নয়াবসানের কথা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

কোন জায়গায় নোতুন প্রজা বন্দোবস্ত হলে অর্থাৎ নোতুনভাবে প্রজা বসানো হলে সেই জায়গাগুলোর নামের শেষে ‘বসান’ যুক্ত হয়৷ যেমন–রাজাবসান, নবাববসান, মুকুন্দবসান, নুয়াবসান (অনেকে ভুল করে ‘নয়াবসান’ বলে থাকেন–সেটা ঠিক নয়৷ দক্ষিণী রাঢ়ী ও উত্তরী ওড়িয়ায় নোতুনকে ‘নুয়া’ বা ‘নোয়া’ বলা হয়৷ ‘নয়া’ হচ্ছে হিন্দী শব্দ৷ বিহারের ভাষায় ‘নয়া’র পর্যায়বাচক শব্দ হচ্ছে ‘নয়্কা’ বা ‘নব্কা’৷ মেদিনীপুর জেলার নোয়াগ্রাম শহরটিকে আজকাল অনেকে ভুল করে নয়াগ্রাম বলে থাকে)৷

ইংরেজরা তাঁদের সামন্ত নীতি (ত্নপ্সপ্তন্ন্তুম্ভ প্সন্দ্র ত্রব্ভত্ব্ব্দন্স্তুন্ত্রব্ ট্টপ্তপ্তন্ত্রুন্তুন্দ্ব) অনুযায়ী যখন ময়ূরভঞ্জ, ত্রিপুরা, কোচবিহার প্রভৃতিকে দেশীয় রাজা বা করদ রাজ্য বা সামন্ত রাজ্যে পরিণত করেন তখন তাঁরা ওই সব রাজ্যের বেশকিছু অংশ সরাসরি ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেন৷ সংশ্লিষ্ট রাজা সেই অঞ্চলের জমিদার বলে গণ্য হতে থাকেন৷ আর তাঁরা কালেক্টারীতে মালগুজারী জমা দিতেন৷ সে অঞ্চলে তাঁরা দেশীয় নৃপতি বলে গণ্য হতেন না, হয়ে যেতেন জমিদার৷ বাকী কিছু অংশে তাঁরা দেশীয় নৃপতি বলে গণ্য হতেন৷ ত্রিপুরার পূর্ব দিকের পার্বত্য অংশ ইংরেজরা মহারাজের হাতেই রেখে দেন৷ সেই এলাকায় ত্রিপুরার মহারাজা রইলেন দেশীয় নৃপতি হিসেবে, ওখানেই তাঁদের নিজস্ব রাজধানী রইল৷ ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হ’ল তাঁর রাজ্যের পশ্চিম দিকের উর্বর জনবহুল এলাকাগুলি৷ এইভাবে প্রাক্তন ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ও প্রাক্তন সিলেট জেলার অংশবিশেষ নিয়ে তাঁরা তৈরী করলেন ৰ্রাহ্মণবেড়িয়া মহকুমা ও তৎসহ চাঁদপুর, কুমিল্লা সদর নিয়ে গড়লেন ব্রিটিশ ত্রিপুরা বা টিপ্পারা (ন্হ্মহ্মন্দ্বব্জ্ত্রড়)৷ এই ব্রিটিশ ত্রিপুরা বা টিপ্পারা জেলা জনবহুল থাকায় নোতুনভাবে প্রজা বসানোর প্রয়োজন দেখা দেয়নি৷ তবে এই জেলার বিরাট অংশের জমিদার হিসেবে থাকলেন ত্রিপুরার মহারাজ৷ তিনি কুমিল্লার কালেক্টরেটে মালগুজারী জমা দিতেন৷ বাকী অংশ যা’ ত্রিপুরায় রয়ে গেল সেখানে তিনি থেকে গেলেন দেশীয় নৃপতি হিসেবে৷

