পশ্চিমবঙ্গ, বাঙলাদেশ, ত্রিপুরা ও অসম সমন্বিত ভারতের পূর্বাঞ্চলের এই বিশাল ভূভাগটি জলবায়ুর দিক থেকেও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ৷ সমগ্র অঞ্চলের জলবায়ুই উষ্ণ ও আর্দ্র৷ সমুদ্র কাছাকাছি বলে শীত–গ্রীষ্মও ততটা প্রখর নয়৷ তথাপি এর পশ্চিম অংশের সঙ্গে পূর্বাংশের জলবায়ু–গত কিছুটা পার্থক্য আছে৷ পশ্চিমাংশের সমভূমিতে গ্রীষ্মে ১২০0 ফারেনহাইট পর্যন্ত উষ্ণতা বৃদ্ধি পায় আবার শীতকালে উষ্ণতা ৫৫0 ফারেনহাইটে নেমে আসে৷ কিন্তু পূর্বাংশে অর্থাৎ ত্রিপুরা–সমে জলবায়ু অপেক্ষাকৃত সিক্ত ও আর্দ্র৷ পশ্চিমের রাঢ় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে গড়ে ৫০ –৫৫ ইঞ্চি সেখানে পূর্বাঞ্চলের অসম–মেঘালয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের গড় পরিমাণ ৫০৮ ইঞ্চি ৷ উত্তরে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২০ ইঞ্চি৷ দক্ষিণে সুন্দরবন অঞ্চলে গড়ে বৃষ্টিপাত হয় ১০০ ইঞ্চি৷ দক্ষিণ– পশ্চিম মৌসুমীবায়ু হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পশ্চিমে বেঁকে অসম, ত্রিপুরা, বাঙলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় ও বিহার প্রদেশের ওপর দিয়ে বৃষ্টিপাত করতে করতে আরও পশ্চিমে অগ্রসর হয়৷ কিন্তু যতই পশ্চিমে অগ্রসর হতে থাকে ততই এতে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমতে থাকে৷ বায়ু ক্রমশঃই শুষ্ক্ হতে থাকে৷
ভৌগোলিক পরিবেশ–পরিমণ্ডল স্থানীয় অধিবাসীর পোষাক–পরিচ্ছদ, খাদ্যদ্রব্য দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য সামগ্রী, আচার–আচরণকে বিপুলভাবে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত করে৷ এমনকি স্থানীয় জলবায়ুই তার অধিবাসীর ভাবনাচিন্তা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও স্বভাবকে নিয়ন্ত্রিত করে৷ বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় দেখা গেছে আর্দ্র–জলবায়ুর অধিবাসীরা যে পরিমাণে কর্মপটু তার চেয়ে অনেক বেশী কর্মপটু শুষ্ক্ অঞ্চলের অধিবাসীরা৷ জলবায়ুর আর্দ্রতা ও উষ্ণতা একযোগে স্থানীয় অধিবাসীর কর্মক্ষমতাকে কমিয়ে ফেলে, আলস্যে অভিভূত করে৷ এই তত্ত্ব অনুযায়ী দেখা গেছে পূর্বাঞ্চল থেকে যতই পশ্চিমে অগ্রসর হওয়া যায় ও আর্দ্রতা যতই কমতে থাকে ততই মানুষ কর্মঠ হয় ও কর্মপটুতা লাভ করে৷ শুষ্ক্ জলবায়ু মানুষের কর্মশক্তিকে বৃদ্ধি করে৷ এই কারণে ভারতের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত অধিবাসীদের তুলনায় পশ্চিমের অধিবাসীদের কর্মপটুতা অনেক বেশী৷ ভারতরাষ্ট্রের উত্তর–পশ্চিমে অবস্থিত পঞ্জাব ও সর্ব পূর্বে অবস্থিত অসম৷ এই দুই অঞ্চলের জলবায়ুতে আর্দ্রতা ও শুষ্ক্তার হিসেব করলে দেখা যাবে উভয়ের জলবায়ুর মধ্যে এক বিরাট ব্যবধান৷ এই ব্যবধান উভয় অঞ্চলে অধিবাসীদের পোষাক–পরিচ্ছদ শুধু নয়, খাদ্যদ্রব্য ও চারিত্রিকতাতেও বিরাট পার্থক্য এনে দিয়েছে৷ ভারতের উত্তর–পশ্চিমে অবস্থিত পাঞ্জাবীরা সবচেয়ে শুষ্ক্ জলবায়ুর দেশে বাস করে বলে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীদের চেয়ে তারা অনেক বেশী কর্মক্ষম ও নিরলস৷ অন্যদিকে ভারতের সর্বাপেক্ষা পূর্ব–প্রান্তের অধিবাসী হিসেবে সর্বাপেক্ষা আর্দ্র ও ভিজা অঞ্চলের অধিবাসী বলে অসমীয়ারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের অধিবাসীর চেয়ে অনেক পরিমাণে কম কর্মক্ষম ও তুলনায় অতিরিক্ত আলস্যপরায়ণ৷ তাই পাঞ্জাবের অধিবাসীর পক্ষে ভারতের যে–কোনো স্থানে স্থায়ী বাসিন্দা হবার পক্ষে কোনো অসুবিধা হয় না৷ কিন্তু পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীর পক্ষে পশ্চিমে পাড়ি জমিয়ে পশ্চিমের অধিকতর শুষ্ক্ জলবায়ুতে পরিশ্রম করা তার পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পড়ে৷ এই কারণে পাঞ্জাবীরা ভারতের যে–কোন প্রান্তে বসবাস করতে অসুবিধা বোধ করে না, কিন্তু পূর্বাঞ্চলের অধিবাসী পশ্চিমের শুষ্ক্ অঞ্চলে বাস করেতে ও কঠোর পরিশ্রম করতে অসুবিধায় পড়ে৷ পূর্বের অধিবাসী পশ্চিমের অধিক পরিশ্রমী মানুষদের মত সেইসব স্থানের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না বা তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠে না৷
