামি দামি উন্নত প্রযুক্তির গাড়ির রাস্তায় বেশি চলে৷ ঝা চকচকে হাইওয়ে সড়ক পথ৷ ড্রাইবাররাও খুবই এক্সপার্ট ট্রাফিক সিস্টেমও খুবই উন্নত৷ এই মোটর গাড়ির মতই আমাদের সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলেও প্রথমত ঃ- সুস্থসবল, শিক্ষিত,ন্যায় পরায়ণ সুনাগরিক চাই৷
২) গাড়ী চলার রাস্তার মতই একটা আদর্শ থাকা চাই, উন্নত দর্শণ চাই৷
৩) দক্ষ ড্রাইভারের মতই আদর্শবান, নীতিবাদী নেতৃত্ব চাই৷
৪) ট্রাফিক সিস্টেম এর মতই একটা সক্রীয় প্রশাসন ব্যবস্থা, একটা সমাজ ব্যবস্থাও থাকতে হবে৷
আদর্শের বিষয়---আধুনিক যুগের শিক্ষিত মানুষেরা গাড়ি চলার বিষয়টা যতটা সিরিয়াসলি ভাবে ---মানুষের সমাজটাকে এগিয়ে নিয়ে চলার ব্যাপারে যেন ততটাই উদাসিন৷ দ্রুতিগতিতে গাড়ি চালানোর জন্য ন্যাশনাল হাইওয়ে, ইন্টারন্যাশনাল হাইওয়ে তৈরী হচ্ছে অথচ মানুষের জীবনের আদর্শটা কেমন হওয়া উচিত, সমাজ দর্শন কেমন হওয়া উচিত সেই তা নিয়ে ততটা চিন্তা ভাবনা করে না৷ একজন এক্সপার্ট ড্রাইবার বানাবার জন্য জায়গায় জায়গায় ড্রাইবিং স্কুল ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে৷ রয়েছে ওদের পরীক্ষার ব্যবস্থাও৷ পাস করার পর কাজে যোগ দেওয়ার আগে ড্রাইবিং লাইসেন্স তৈরী করতে হয়৷
কিন্তু যারা সমাজকে নেতৃত্ব দেবে দেশ চালাবে সেইসব নেতাদের বেলায় না আছে কোন ট্রেনিং এর ব্যবস্থা, না আছে কোন পরীক্ষার ব্যবস্থা! যে কেউ নেতা সেজে যাচ্ছে মন্ত্রী হয়ে যাচ্ছে৷ আর তাই সমাজটাও দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে--- মানুষের মনুষত্ব তাই আজ বিলুপ্তির পথে৷ একমাত্র আদর্শ নেতৃত্বের অভাবেই মানবতাহীন মানব সমাজ আজ ধবংসের পথেই যেন এগোচ্ছে৷ বিশ্বব্যাপী চলছে নেতৃত্বের তীব্র সঙ্কট৷
নেতাজী বলেছিলেন---
‘‘নেতা আকাশ থেকে পড়ে না কাজের মধ্য দিয়েই নেতা তৈরী হয়৷ বর্তমান যুগে একেতো নেতৃত্বের গুণযুক্ত মানুষের বড্ড অভাব অপর দিকে সব জায়গায় কাজের পরিবেশও নেই৷ কিছু স্বার্থবাদী ধূর্তলোকেরা নিজেদের স্বার্থে সবকিছু করে চলেছে৷ সমাজের অর্থবল, লোকবল-সব ক্ষমতা আজ ওদেরই হাতে৷ ঐসব স্বার্থপর ভণ্ড নেতারা কখনোই চায়না যে, কোনও প্রকৃত নেতার আত্মপ্রকাশ ঘটুক৷ তাই ঐসব ধূর্তরা সর্বদাই সতর্ক থাকে---কোথাও নেতৃত্বের সম্ভাবনাযুক্ত কোনও যোগ্য ব্যষ্টি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগেই ওদের দমিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়৷ কখনও প্রলোভনে ফেলে, কখনও জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে, কখনও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে--- কখনও হুমকি দিয়ে ভয় দেখিয়ে ওদেরকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়৷ যোগ্যদের সরিয়ে রেখে স্বার্থপর নেতারা নিজেদের লোকদের হাতে দায়িত্বভার তুলে দিয়ে নিজেরা নিশ্চিন্ত থাকলেও দেশ তথা জাতির ক্ষতি সাধন করে থাকে৷ এই স্বজন পোষণের কারণেই এককালে দীর্ঘদিন রাজত্ব করা সর্বভারতীয় কংগ্রেস পার্টীটা আজ শেষ হতে বসেছে৷
প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও-যোগ্য সৎ ব্যষ্টিদের দুরে সরিয়ে রেখে দুর্নীতিবাজদের উচ্চপদে বসানোর কথা শোণা যায়৷ সমাজের নেতৃত্ব সম্পর্কে স্বামী সৌমেশ্বরানন্দজীর মতে---
একটা নেতৃত্ব যখন সফলভাবে কাজ করতে থাকে--- তখনই দ্বিতীয় নেতৃত্বকে তৈরী করে রাখতে হয়৷ আর তৃতীয় নেতৃত্বকে প্রশিক্ষণের মধ্যে রাখতে হয়, চতুর্থ নেতৃত্বকে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করে রাখতে হয়৷