ত্রিপুরা রাজ্যের কথ্য ৰাংলা হচ্ছে, উত্তরাংশে সিলেটী ৰাংলা, দক্ষিণাংশে নোয়াখালি ৰাংলা যা’ আসলে চট্টগ্রামীয় ৰাংলা ও সিলেটী ৰাংলার একটি বিমিশ্রণ৷ অনুরূপভাবে প্রাক্তন কোচবিহার রাজ্যের (তারও আগে রাজ্যটির নাম ছিল কামতাপুর) এক সুবিস্তীর্ণ এলাকাকে ইংরেজরা ব্রিটিশ ৰাঙলার অন্তর্ভুক্ত করে নেন৷ আর মাত্র আটটি থানাকে (কোচবিহার, মাথাভাঙ্গা, দীনহাটা, শীতলকুচি, হলদিবাড়ি, মেখলিগঞ্জ, সিতাই ও তুফানগঞ্জ) থাকতে দিলেন মহারাজার শাসনে৷ ব্রিটিশের দখলে আনা এলাকা নিয়ে তৎকালীন ৰাঙলা প্রদেশে তৈরী হয়েছিল রংপুর জেলা৷ এই এলাকাও মোটামুটি জনবহুল থাকায় খুব বেশী সংখ্যক নোতুন প্রজাবিলির প্রয়োজন হয়নি৷ তবে এই এলাকার উত্তর অংশে খাস এলাকাগুলিতে ও কোন কোন ক্ষেত্রে বিলি করা এলাকাগুলিতে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে বা নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে অনেক চা–বাগান তৈরী করা হয়৷ এই রংপুর জেলার পূর্বাংশে জনসংখ্যা কম থাকায় বাইরে থেকে অনেক কর্ষক এনে ভূমি বন্দোবস্ত করা হয়৷ পরে ৰৃহদাকার হওয়ার দরুণ রংপুর জেলা তিন ভাগে বিভক্ত হয়৷ দক্ষিণ অংশের নাম রংপুর–ই থেকে যায় উত্তর অংশে তৈরী হয় নোতুন জেলা–জলপাইগুড়ি, আর উত্তর–পূর্ব অংশ নিয়ে তৈরী হয় উত্তর–পূর্ব রংপুর জেলা৷ ১৯১২ সালে যখন নোতুনভাবে অসম প্রদেশ গঠিত হয় তখন এই উত্তর–পূর্ব রংপুর জেলাটিকে তার অন্তর্ভুক্ত করা হয়৷ রংপুর থাকল ৰাঙলা প্রদেশে আর উত্তর–পূর্ব রংপুর গেল অসম প্রদেশে৷ এটা একটু বিসদৃশ হওয়ায় উত্তর–পূর্ব রংপুরের নাম পাল্টে করে দেওয়া হয় গোয়ালপাড়া৷ জেলা সদর ধুবড়িতে রাখা হয়৷ ধুবড়ির কথ্যভাষা রংপুরী ৰাংলা৷ কোচবিহার, জলপাইগুড়িরও কথ্যভাষা রংপুরী ৰাংলা৷ তবে জেলা দু’টোর বিভিন্ন অংশে রংপুরী ৰাংলার বিভিন্ন শাখা প্রচলিত৷

