প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রই বিকল্প পথ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতি পরিচালিত শিল্পের একটা বড় রোগ হ’ল, বিভিন্ন অজুহাতে শ্রমিক ছাঁটাই ও হঠাৎ কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেওয়া৷ যার ফলে বহু শ্রমিক হঠাৎ কর্মহীন হয়ে পড়ায় তাদের পরিবারকে অশেষ দুর্ভেগের মুখে পড়তে হয়৷ বহু ক্ষেত্রে তারা অনাহারে, অপুষ্টিজনিত বিভিন্ন রোগে মারা যায় বা আত্মহত্যা করে, সাংসারিক অশান্তি থেকে রেহাই পাাবার রাস্তা খুঁজে নেয়৷

শিল্পে আধুনিকীকরণ অনেক সময় জরুরী হয়ে পড়ে৷ আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে তাতে কম শ্রমে বেশী কাজ করা যায়৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তখন শিল্পপতিরা শ্রমিক ছাঁটাই করে বহু শ্রমিককে নূতন করে বেকারে পরিণত করে ও তাদের পরিবারকে অনিশ্চিততার মুখে ঠেলে ফেলে দেয়৷ এ নিয়ে শ্রমিক-মালিক বিরোধ হয়৷ আন্দোলন হয়৷ শেষ পর্যন্ত অনেক সময় কারখানা বন্ধ হয়ে যায়৷ মালিকও তার সমস্ত লাভ সহ পুঁজি নিয়ে অন্যত্র চলে যায়৷ এই ভাবে হাজার হাজার কারখানা বন্ধ হয়েছে৷ এমনকী কারখানা তো বন্ধ হয়েছেই, ওই জায়গাটাকেও আটকে রেখেছে৷ সেখানে আর কিছুই হয় না৷

প্রথমে একটা সমস্যার কথা আলোচনা করা যাক৷ যান্ত্রিকীকরণের সমস্যা বা আধুনিকীকরণের সমস্যা৷ উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করলে কম লোকে বেশী কাজ হবে৷ এটা তো সত্য কথা৷ মালিকেরও বেশী লাভ হবে৷ কিন্তু তাই বলে শ্রমিক ছাঁটাইকে মোটেই মেনে নেওয়া যায় না৷ মালিক শ্রমিক ছাঁটাই না করে কলকারখানা বৃদ্ধি ঘটাক---যাতে কর্মরত সমস্ত শ্রমিকই কাজ পেতে পারে---তার ব্যবস্থা করুক৷ তার ওপর, আর একটা বড় কথা আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে কম লোক লাগিয়ে যদি বেশী কাজ হয়---তাহলে এই আধুনিক প্রযুক্তির সুফলটা কেন মালিক একা ভোগ করবে, শ্রমিকদের কেন ভোগ করতে দেওয়া হবে না? এক্ষেত্রে শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো যেতে পারে৷ আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কল্যাণে এক সময় আসবে, মানুষকে হয়তো দু’দিনে এক ঘণ্টা কাজ করতে হবে৷ বা তারও কম, ও তাতে তার রুজি-রোজগারের কোনও অসুবিধা হবে না৷ বাকী সময় তারা মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিতে কাজে লাগতে পারবে৷ আর মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিটাই তো মানুষের জীবনের মুখ্য দিক৷ কেবল অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে অর্থাৎ জীবিকা অর্জনের জন্যে যদি সমস্ত সময় চলে গেল তাহলে ওই আসল কাজগুলো মানুষ করবে কী করে!

কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় অন্যতম ত্রুটি হ’ল, শিল্পের আধুনিকীকরণ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার আর একটা বড় রোগ হ’ল, অন্যত্র এখানকার চেয়ে অনেক বেশী মুনাফা অর্জনের সুযোগ পেলে, কারখানা বন্ধ করে দিয়ে---এতদিন ধরে এখান থেকে যা লাভ করেছে---সব নিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়া৷ মাঝখান থেকে এই শিল্পের সমস্ত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে ও বেকার শ্রমিকদের পরিবারের মানুষেরা মৃত্যুর মিছিলে যোগ দিতে বাধ্য হয়৷

উত্তরবঙ্গে বহু বন্ধ চা-বাগান, হাওড়া-হুগলী অঞ্চলের বহু শিল্পের পঞ্চত্ব প্রাপ্তির পেছনে একটাই কারণ৷

তাছাড়া , পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিক বিরোধ তো সব সময়েরই ঘটনা৷ মালিকরা চায় যত বেশী সম্ভব মুনাফা লুণ্ঠন ও শ্রমিকদের যতটা সম্ভব কম অর্থ বা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া৷ কিছু বৃহৎ শিল্পে হয়তো শ্রমিকদের বেতন বেশী ও সুযোগ-সুবিধাও বেশী, কিন্তু এই ব্যবস্থা যে কতদিন থাকবে তা গ্যারাণ্টি নেই৷ যেহেতু পুঁজিবাদী ব্যবস্থা মালিকের মনস্তত্ত্বই বেশী করে মুনাফা অর্জন করা৷ তাছাড়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কাজের সময় হ্রাস, (শ্রমিকের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা হ্রাস না করে) তো আশা করা যায় না৷

প্রাউটের অর্থনীতিতে অর্থাৎ প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শ্রমিক-মালিক বিরোধ থাকবে না৷  কারণ, এই ব্যবস্থা সমবায় নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত৷ সেখানে মালিক-শ্রমিকের স্বার্থের বিরোধই থাকছে না৷ সবাই সম্মিলিতভাবে সবাইকার অর্থনৈতিক সহ সামূহিক বিকশের জন্যে যত্নশীল হবে৷ প্রাউটের সমবায়িক ব্যবস্থায় পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে আধ্যাত্মিক নীতিবাদের প্রতিষ্ঠিত সদ্‌বিপ্র নেতৃত্বের হাতে৷ তাই সমবায়ের পরিচালনায় দুর্নীতি থাকার সম্ভাবনা থাকবে না৷

এখানে উল্লেখ্য, মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও কৃষি জমি বা শিল্পের মালিকানা  কার্যতঃ রাষ্ট্রের ওপর বর্তায় অর্থাৎ শাসক দলই এসবের মালিক হয়ে ওঠে৷ তাই একে বলা হয় রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ৷ রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ঘাড়ে চড়ে ‘কম্যুনিজম’ প্রতিষ্ঠাকে সোণার পাথর বাটির সঙ্গে তুলনা করা যায়৷ যা সম্পূর্ণ অবাস্তব৷ তাই মার্কসবাদের রঙিণ ফানুস সব দেশে চুপসে গেছে৷ এখন তাই প্রাউটের প্রগতিশীল সমাজতন্ত্র ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই৷