এই কারণেই পূর্ববঙ্গ থেকে আগত উদ্বাস্তু যারা দেশবিভাগের পরে ভারতে বসবাস শুরু করে, মধ্যপ্রদেশের দণ্ডকারণ্যে গিয়ে সেখানকার গরম ও শুষ্ক্ আবহাওয়া তেমনভাবে মানিয়ে নিতে পারেনি৷ অবশ্য তাদের এই মানিয়ে না নিতে পারার পিছনে অন্য অর্থনৈতিক কারণও বিদ্যমান, কেন না তাদের সেখানে প্রাণধারণ করার যথেষ্ট ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়নি৷ তুলনামূলকভাবে এই পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু যারা অসম, মেঘালয় ও আন্দামানে বাস করতে শুরু করেছিল, তারা সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে সহজেই খাপ খাইয়ে নিয়েছিল৷ এর প্রধান কারণ এইসব স্থানের উদ্বাস্তুরা স্থানীয় জলবায়ুর সঙ্গে তৎক্ষণাৎ মানিয়ে নিতে পেরেছিল৷ দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুদের আজও ভাসমান জনসমুদায় বলে মনে করা হয়, অন্যদিকে পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে যেমন অসম, মেঘালয়, মিজোরাম, ত্রিপুরা আর মণিপুর–উদ্বাস্তুরা সেখানকার স্থায়ী অধিবাসী৷ তারা অনেক স্থানেই ঝোপঝাড় আগাছা কেটে সাফ করে, গ্রাম তৈরী করে স্থায়ী জীবিকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে৷
তাই পূর্বার্দ্র নীতি উদ্বাস্তু সমস্যার স্বাভাবিক ও বিজ্ঞানসম্মত সমাধান দিয়েছে, কেননা এই তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ স্থানীয় জলবায়ু ও অবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে নিতে পারে৷ পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু যারা পূর্ব ভারতে স্থায়ীভাবে বাস করছে, তারা এইজন্যে তাদের কর্মসামর্থ্যকে কাজে লাগাতে পেরেছে, আর তাই তারা স্থায়ী বাসগৃহ, জমিজমা তৈরী করে নিয়েছে৷ তারা পূর্বভারতে স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে নিজেদের আর্থিক ভাগ্যকে একাত্ম করতে পেরেছে৷ আজ তাদের উৎখাত করার চিন্তা করাও অসম্ভব ও অমানবিক৷
দেশ বিভাগের সময় কংগ্রেস নেতারা জোর গলায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘুরা ভারতের যে–কোনো প্রান্তে ইচ্ছামত বাস করতে পারে৷ সেই মানুষেরা সেই প্রতিশ্রুতিকে বিশ্বাস করেছিল আর তাই বঙ্গ বিভাজনও মেনে নিয়েছিল৷ বর্তমানে অসমে পূর্ববঙ্গ থেকে আগত মানুষদের সেখান থেকে বিতাড়িত করার জন্যে আন্দোলন চলছে৷ কেন্দ্রীয় সরকারের কর্ত্তব্য তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করা আর আন্দোলনকারীদের সংযত করা, যাতে অসমে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী উদ্বাস্তুদের সর্ববিধ কল্যাণ সুনিশ্চিত হয়৷ যেমন উদ্বাস্তরা নদীয়া ও চব্বিশ পরগণা জেলায় এসেছিল তাদের অধিকাংশই সেখানকার স্থায়ী অধিবাসী হয়ে গেছে৷ তারা তাদের শারীরিক–মানসিক সামর্থ্যকে কাজে লাগাতে কোনো অসুবিধাই বোধ করেনি, কেননা তারা প্রায় একই রকমের ভৌগোলিক–আর্থিক–মান্ অঞ্চলের অধিবাসী আর স্থানীয় আবহাওয়া ও পরিস্থিতির সঙ্গে পরিচিত৷ অবশ্য উদ্বাস্তুদের কিছু অংশ যারা চব্বিশ পরগণা জেলায় বসতি স্থাপন করেছেন, তারা এখনও সেখানে প্রায় ভাসমান জনসমুদায়৷ কেননা সেখানে তাদের জীবনধারণের উপযোগী উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়নি৷
ভাসমান জনগোষ্ঠীর একটি মানসিক অসুবিধা হচ্ছে এই যে, তারা নূতন স্থানকে নিজস্ব বলে সহজে মনে করতে পারে না, তাই তারা ফেলে আসা জমিজমা, বাড়িঘরের কথা ভুলতে পারে না৷ এই কারণেই স্থানীয় অধিবাসীদের মত তাদের সামাজিক–অর্থনৈতিক সংহতি বোধ তৈরী হতে দেরী হয়৷
১৯৮১, কলিকাতা