একটু আগেই বলেছি, ‘খর’ শব্দের একটি অর্থ ‘রাক্ষস’৷ যতদূর মনে হয় প্রাচীনকালের আর্যরা অষ্ট্রিক–নিগ্রোয়েড বা দ্রাবিড়গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের রাক্ষস বলে অভিহিত করতেন৷ কারণ, তাঁদের নিজেদের লেখাতেই ধরা পড়ে যে রাক্ষসদেরও উন্নতমানের সভ্যতা ছিল৷ তারা বড় বড় শহর–নগরীর পত্তন করেছিল....তারা ধর্মাচরণ করত....তারা শিবভক্ত ছিল....তারা শিবের আশীর্বাদে অমিত প্রতিভা ও শক্তিসম্পদের অধিকারী হয়েছিল৷ তাদের হেয় করবার জন্যে বিভিন্ন পুস্তকে তাদের সম্বন্ধে বহু অবাঞ্ছিত মন্তব্য কর হয়েছে৷ তবে হ্যাঁ, একথাটি ঠিকই যে তারা আর্যদের বেদ ও যাগ–যজ্ঞের বিরোধী ছিল৷ আর সম্ভবতঃ যজ্ঞে মূল্যবান খাদ্যবস্তুর অপচয় হ’ত বলে তারা কোথাও যজ্ঞানুষ্ঠান হতে দেখলেই সেখানে এসে তা পণ্ড করে দিত৷ রাবণকেও রাক্ষস বলে চিত্রিত করা হয়েছিল সম্ভবতঃ তিনি বেদবিরোধী ছিলেন বলে৷ যদিও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে রাবণ ছিলেন পুলস্ত্য মুনির বংশজাত (কোন কোন মতে মহর্ষি বিশ্বশ্রবার বংশজাত)৷ তাঁর মাতা নিকষা বা কৈকসী ছিলেন রাক্ষসকুলজাতা৷ রাম চরিত্রটিকে মর্যাদা–পুরুষোত্তম আখ্যা দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ পুরুষোত্তম যদি নররূপে স্বশরীরে ধরাধামে অবতীর্ণ হতেন তা হলে তিনি কী কী কাজ করে যেতেন তার সম্ভাব্য চিত্র এই রামায়ণে দেওয়া হয়েছে৷
রামায়ণ কতটা সার্থক হয়েছিল বলা শক্ত৷ তা’ বলতে গেলে এক কলমের খোঁচায় বলা সম্ভব নয়৷ কারণ, যা কিছু বলতে ও লিখতে হবে তাও নিক্তির ওজনে মেপেই করতে হবে৷ রাবণের প্রতি রামের ব্যবহার দম্ভ–সম্পৃক্ত অর্থাৎ রাবণের কোন কোন আচরণ (সীতাহরণ) যেমন সমর্থন করা যায় না তেমনি রামেরও কোন কোন আচরণ সমর্থন করা যায় না৷
পুরুষোত্তম নির্দোষ বালীকে বধ করতে যাবেন কেন কেবলমাত্র রাবণ বধের উদ্দেশ্যে তিনি অনুন্নত চরিত্র সুগ্রীবের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন কেন এ যেন সেই আজকের দিনের রাজনৈতিক দলগুলির মত–সুবিধামত কাউকে নিন্দাবান্দা করছে...আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে....আবার বেকায়দায় পড়লে বা দায়ে ঠেকলে পরমুহূর্তেই তাদের সঙ্গে মুখ শোঁকাশুঁকি করছে....আড়ালে বসে শলাহ্ পরামর্শ করছে....প্রকাশ্যে জনসভায় তাদেরই নিন্দা করছে....আবার গোপনে বলে রাখছে আমরা বাইরে একে অন্যের নিন্দা করব কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা ‘‘ভাই ভাই, এক ঠাঁই, ভেদ নাই, ভেদ নাই’৷
