পৌষমাস উৎসবের মাস

লেখক
প্রণবকান্তি  দাশগুপ্ত

মানুষ যেদিন থেকে চাষবাস করতে শিখলো সেদিন থেকে   তার শুর হলো উৎপাদিত শস্যের উৎসব৷ বিশ্বজুড়ে এই শস্যকেন্দ্রিক উৎসব ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত হলেও ভারতের মানুষ পৌষের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেনি৷ সোনার ফসলে পৌষের ডালা ভরে উঠলে মানুষ উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে৷ এক পৌষ সংক্রান্তির তিথিতেই দক্ষিণ ভারতে পালিত হয় পোঙ্গল উৎসব৷ অসমের বিহু উৎসবের সূচনাতো ঐ তিথি থেকেই৷

গ্রাম বাঙলায় বিশেষতঃ সুন্দরবন অঞ্চলে কুলাই ঠাকুরের ব্রত পৌষসংক্রান্তির একপক্ষকাল আগে থেকেই শুরু হয়৷ রাখাল বালকেরা বাঘের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য এই ব্রত করে৷ একজন রাখাল বাঘ সেজে অন্যান্য সঙ্গীসহ বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাল ভিক্ষে করবে৷ ‘‘ঠাকুর কুলাই ভোঁ / হ্যাটা চলরে / হ্যাটা চল পাঁচিল পার৷’’ এই রকম সব ছড়া কেটে কুলাই ব্রত পালিত হয়৷ পূর্ব বাঙলার বরিশাল মৈমনসিংহে ব্যাঘ্রবাহিনী কুলাই দেবীর আরাধনা হয়৷ পশ্চিম বাঙলাতে নদীয়া ও সুন্দরবন পাশ্ববর্তী অঞ্চলে এই কুলাই ঠাকুরের পুজোর প্রচলন আছে৷ পৌষ সংক্রান্তিতে উত্তরবঙ্গে বিশেসতঃ রংপুরে এই ধরনের উৎসবের প্রচলন আছে৷

কৃষির সাথে সূর্যের প্রাণের যোগ থাকায় কর্ষকরা সূর্যের পূজা করে থাকে৷ পৌষ সংক্রান্তিতে গুজরাটে তাই সূর্যপূজা হয়৷ সেই পূজা উপলক্ষ্যে ঘুড়ি ওড়ানোরও ধুম পড়ে যায়৷ বাঙালীর প্রিয় খাদ্য পিঠে পায়েস পুলি আর খেজুর গুড়৷ সে এক এলাহি ব্যাপার৷ বাড়ির মা-বোনেদের উদ্দীপনার অন্ত নেই৷ পিঠে পায়েস বাঙালীর বড় প্রিয় কিনা৷ পাড়া গাঁয়ের মেয়েরা এই সময় আলপনা এঁকে চালের গুড়ো আর গোবরের গুটি পাকিয়ে পুজো করে আর রাত জেগে সেগুলো পাহারা দেয়৷ একে বলে পৌষ আগলানো৷ কুনকেতে ধান ও ধানের ছড়া রেখেও পুজো করেন পূর্ববাঙলার  মেয়েরা৷ গৃহস্থরা ধানকে মনে করেন লক্ষ্মী৷ তাই এ হলো ধান্যলক্ষীর পূজা৷ পৌষসংক্রান্তির পৌষালী পার্বন বা পিঠে পরব খাদ্য রসিক  বাঙালীর ঘরে ঘরে বড় লোভনীয় আয়োজন৷ ‘‘আওনি, বাওনি, চাওনি/ তিন দিন পিঠা খাওনি৷ আওনি মানে ধান বা লক্ষ্মী ঘরে  এসেছেন৷ ‘বাওনি’ অর্থাৎ লক্ষ্মীকে বাঁধা হয়েছে, ‘চাওনি’ মানে আকাঙ্খা৷ কিসের আকাঙ্খা? পিঠের আকাঙ্খা৷ কি পিঠে? পুলি পিঠে বা পুর-পিঠে৷ যে পিঠেতে নারকেল পুর থাকে৷ পিঠের আবার কতরকম আকৃতি৷ কোনটা শৃঙ্গাটক অর্থাৎ পাণিফলের মতো, কোনটা স্বস্তিক বা চতুর্ভুজ৷ পিঠে আর ঝোলাগুড় বড়ই উপাদেয় খাদ্য৷

তুঁষ তুঁষলি ব্রত ও অগ্রহায়নের সংক্রান্তিতে শুরু হয়, শেষ হয় পৌষের সংক্রান্তিতে৷ প্রতিদিন সকালে ব্রাতিনীরা স্নানান্তে আলো চালের তুষ আর গোবর সহযোগে ছয়বুড়ি, ছয়গণ্ডা অর্থাৎ ১৪৪খানা গুটি তৈরি করে৷ নতুন সরা বা তিজেলে বেগুন পাতা বিছিয়ে তার ওপরে প্রতিদিন ৪ খানা করে গোবরের গুটি রাখে৷ প্রতিটি গুটিতে সিঁদুরের ফোঁটা আর পাঁচগাছি করে দূর্গা ঘাস গুজে দেয়৷ তার ওপর ছড়ায় নতুন আতপচালের তুষ আর কুঁড়ো৷ এছাড়া সরষে ফুল মূলোর ফুল, সিমফুল ও বেগুন ফুল দিয়ে ছড়া কাটে---

তুঁষ তুঁষলি তুমি কে

তোমার পূজা করে যে

ধনে ধানে বাড়ন্ত

সুখে থাকে আদি অন্ত৷৷

এছাড়াও আছে পাটাই ষষ্টীর ব্রত,  সুয়ো দুয়ার  কথা বা সো দোর ব্রত ইত্যাদি৷ শান্তি নিকেতনের ৭ই পৌষের মেলা আমাদের  কাছে কম আকর্ষণীয়  নয়৷ পয়লা জানুয়ারীতে ও কি আমরা  কম হৈ-হুল্লোড় করি৷ সেও তো পৌষমাসেই৷