কিন্তু বাস্তবে স্বামীজির এই সুন্দর ফরমূলা সবাই মেনে চলতে চায়না৷ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কেউ একবার ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে গেলে তা আর হারাতে চায় না৷ যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকে৷ এমনকি শারীরিক মানসিক দিক থেকে কর্মক্ষমতা হারিয়ে গেলেও অনেকেই ক্ষমতা হারাতে চায় না৷ ঐসব ক্ষমতালোভী নেতারা পরবর্তী নেতৃত্বকে তৈরী করার বদলে কোনরকম কাজ চালিয়ে যেতে কিছু চামচা টাইপের লোক নিয়োগ করে থাকে৷ নানান বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়ে কিছু সুবিধাবাদী লোকদের নিয়ে একটা লবি তৈরী করে নেয়৷ তাতে স্বজন পোষণ, লবিবাজীর ফলে দুর্নীতি বাড়তে থাকে ---দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করে কিছুদিন ক্ষমতায় টিকে থাকলেও ধীরে ধীরে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়--- অরাজকতা সৃষ্টি হয়৷ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রবেশ করে বর্তমানে সর্বত্রই তাই দেখা যাচ্ছে৷ শুধু তাই নয়---কোথাও কেউ কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে দুর্নীতিগ্রস্তকে রেহাই দিয়ে প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়৷ এমন একটা আতঙ্কের পরিবেশ তৈরী করে রাখা হয় যাতে কেউ আর কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহস না পায়৷ বর্তমানে সর্বত্রই এই একই অবস্থা বিরাজ করছে৷ নেতৃত্ব সম্পর্কে শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী কিছু নূতন কথা শোণালেন৷
শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী সদ্বিপ্র সমাজ গড়ার কথা বলেছেন আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক একটি আদর্শ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বললেন৷ তাঁর কথায় মানুষের জীবনটা ত্রিস্তরীয়-শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই তিনটি স্তর নিয়ে মানুষের জীবন৷ মানুষের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে তিনটি স্তরেই তা করতে হবে৷ তাই সমাজের যারা নেতৃত্ব দেবেন, যাঁরা এই ত্রিস্তরীয় উন্নয়নের দায়িত্বে থাকবেন তাঁদেরকেও তিনটি স্তরেই উন্নত হতে হবে৷ ওঁদেরকেই শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী সদ্বিপ্র নামে অবিহিত করেছেন৷
এই সদ্বিপ্ররা শারীরিক দিক থেকে যেমন সুস্থ, সবল থাকবেন তেমনি মানসিক দিক থেকেও---শিক্ষায়, বিদ্যা বুদ্ধিতে চিন্তা-ভাবনায় উন্নত মানসিকতার অধিকারী হবেন৷ তাঁরা নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবেন৷ তাঁরা একদিকে যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল ও সাহসী হবেন অন্যদিকে তেমনি জনদরদী ও সেবা পরায়ন হবেন৷ সদ্বিপ্ররা হবেন আধ্যাত্মিকতায় উন্নীত৷ কোনরকম কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ভাবজড়তাকে প্রশ্রয় দেবেন না৷ জাত পাতের উর্দ্ধে ওঠে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবেন৷
বর্তমান সমাজে হয়তো এমন উন্নত চরিত্রের মানুষ হয়তো এখনই খুঁজে পাওয়া যাবে না তবে যুগের প্রয়োজনে একদিন তাঁরা ঠিকই বেরিয়ে আসবে৷
শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী শুধু সদবিপ্র রাজ্যের কথাই বলেননি-কী করে সদ্বিপ্র তৈরী হবে৷ এরও একটা গাইড লাইন দিয়েছেন৷ সদ্বিপ্র সমাজের একটি রূপরেখাও এঁকে দিয়েছেন আদর্শ সমাজের একটি সুন্দর সিস্টেমও দিয়েছেন৷
তাঁর পথ ধরে চললে তাঁর তৈরী করা সিস্টেমের মধ্যদিয়েই একদিন নেতৃত্বের সঙ্কট দুর হবে৷ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছুই সিস্টেমের মধ্যদিয়ে চলে৷ শুধু মানুষই কোন সিস্টেমে আসতে চায় না৷ আদর্শ যতই মহান হোক না কেন কোন সিস্টেম অনুযায়ী না চললে শুধু আদর্শের দ্বারা কিছুই হয় না৷ বর্তমান নীতি ও নেতৃত্বের সঙ্কটের পেছনে-প্রকৃত সিস্টেমেরও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে৷
- Log in to post comments