প্রসঙ্গ ঃ কুর্মী মাহাতদের আন্দোলন

লেখক
অসিত দত্ত

কুর্মী মাহাত সম্প্রদায় সংরক্ষণের জন্য ‘ইতোপূর্বে’ আন্দোলন শুরু করলেও গত বছর থেকে এই আন্দোলন একটি  উচ্চগ্রামে পৌঁছে যায়৷ কোন কোন স্থানে এই আন্দোলনে পাঁচদিনব্যাপী প্রধান প্রধান সড়ক অবরোধ করা হয়েছিল৷ এমনকি এই সম্প্রদায়ের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি দিল্লী গিয়ে রাষ্ট্রপতির দেখা করে ও সংরক্ষণের দাবী জানায়৷ এদের দাবী এই সম্প্রদায়কে এস.টি (সিউিল্ড ড্রাইব)র মর্যাদা দিতে হবে, কুড়মালী ভাষার স্বীকৃতি ও সারণা ধর্মমতের স্বীকৃতি দিতে হবে৷

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার মহাত্মন থেকে মাহাত শব্দের উৎপত্তি বলেছেন৷ তিনি  বাংলায় যে ছয়টি প্রধান জাত বাঙালীর উল্লেখ করেছেন তারা হল কৈবর্ত, সদগোপ, মাহাত, নমশূদ্র, রাজবংশী ও চাক্‌মা৷ মাহাতরা এই ছয়টি জাত বাঙালীর অন্যতম একটি অর্থাৎ মাহাতরা জাত বাঙালী৷ তিনি বলেছেন, ‘‘এই বাংলা অঞ্চল ছিল মঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় উভয় জাতির বাসভূমি৷ অবশ্য বাংলা দক্ষিণ পশ্চিম অংশে ছিল দ্রাবিড়দের প্রাধান্য ও উত্তর পূর্বাংশে মঙ্গোলীয়৷ পশ্চিমাংশে অষ্ট্রিক, গোষ্ঠীভূক্ত সম্প্রদায়ের বাস ছিল৷ দক্ষিণ পূর্বাংশে দ্রাবিড়দের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত কম৷ মঙ্গোলীয়রা ছিল বেশি৷ মঙ্গোলীয় গোষ্ঠীভুক্ত চাকমা, ত্রিপুরা, ঝোড়ো, কোচ, কিরাত, চুঁয়াড় ও দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত কৈবর্ত, বাগদী, দুলে, শবর, কুর্মী মাহাত, খেড়িয়া ও অষ্ট্রিক ভাবপ্রধান সাওতাল, বাউড়ী, মালপাহাড়ী (মাল বা মালো) প্রভৃতিরাই হচ্ছে সাবেক বাঙালী৷ এদের পারস্পরিক মিশ্রণে ভাবের আদান প্রদানে বর্তমান বাংলার সমাজ ও সভ্যতা গড়ে উঠেছে৷ ‘‘(তন্ত্র  ও আর্য ভারতীয় সভ্যতা দ্রষ্টব্য)৷

ভারতে সংরক্ষণ ব্রিটিশ যুগে চালু হয়েছিল৷ ব্রিটিশের উদ্দেশ্য ছিল এদেশ শাসন ও শোষণ করা৷ সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণ করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না৷ কিন্তু ভারতবাসীরা যাতে   তা না বুঝতে  পারে তাই উন্নয়নের নামে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে  বিভাজন সৃষ্টি করার জন্য সংরক্ষণ প্রথা চালু করার উদ্যোগ নেয়৷ উদ্দেশ্য ছিল ভারতবাসী যেন ঐক্যবদ্ধ না হয় ও ভবিষ্যতে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে ব্রিটিশ বিরোধিতা না করতে পারে৷ এর প্রথম সূচনা হয়েছিল ১৮৮২ সালে হান্টার কমিশনের উদ্যোগে৷ তারপর ধাপে ধাপে আরো কিছু সংযোজন করে লোক দেখানো একটি বিধিবদ্ধ রূপ দেয়৷