রাম কর্তৃক সীতার অগ্ণিপরীক্ষা কোন মতেই সমর্থনযোগ্য নয়৷ রাম কর্তৃক গর্ভবতী সীতাকে ত্যাগ করা ও অসহায়া নারীকে বাল্মীকির আশ্রমে প্রেরণ করা কোনমতেই সমর্থন করা যায় না৷ দ্বিতীয়বার সীতার অগ্ণিপরীক্ষা করতে চাওয়াও অমানুষিক৷ রামায়ণে উন্নত চরিত্র বলতে যা বোঝায় তা রয়েছে তিনজনের–সীতা, উর্ম্মিলা ও লক্ষ্মণ৷ জটায়ুর চরিত্রও ত্যাগে ও মহানুভবতার দ্যুতিতে ভাস্বর৷ তা সে যাইহোক, রাম কর্তৃক নির্বিবাদে রাক্ষস হত্যা কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়৷ তবে, রামায়ণ মতে যেহেতু রাম খরদের অর্থাৎ রাক্ষসদের ধবংস করেছিলেন সেইহেতু সংস্কৃতে রামের একটি নাম ‘‘খরধ্বংসিন’’–(‘ইন’ ভাগান্ত শব্দ) প্রথমার একবচনে ‘খরধ্বংসী’৷
নিরীহ বালীকে হত্যা করার প্রতিবাদে বালীপত্নী তারা বলেছিলেন–
‘‘বিপদবারণ তুমি নারায়ণ,
লোকে বলে তোমায় করুণানিধান৷
তবে কেন হয়ে লুণ্ঠিত ধরায়,
স্বর্ণচূড়া স্বামীর ভূতলে পতন৷
যে অনলে প্রভু জ্বালালে আমায়
সেই অনলে তুমি জ্বলিবে নিশ্চয়৷
জানকী পাইবে, পুনঃ হারাইবে,
কেঁদে কেঁদে হবে দিবা অবসান৷’’
এই তারা সম্বন্ধে বলা হয়েছে–
‘‘অহল্যা–দ্রৌপদী–কুন্তী তথা৷
পঞ্চকন্যা স্মরেন্নিত্যং মহাপাতকনাশনম্’’৷
এই পঞ্চকন্যাকে স্মরণ করলে মানুষের জন্ম–জন্মান্তরের পাপ দূর হয়....মন নির্মল হয়৷
‘কর’ বা রাক্ষস একটি অবজ্ঞাসূচক শব্দ৷ নিষ্ঠুরতা বা বীভৎসতার সমাবেশ বোঝাবার জন্যে এই শব্দটি ব্যবহার করা হ’ত৷ মানুষকে পরুষ বাক্য হিসেবে রাক্ষস বলা হয়ে থাকে৷ মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, উন্নাসিক আর্যরা (আসলেও এদের নাক উঁচু ছিল) অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় সভ্যতাকে সহ্য করতে পারত না৷ তাদের সভ্য বলে স্বীকৃতি দিতে তাদের মানে বাধত৷ তাদের ধারণাটা ছিল যেন সভ্যতার তথা মার্জিত রুচির একচেটিয়া দালালির অধিকার শুধু আর্যদেরই আছে৷ এই উন্নাসিকতার ফলে নিজেদের নাম রেখেছিল ‘আর্য’ যার একটি মানে প্রগতিশীল, অপর মানে সংস্কৃতিসম্পন্ন৷
কিছুটা আর্যপ্রভাব মুক্ত ছিল বলে বৌদ্ধ–জৈনদের মধ্যে আর্যানার্য ভেদ ছিল না৷ তাই জৈন ও বৌদ্ধদের কাছে রাবণের বেশ একটা সম্মানের স্থান ছিল৷ তোমরা জানই তো রামায়ণ বিধিবদ্ধভাবে মহর্ষি বাল্মীকি রচনা করলেও তার আগে থেকেই রামায়ণ ছিল .... ছিল বৌদ্ধ রামায়ণ .... জৈন রামায়ণ .... ছায়া রামায়ণ .... গান রামায়ণ .... অধ্যাত্ম রামায়ণ প্রভৃতি৷ বাল্মীকি রামায়ণ কতকটা আর্য ধ্যান ধারণার প্রতীক৷ সেকালে যারা বেদের বা আর্ষ–মতবাদের বিরোধিতা করত আর্যদের কাছে তারাই ছিল রাক্ষস .... তারা ছিল অসভ্য ধর্মদ্বেষী৷ এই আর্য মহামান্যতার প্রভাবে হয়তো (বাল্মীকি রামায়ণের তুলসীকৃত পাঁচালী সাহিত্যে অর্থাৎ রামচরিতমানসে বিপ্র–শূদ্রের ভেদরেখাও টানা হয়েছিল যদিও তুলসীদাস রামায়ণকে রামায়ণ না বলে বলেছিলেন ‘রামচরিত মানস’ অর্থাৎ মানসলোকে আমি রামচরিত্রকে যেভাবে দেখেছি) তিনি তাঁর মন থেকেও বিপ্র–শূদ্র ভেদকে সরিয়ে দিতে পারেননি৷ তাঁর রামায়ণও বহু সম্পদের আকর ও বহু প্রশংসার মণিদ্যুতি