প্রজাতন্ত্রের সত্তর বছর পেরিয়ে...

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

পরিশেষে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু বাঙালী পরিবার ভারতে প্রবেশ করেন, যাদের অনেকেই পরে আর নবগঠিত রাষ্ট্র ‘বাঙলাদেশ’-এ ফিরে যাননি৷

স্বাধীন ভারতে রাজ্য পুনর্ঘটনের নামে বাঙলার উর্বর   ও খনিজ সমৃদ্ধ ভূমিখণ্ডগুলি কেটে, বিহার,অসম, ওড়িশা, ত্রিপুরা প্রভৃতির প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে বাঙলাকে আরো  দুর্বল করা হয়৷ অবশ্য স্বাধীনতার পূর্বেও এইরকম একটি প্রক্রিয়ার দ্বারা বাঙলাকে খণ্ডিত করা হয়৷ যে বাঙালীরা অন্যান্য প্রদেশের অধিবাসী হলেন তারা শোষণ, ভাষার অবদমন, উৎপীড়নের শিকার হয়ে মাতৃভাষার  পঠন-পাঠন থেকে বঞ্চিত ও  মাতৃভাষাহীন হতে বাধ্য হলেন৷  নাগরিক পঞ্জী বা এন.আর.সির নামে অসম প্রদেশ থেকে প্রায় ১৯লক্ষ বাঙালীর নাম বাদ দেওয়া হয়েছে, যাদের ভবিতব্য হয় নির্র্বসন নচেৎ ডিটেনশন ক্যাম্পের নারকীয় অমানুষিক  জীবনযাপন৷  বর্তমান সরকার অতি সম্প্রতি   সি.এ.এ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ করেছেন৷ যার মূল লক্ষ্য হল বাঙালী জনগোষ্ঠী বিতাড়ন ও উৎপীড়ন৷ যে বাঙালীর আত্মত্যাগ, বুকের তাজা রক্তদান ও লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতে দেশ স্বাধীন হল, আজ তারাই বিতাড়িত ও নাগরিকত্বহীন হয়ে ভাসমান জনগোষ্ঠীকে পরিণত হতে চলেছে৷ অদৃষ্টের কী পরিহাস!

এই সি.এ.এ.আইন এ শুধুমাত্র অমানবিকই নয়, অসাংবিধানিক ও সংবিধান প্রদত্ত  নাগরিক অধিকার থেকে  দেশবাসীকে বঞ্চিত করার এক সুগভীর চক্রান্ত রূপে পরিগণিত৷ এই আইনের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয়, পথে ঘাটে আন্দোলন চলছে৷ এমনকি প্রবাসী ভারতীয়গণ বিদেশের মাটিতে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদসভা সংঘটিত করছেন৷ জেনিভায় রাষ্ট্রপুঞ্জের দফতরের সম্মুখে সি.এ.এ বা ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী ভারতীয়গণ৷ দেশবাসীর এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্যে বলপ্রয়োগের ঘটনাও ঘটছে৷  কখনো মন্ত্রী, সান্ত্রী-সাংসদেরা হুমকি দিচ্ছেন, প্রতিবাদীদের গুলি করে মারার কথা বলছেন, তাদের বিভিন্ন ভাবে হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে৷ ইতোমধ্যে কয়েকটি স্থানে হামলা ও গুলি চালনার ঘটনাও ঘটেছে৷ প্রতিবাদীদেরকে কেন্দ্রীয় প্রশাসকবৃন্দ সন্ত্রাসবাদী, দেশদ্রোহী, পাকিস্তানপন্থী ইত্যাদি বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে মানুষের স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকারকে খর্ব করার ষড়যন্ত্র করছেন৷ সাড়া দেশে বর্তমানে এক ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে৷ প্রজাতন্ত্র দিবসের ৭০ বছর পরেও দেশের মানুষের নাগরিকত্বের অধিকার  সংকটাপন্ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পরিবেশ বিঘ্নিত, সর্বোপরি যুবসমাজ আদর্শহীন, কর্মহীন, বেকারত্বের গ্লানি মাথায় নিয়ে চরম হতাশাগ্রস্ত৷ এরই সুযোগ নিয়ে মতলববাজ রাজনৈতিক নেতানেত্রীগণ ছাত্র-যুবসমাজকে কুপথে বিপথে পরিচালিত করছেন৷ এসবের মূলে রয়েছে শাসককুলের পুঁজিবাদী মানসিকতা ও হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন৷ ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত, আর্থিকবৃদ্ধি নিম্নগামী, কর্মসংস্থানের অভাবে চরম বেকারত্ব, হিংসা বিদ্বেষ বিভাজন, সাম্রদায়িক বিরোধ আর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাসের ফলে নূ্যনতম  প্রয়োজনপূর্তির অভাব৷ শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ গুলিকে, এমনকি মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের শেষ ভরসার স্থল ব্যাঙ্ক ও এল.আই.সিকেও বেসরকারীকরণের মাধ্যমে পুঁজিবাদীদের করায়ত্ত করার চেষ্টাতে ব্যস্ত৷

এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতি  ও শাসন প্রণালী  ‘Old wine in a new bottle’’ এই নীতিকে পরিহার করে বিকল্প পথের সন্ধান করা একান্ত প্রয়োজন৷ আর এই বিকল্প বা নোতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন মহান দার্শনিক শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার, তাঁর প্রবর্তিত ‘‘প্রাউট’’ দর্শনে৷ প্রাউট বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব Progressive Utilization Theory -PROUT) দর্শন অনুযায়ী কেন্দ্রিত অর্থনীতির পরিবর্তে ‘বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি’-র দ্বারা বর্তমান পুঁজিবাদীদের শোষণের করাল গ্রাস থেকে সমাজকে রক্ষা করা সম্ভব৷ বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির লক্ষ্য হলো---‘‘আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা’’৷ ‘‘স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল’’ ঘটন করে ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনার দ্বারা স্থানীয় সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করে সমবায় প্রথায় কৃষি,শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত করতে পারলে, একদিকে যেমন স্থানীয় অঞ্চলের অধিবাসীদের একশত শতাংশ কর্মসংস্থান, মানুষেক ক্রয়ক্ষমতাবৃদ্ধি আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ ও নূ্যনতম প্রয়োজন পূর্তির সুনিশ্চিততা পাওয়া যাবে--- অন্যদিকে মধ্যসত্ত্বভোগী দালালদের হাত থেকে  সাধারণ মানুষ মুক্তি পাবে৷ উৎপাদন সমবায় ও উপভোক্তা সমবায়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরাসরি উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে যাবে৷ এই সমবায়গুলিতে স্থানীয় অধিবাসীদের অংশিদারিত্ব থাকবে ও সমগ্র ব্যবস্থাটি নিয়ন্ত্রিত হবে আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত, নীতিবাদে প্রতিষ্ঠিত, আপোষহীন  সংগ্রামী  সদ্বিপ্রগনের দ্বারা৷ ফলে এই সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতি বা শোষণের কোন স্থান বা সুযোগ থাকবে না৷ একমাত্র তখনই প্রকৃত শোষণমুক্ত সমাজ রচনা  সম্ভব হবে ও এই উদ্দেশ্যে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে প্রাউটের বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে নিরলস প্রচেষ্টা ও ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম করতেই হবে৷