প্রকৃত দেশপ্রেমিক ঋষি ডঃ আবদুল কালাম

লেখক
দেবর্ষি দত্ত

ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে ইফতার পার্টির রেওয়াজ বহুকাল  ধরে চলে এলেও, ছন্দপতন ঘটিয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডক্টর এপিজে আবদুল কালাম৷ তিনি যদিও ধর্মপ্রাণ মুসলমান ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রপতি ভবন তার আমলে ছিল ইফতার পার্টিমুক্ত৷ আসলে তিনি মনে প্রাণে ছিলেন একজন ভারতীয়, আর এটাই ছিল তাঁর আসল ধর্ম, প্রথম পরিচয়....

রাষ্ট্রপতি আবদুল কালামের প্রাক্তন সচিব অবসরপ্রাপ্ত আই.এ.এস পি.এম নায়ারের একটি লেখা থেকে জানা যায়, এই সিদ্ধান্তের পিছনের আসল কারণটি৷ ‘দি কালাম এফেক্ট’, মাই ইয়ার্স উইথ দি প্রেসিডেন্ট’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে৷ তার আগের বছরই নিজের টার্ম শেষ করে,রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়েছেন আব্দুল কালাম৷ নায়ারের বইয়ে লেখা আছে এই ঘটনা সহ কালামের  জীবনের আরও বিস্ময়কর ঘটনা৷

সেখানে পি.এম নায়ার লিখেছিলেন, ২০০২ সালে ডক্টর আবদুল কালাম যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন, তখন রমজান ছিল জুলাই-অগাষ্ট মাসে৷ রাষ্ট্রপতির জন্যে একটা নিয়মিত রেওয়াজ ছিল যে, তিনি রমজানে ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন রাষ্ট্রপতি ভবনে৷

সে অনুযায়ী এই আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার পর, রাষ্ট্রপতি কালাম তার সচিব পি.এম নায়ারকে প্রশ্ণ করেন, কেন তিনি ইফতার পার্টির আয়োজন করবেন রাষ্ট্রপতি ভবনে? কারণ  এই পার্টিতে যে সব অতিথিরা আসবেন, তারা তো সব সময়  ভালো খাবার খেয়েই অভ্যস্ত৷

রাষ্ট্রপতি এও জানতে চান, একটি ইফতার পার্টির আয়োজনে কত খরচ পড়ে৷ সেই সময় রাষ্ট্রপতি সচিবলয়ের তরফ থেকে  জানানো হয়, প্রায় ২২ লাখ টাকা খরচ করা হয়৷ এই ইফতার   পার্টিতে৷ ২০ বছর আগে ২২ লাখ টাকা, ভাবা যায়৷ গরীবের দেশে গণমান্য মানুষদের খাওয়াতে সরকারের খরচা হবে এক সন্ধ্যায় ২২ লাখ টাকা?

শোনামাত্র আদ্যন্ত দেশপ্রেমিক ডক্টর কালাম রাষ্ট্রপতি ভবনে ইফতার পার্টি বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন, ও জানিয়ে দিলেন ঐ টাকা দিয়ে রমজান মাসে খাবার, বই , পোশাক ও কম্বল কিনে  কয়েকটি অনাথ আশ্রমে দান করতে৷ তাঁর ধর্মের অনেক মানুষ এর বিরোধিতা করেছিলেন, তবে এই মহাপুরুষের সিদ্ধান্ত অটল৷

রাষ্ট্রপতি কালামের নির্দেশে অনাথ আশ্রম বাছাইয়ে, রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তাদের একটি টিম ঘটন করা হয়৷ এরপর ডক্টর কালাম তাঁর সচিব পি.এম নায়ারকে ডেকে লাখ টাকার চেক দেন ও জানান সরকারী সাহায্যের পাশাপাশি তিনি তার  ব্যক্তিগত সঞ্চয় থেকে এই অর্থ দান করছেন৷

পি.এম নায়ার তখনই এই খবর সবাইকে জানাতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু আব্দুল কালাম বলেন,  এই তথ্য কারো কাছে প্রকাশ করা যাবে না৷ নায়ার তাঁর বই-তে লেখেন, তিনি  এই ঘটনা সবাইকে জানাতে চেয়েছিলেন৷ কারণ মানুষের জানা উচিত এমন একজন মানুষ আছেন, যিনি শুধুই দেশের মানুষকে ভালোবাসেন৷ সমাজের কিছু উচ্চশ্রেণীর মানুষের জন্য যে অর্থ খরচ হত, তিনি সেটা শুধু দানই করেননি, সেই সঙ্গে নিজের অর্থও বিলিয়ে দিয়েছেন সাধারন মানুষদের মধ্যে৷ পি.এম নায়ার এমন অনেক চমকপ্রদ তথ্য, প্রকাশ করেছেন তাঁর বই-যে৷ ডক্টর এপিজে আবদুল কালাম যখনই বিদেশ যেতেন, তখন তিনি নানারকমের দামি উপহার পেতেন৷ কারোর  কাছে  উপহার নেওয়া, তাঁর একেবারেই পছন্দের ছিল না৷ কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসাবে এই উপহার প্রত্যাখ্যান করা হলে, তা হত কোন জাতির প্রতি অসম্মান করা ও তা নিজের দেশের পক্ষেও বেশ বিব্রতকর৷

সুতরাং তিনি বিনা বাক্য ব্যয়ে এসব উপহার নিতেন৷ কিন্তু ফিরে আসার পর তাঁর নির্দেশ থাকত, সব উপহার -সামগ্রীর  ছবি তুলতে হবে, ক্যাটালগ করতে হবে, এরপর তা রাষ্ট্রপতি ভবনের সংগ্রহ শালায় রেখে দিতে  হবে৷ সব জিনিস রাষ্ট্রপতি ভবনের৷ পি.এম নায়ার জানান, আবদুল কালাম যখন রাষ্ট্রপতি ভবন ত্যাগ করেন, তখন তাকে কোন জিনিস তো দূরে থাক, একটি পেনসিলও নিয়ে যেতে দেখা যায়নি৷

নায়ার লিখেছেন, ডক্টর কালাম তার আত্মীয়দের একবার দিল্লীতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন তাদের নগর পরিদর্শন করাতে তিনি একটি বাস ভাড়া করেছিলেন ও সেই টাকা তিনি নিজে শোধ  করেন৷ কোন সরকারি গাড়ি তার আত্মীয়দের জন্যে ব্যবহৃত হয়নি৷ ডক্টর কালামের নির্দেশে তাঁর আত্মীয়দের থাকা -খাওয়ার খরচ হিসাব করা হয়েছিল, বিল দাঁড়াল দুই লাখ টাকা, যা তিনি নিজে পরিশোধ করেছিলেন৷

দেশের ইতিহাসে কোন রাষ্ট্রপতি, কোনদিন এমন করেননি৷ আর বর্তমান পরিস্থিতিতে আগামী ভবিষ্যতে কেউ করবেন বলে, আশাও করে না দেশবাসী৷ ভারতের ইতিহাসে এক ব্যতিক্রমী, বিরল চরিত্র এপিজে আবদুল কালাম... ওনার মৃত্যু দিবসে আমাদের সকলের তরফ থেকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই৷