যাই হোক আমরা অনেক রক্ত অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা পেয়েছি সেই কোন ১৯৪৭ সালে৷ তারপর ১৯৫০ সালে সংবিধান গৃহীত হয়েছে৷ সংবিধান প্রণেতারা একটা জিনিস বিশেষভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে ব্রিটিশ পরিত্যক্ত ও তাদের কৃতকর্মে ভারতের  জনগণের  সামগ্রিক কল্যাণের পরিবর্তে সে বৈষম্য রয়েছে, যে  ভেদবুদ্ধি বিরাজ করছে তা দূর করতে না পারলে দেশের উন্নতি বা প্রগতি সুষ্ঠুভাবে হতে পারে না৷  দেশের উষ্ণবর্ণের অধিবাসীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা দীক্ষায় অনেক বেশী এগিয়ে রয়েছে৷ অবশিষ্ট  অধিবাসীদের যারা সংখ্যায় অনেক বেশী তাদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসতে হবে ও উচ্চবর্ণের এগিয়ে থাকা অধিবাসীদের সমান মর্যাদায় তুলে আনতে হবে৷

এ ব্যাপারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার কালজয়ী কবিতা,

‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ মধ্য দিয়ে

সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন৷

‘যারে তুমি নীচে ফেল সে

তোমারে বাঁধিবে যে নীচে

পশ্চাতে রেখেছ যারে সে

তোমারে পশ্চাতে টানিছে৷’

অর্থাৎ কাউকে নীচে ফেলতে চাইলে সেও তাকে নীচে ধরে রাখবে ও যাকে পশ্চাতে রাখবে সেও তাকে পশ্চাতে টেনে নিয়ে যাবে৷ সংবিধান প্রণেতারা এই মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন৷ ফলে পিছিয়ে পড়া মানুষকে একসাথে তুলে আনার জন্য ডঃ বি.আর আম্বেদকরের সভাপতিত্বে গঠিত সাংবিধানিক কমিটি ১০ বছরের জন্য সংরক্ষণ চালু করে৷ কিন্তু সংবিধান প্রণেতাদের যে প্রত্যাশা ছিল যে দশবছরের জন্য সংরক্ষণ চালু করলেই স্বাধীন ভারতের শাসকেরা পিছিয়ে পড়া লোকদের অবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে সকলকে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে তা কিন্তু হল না৷ ফলে সংরক্ষণের মেয়াদ বছরের পর বছর বাড়িয়ে চলা হল৷ যার অর্থ হল পিছিয়ে পড়া মানুষদের সমানতালে এগিয়ে নিয়ে আসা সম্ভব হল না৷  এটা সরকার গুলির অপদার্থতা ও ব্যর্থতার নমুনা৷ এখন সংরক্ষণের হার সিডিউল্ড কাষ্টদের জন্য ১৫ শতাংশ, সিউিউল্ট ট্রাইবদের জন্য সাড়ে সাত শতাংশ ও ওবিসিদের জন্য  ২৭ শতাংশ৷ আবার ২০১৯ সাল থেকে  ইকোনোমিক্যালি উইকার সেকশন -এর জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ করা হয়েছে৷ এই সংরক্ষণ এখন বাড়িয়ে বাড়িয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত করা হয়েছে৷

যার ফলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিদ্বেষ ও বিভেদ এখনও বিরাজ করছে৷

এব্যাপারে বর্তমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও দুর্দশা মোচনে মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর প্রাউট দর্শনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে নিম্নলিখিত অগ্রাধিকার ব্যবস্থা চালু করার বিধান দিয়েছেন৷ যথা

* জন্মসূত্রে যাই হোক না কেন, পিছিয়ে পড়া, গরীব পরিবারের সদস্য চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রথম অগ্রাধিকার পাবে৷

* গরীব কিন্তু পিছিয়ে পড়া নয় এমন পরিবারের সদস্য দ্বিতীয় অগ্রাধিকার পাবে৷

* গরীব নয়, কিন্তু পিছিয়ে পড়া পরিবারের সদস্য তৃতীয় অগ্রাধিকার পাবে৷

* সবশেষে সুযোগ পাবে গরীবও নয়, পিছিয়ে পড়াও নয়, এমন পরিবারের সদস্য৷

বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে সকলের বিবেচনা করা দরকার৷ একটা বিরাট সমস্যা সমাধানের জন্য এটা বাস্তবায়িত করার চিন্তা ভাবনা শুরু উচিত৷