ময়ূরভঞ্জ রাজ্যটির পশ্চিমাংশের পাহাড়ী এলাকা মহারাজের হাতে থাকতে দেওয়া হয়৷ আর পূর্ব দিকের অপেক্ষাকৃত সমতল অংশ ব্রিটিশ ৰাঙলার অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়৷ এই অংশের মহারাজা হয়ে দাঁড়ালেন ব্রিটিশেরই জমিদার৷ মেদিনীপুর কালেক্টারীতে তাঁর মালগুজারী জমা পড়ত৷ অবশিষ্ট অংশে তিনি রয়ে গেলেন দেশীয় নৃপতি৷ রাজ্যের রাজধানী হ’ল বারিপদা৷ যে অংশ ব্রিটিশ ৰাঙলার অন্তর্ভুক্ত হ’ল সে অংশ সেকালে কিছুটা জনবিরল ছিল৷ ছোটখাট জঙ্গলও ছিল, কিন্তু পাহাড় বড় একটা ছিল না৷ এই অংশে ব্রিটিশরা নোতুনভাবে প্রজাপত্তন করেন অর্থাৎ প্রজা বসান৷ এলাকাটি তাই ‘নুয়াবসান’ নামে পরিচিত অর্থাৎ যেখানে নোতুন করে প্রজা বসানো হয়েছে৷ ময়ূরভঞ্জ রাজ্যটির দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশের কথ্য ভাষা উত্তরী ওড়িয়া, আর উত্তর–পূর্ব অংশের কথ্য ভাষা কেরা ৰাংলা৷ এই কেরা ৰাংলা হচ্ছে ৰাংলা ও ওড়িয়ার একটি বিমিশ্রণ৷ অনেকেই জানেন যে ৰাংলা ও ওড়িয়া ভাষা দু’টি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী৷ এদের ইতিহাসও অনেকাংশে এক৷ জনগোষ্ঠীর সামাজিক আচার–নুষ্ঠান ও নৃতাত্ত্বিক পরিচিতিও প্রায় একই৷ এদের দুইকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক করে দেওয়া অসম্ভব ব্যাপার৷ তাই কেরা ৰাংলা যখন ৰাংলা ও ওড়িয়ার বিমিশ্রণ তখন এটা আসলে ৰাংলার উপভাষা না ওড়িয়ার উপভাষা এ বিষয়ে মাথা ঘামানো নিরর্থক৷ নেতারা বা ভাষাতত্ত্ববিদেরা যাই বলুন না কেন, আমি তো বলব এই উপভাষাটি ৰাংলা ও ওড়িয়া দুইয়ের সঙ্গে সমভাবে সংযুক্ত থাকায় এখানকার মানুষেরা নিজেদের পছন্দমত মাতৃভাষা ৰাংলা বা ওড়িয়া যা ইচ্ছে বলতে পারেন৷ তাঁরা তাঁদেরই সুবিধামত কাজ করবেন এটাই স্বাভাবিক৷

ৰাঙলার পশ্চিম প্রত্যন্তে আরো একটি দেশীয় রাজ্য ছিল–সেরাইকেলা৷ এ রাজ্যটির দক্ষিণাংশের (সঞ্জয় নদীর দক্ষিণ পার) কথ্য ভাষা কেরা ৰাংলা৷ উত্তরাংশের (আদিত্যপুর, গামারিয়া, সিনি, কাঁদরা প্রভৃতি স্থান) কথ্য ভাষা রাঢ়ী ৰাংলা৷ বাঁকুড়ার কথ্য ভাষার সঙ্গে এর তফাৎ নেই বললেই চলে৷

কোন গ্রামে সুপ্রসিদ্ধ দীঘি বা পুকুর থাকলে সে নামেও গ্রামের নাম হয়ে থাকে৷ যেমন–তালপুকুর, তালদীঘি (তালদীঘিঞ্ছতালদিহিঞ্), টুঙ্গিদীঘি, তপনদীঘি*(তপন পশ্চিম দিনাজপুর জেলায়৷ কথিত আছে রাজা দনুজমর্দন দেব যাঁর পূর্বেকার নাম ছিল দিব্যোক, যাঁর নামে দিনাজপুর, এই দীঘি কাটিয়ে তার জলে তর্পণ করতেন৷ এই ‘তর্পণ’ থেকে ‘তপন’ নামটা এসেছে৷), বিল্বপুষ্করিণী (ৰেলপুকুর–নদীয়া), বামুনপুকুর (ৰ্রাহ্মণ–পুষ্করিণী–নদীয়া), পাত্রসায়র (বাঁকুড়া), রাণীবাঁধ (বাঁকুড়া), রাজবাঁধ (বর্দ্ধমান), সাগরদীঘি (মুর্শিদাবাদ) ও দত্তপুকুর (২৪ পরগণা) প্রভৃতি৷**(‘‘বর্ণবিজ্ঞান’’ থেকে গৃহীত–সম্পাদক৷)