ৰাংলার দুর্র্গেৎসব

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

 প্রাচীন মহাযানী বৌদ্ধ ও পৌরাণিক হিন্দুদের যে সকল দেবতার সঙ্গে ধনুক থাকত তাদের কাউকে কাউকে চাপধারী বা কোদণ্ডধারী ৰলা হত৷ শিবের সম্বন্ধেও ৰলা হ’ত ‘কোদণ্ডদণ্ডপাশহস্ত্৷’ বামাচারী তান্ত্রিক দেবী তথা বৌদ্ধতন্ত্রে স্বীকৃতা যোড়শী বা রাজরাজেশ্বরী সম্বন্ধে (আধুনিক যুগের জগদ্ধাত্রী এরই একটি বিবর্তিত রূপ৷ জগদ্ধাত্রী পূজার ইতিহাস একটু পরে ৰলছি) ৰলা হয়েছে ‘পাশাঙ্কুশচাপধারিণী শিবা’৷

জগদ্ধাত্রী পূজা সম্বন্ধে এই প্রসঙ্গে দু’চারটে কথা ৰলছি৷ তোমরা নিশ্চয়ই জান যে দুর্গাপূজা কৌন প্রাচীন পূজা নয়৷ এমনকি, মুখ্যতঃ যে পুরাণের ওপর দুর্গাপূজা নির্ভরশীল সেই মার্কণ্ডেয় পুরাণও বৌদ্ধোত্তর যুগের৷ এই মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে নির্বাচিত ৭০০ শ্লোককে ৰলা হয় দুর্গাসপ্তশতী বা শ্রীশ্রীচণ্ডী৷ অন্যান্য যে সকল গ্রন্থের ওপর নির্ভর করে বিশেষ বিশেষ স্থানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় সেগুলি হচ্ছে ‘দেবীপুরাণ’, ‘দেবীভাগবত’, ‘কালিকাপুরাণ’, ‘বৃহৎ নন্দিকেশ্বর পুরাণ’ ও ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’৷ এরা কেউই ১৫০০ বছরের চেয়ে পুরোণো পুস্তক নয়৷ আর ৰলা বাছল্য যে পাঠান যুগের পূর্বে বিভিন্ন শাস্ত্রে উল্লিখিত দুর্গা ছিল অষ্টভুজা৷

দশভূজা বা বাঙলার এই শরৎকালীন পুজার প্রবর্তন করেন ৰরেন্দ্রভূমির রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংসনারায়ণ রায় (সম্ভবতঃ আসল পদবী ছিল সান্ন্যাল’)৷ শরৎকালীন সেই দুর্গাপূজা ৰাঙলায় অল্প কালের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে--- প্রথমে তৎকালীন জমিদারদের মধ্যে, তারপর অন্যান্যদের মধ্যে৷ শেষ পর্যন্ত জিনিসটা হয়ে দাঁড়ায় টাকার খেলার প্রতিযোগিতা৷ তাহেরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ দুর্গাপূজায় খরচ করেছিলেন সাত লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা৷ পরবর্তীকালে একটা কিয়ার রাজা জগৎ নারায়ণ খরচ করেন সাড়ে আট লাখ টাকা৷

বলা বাহুল্য মাত্র, সেকালের নামী জমিদারি নদীয়া এষ্টেটের রাজারাও দুর্গাপূজা শুরু করেছিলেন খুৰ ধূমধাম করে, ধর্মগত বিশ্বাসে তারা ছিলেন শাক্ত, নদীয়া কিন্তু বৈষ্ণব ধর্মের বন্যাতেই ভেসেছিল৷

‘নাটোরের দানখয়রাৎ কাসিম ৰাজারের দীপ্তি৷ বর্দ্ধমানের দেবোত্তর নদীয়ার কীর্তি৷৷’

সুতরাং কীর্তিমান নদীয়ার রাজারা ৰেশ জাঁকজমকের সঙ্গে দুর্গাপূজা করতে লাগলেন৷ একবার আশ্বিনের কিস্তিতে মালগুজারীর টাকা বাকী পড়ায় ৰাঙলার নবাৰ কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে গ্রেপ্তার করেন৷ দুর্গাপূজার সময় তাকে আটকে থাকতে হ’ল মুর্শিদাৰাদের কারাগারে মালগুজারীর বকায়া (এই থেকে বাংলায় ‘বকেয়া’ শব্দ এসেছে) রাখা জমিদারদের শাঈস্তা করবার জন্য মুর্শিদাৰাদের নবাৰ যে বিশেষ ধরণের কারাগার তৈরী করেছিলেন জমিদারদের ক্লেশ দেবার জন্য সেটির নাম ছিল বৈকুণ্ঠ৷ দুর্গাপূজার সময় রাজা থেকে গেলেন সেই বৈকুন্ঠে৷

মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ফিরে এলেন কোজাগরী পূর্ণিমার পরে৷ তখন তো আর নূতন করে দুর্গাপূজা করা যায় না৷ তিনি ৰললেন, স্বপ্ণে তিনি এক দেবী মূর্তি দেখেছেন৷ রাজার মুখ থেকে যে বর্ণনা পাওয়া গেল তন্ত্রোক্ত রাজরাজেশ্বরী বা ষোড়শীদেবীর সঙ্গে মেলে যা হিন্দু ও মহাযানী বৌদ্ধ উভয় তন্ত্রেই স্বীকৃতা৷ তখন তিনি ঘটা করে এই পুজো৷ করলেন---দেবীর নাম রাখলেন জগদ্ধাত্রী৷ পুজোটি অনুষ্ঠিত হ’ল দুর্গাপূজা৷ অনুষ্ঠিত হবার ঠিক এক মাস পরে শুরু পক্ষে৷ কিন্তু সময় অল্প থাকায় দেবী পক্ষের সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমীর পূজা এক সঙ্গে নবমীতে সারা হ’ল৷ দুর্গাপূজা যেখানে পাঁচ দিনের, জগদ্ধাত্রী পূজো সেখানে দু’দিনের৷ তোমরা ডি. এল. রায়ের ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে’ কবিতাটিতে ‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দের উল্লেখ পেয়েছ (‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে জগতের যিনি ধাত্রী৷ কবি ডি. এল. রায় ‘জগদ্ধাত্রী’ শব্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সম্ভবতঃ তিনি ছিলেন কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা এই কারণে৷ তাছাড়া তার পিতা কার্তিকেয় চন্দ্র রায় ছিলেন নদীয়া এষ্টেটের দীবান৷

যাই হোক, কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পূজোর এই ধুমধাম দেখে সেই সময়কার নদীয়া এষ্টেটের দীবান সম্ভবতঃ গঙ্গাগোবিন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের শহর চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজোর প্রবর্তন করেন৷ তবে কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজোর বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে কৃষ্ণনগরে পূজোর সংখ্যা ছিল ৰেশী, জাঁকজমকও বেশী, কিন্তু চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী ছিল অতি বৃহদাকারের৷ এটাই চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীর মুখ্য বৈশিষ্ট্য৷ যাই হোক, দূর্গাপূজা যেমন প্রাচীন নয়, পাঠান আমলের পূর্বার্দ্ধের জিনিস, তেমনি জগদ্ধাত্রী পূজাও ৰাঙলার নবাৰী আমলের অন্তিমকালের৷ এই ষোড়শীর হাতে চাপ থাকায় ৰলা হত ‘পাশাঙ্কুশচাপধারিণী শিবা’৷ (শব্দ-চয়নিকা’, ৮/৩২)