রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক অবিস্মরণীয় অবিসংবাদিত নাম৷ যিনি চির স্মরণীয় ও চির বরণীয়৷ রবীন্দ্রনাথ কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও ঔপন্যাসিক, ছান্দসিক সমবায় নীতির পথিকৃত৷ সর্বোপরি তিনি মানব মৈত্রীর ঋষি৷ এ কথায় কোন বিশেষণই তাঁর পক্ষে যথেষ্ট নয়৷ ৮০ বছরের বৃত্তে দাঁড়িয়ে তিনি হাজার বছরের কাজ করেছিলেন৷ আমরা গর্বিত ও ধন্য এই ভেবে তিনি বাঙলার ভূমিপুত্র৷ আমরা অত্যন্ত গর্বিত ও সৌভাগ্যবান এই কারণে আমরা রবীন্দ্রনাথের দেশে জন্মগ্রহণ করেছি৷
রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর প্রতিভার ব্যাসার্ধ অসীম৷ তার প্রতিভার গভীরতা অতলান্ত৷ তিনি আমাদের চিন্তনের অতীত৷ আমাদের ভাবনার অতীত৷ স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে একটা প্রশ্ণ উঁকি দেয়----সেটা হ’ল রবীন্দ্রনাথ এক না একাধিক?
সেটা ছিল ১৯১৩ সাল৷ ভারতবর্ষ তখন পরাধীন৷ সারা দেশে চলছে জঙ্গী ব্রিটিশের লাগামহীন শাসন ও শোষণ৷ ব্রিটিশের সীমাহীন শোষণে আর অত্যাচারে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে এদেশের মাটি আর মানুষ৷ এমনই রাষ্ট্রীয় প্রেক্ষাপটে ওই বছর অর্থাৎ ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসামান্য কীর্তির জন্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন৷ সারা বিশ্বে এক অবর্ণনীয় সাড়া পড়ে গেল৷ অনেকে বিস্ময়ে হতবাক্ হলেন৷ যে মানুষটি বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী অতিক্রম করেননি, এ হেন মানুষ নোবেল পুরস্কার লাভ করলেন৷ রবীন্দ্রনাথের বিস্ময়কর প্রতিভা সেদিন স্বীকৃতি লাভ করল৷ রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববন্দিত হলেন৷ তিনি আন্তর্জাতিক মানুষের সমীহ আদায় করলেন৷
এবার আমি মূল বিষয়ে প্রবেশ করছি৷ মূল বিষয়ে প্রবেশ করছি অনেক বিস্ময়, জিজ্ঞাসা আর ভাবনা নিয়ে৷ রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার লাভ করে দেশ ও দেশবাসীর গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন এটা অনস্বীকরণীয়৷ কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপ ও লজ্জার বিষয় হ’ল সেই নোবেল অত্যন্ত আশ্চর্যজনকভাবে শান্তিনিকেতন হতে চুরি হয়ে যায় বেশ কয়েক বছর আগে৷ এই চুরির ঘটনায় অনেকে বিস্মিত, লজ্জিত ও মর্মাহত হয়েছিলেন৷ এর ছাপ প্রবাসী ভারতীয়দের মনে গভীর দাগ কেটেছিল৷ এই চুরির অনুসন্ধানে আমাদের দেশের ও রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগ, পুলিশ বিভাগ ও প্রতিরক্ষা বিভাগের অনেক কর্তা ও কর্মী ঝাঁপিয়ে পড়েছিেেলন৷ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নোবেল অন্ধকারেই থেকে যায়৷ এ ব্যাপারে একটা নড়বড়ে একটা তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছিল৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি৷
সময়ের আবর্তনের পথ ধরে এই ভাবেই মাস, বছর অতিক্রান্ত হয়৷ প্রতি বছর সারা দেশে সাড়ম্বরে রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসব পালিত হয়৷ রবীন্দ্র নৃত্য, কবিতা, স্মারক বত্তৃণতা সবকিছুই প্রথা মাফিক চলতে থাকে৷ পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ বার্ষিকীও পালিত হয়৷ এই সব অনুষ্ঠানের নেপথ্যে কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের হারানো নোবেল নিয়ে বিস্ময়, পরিতাপ কিংবা দীর্ঘশ্বাস এসব কী কিছুই দেখ যায় না? এদের চিত্ত কি এই লজ্জাজনক ঘটনায় একবারের জন্যও কি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে না৷
সারা দেশে বিভিন্ন সময় সরকার গঠিত হচ্ছে৷ সরকারের পক্ষ থেকে চমকপ্রদ ও মিথ্যার ফানুসে ঢাকা প্রতিশ্রুতির বন্যাও বয়ে যায়, মানুষও বিভ্রান্ত হয়৷ কিন্তু আমরা অবাক হয়ে যাই কোন সরকারের পক্ষ থেকে রবীন্দ্রনাথের হারানো নোবেলকে খুঁজিয়ে নিয়ে আসা হবে এমন দৃপ্ত ঘোষণা শোনা যায়নি৷ যে দেশে প্রতিরক্ষা দফতর থেকে শুরু করে গোয়েন্দা বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী আছে সে দেশে রবীন্দ্রনাথের নোবেল আমাদের কাছে অধরাই থাকবে? আমাদের প্রশ্ণটা এখানেই আর বিস্ময়টাও এই খানেই৷
আমার বেশ মনে আছে, আজ থেকে কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের এক প্রভাবশালী তথা প্রতাপশালী মন্ত্রীর পুত্রের গাড়ী থেকে একটি ‘ব্রিফকেস’ খোয়া যায়৷ এই ঘটনায় কলকাতার বুকে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়৷ মন্ত্রীর পুত্রের ব্রিফকেস হারিয়েছে৷ মানে এক ক্ষমাহীন অপরাধ৷ বলা বাহুল্য কোলকাতা পুলিশের ব্যাপক তৎপরতায় সেই ব্রিফকেস ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উদ্ধার করা হয় ও মন্ত্রীপুত্রের হাতে সেটি সমর্পণ করা হয়৷ কিন্তু রবীন্দনাথের নোবেন? নোবেল উদ্ধারের ব্যাপারে সেই তৎপরতা তলানীতে গিয়ে কীভাবে ঠেকল? অনেক প্রশ্ণই আমাদের মধ্যে উঁকি দেয় বৈকী৷
আমরা যখন বিদালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষামূলক ভ্রমণের জন্যে ছাত্রছাত্রাদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে যাই এবং নির্দিষ্ট কক্ষে যখন রবীন্দ্রনাথের পুরস্বার প্রাপ্ত নোবেলটি দেখাই তখন সাগ্রহে ছাত্রছাত্রারা নেবেলটি দেখে পুলকিত হয়৷ কিন্তু আমরা যখন তাদের কানে কানে বলি এই নোবেল আসল নয়, এটি নকল৷ এই বাক্য উচ্চরণ করতে আমাদের কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসে৷ তখন ছাত্রছাত্রারাও মানসিক দিক থেকে আহত হয়৷
সুতরাং আর কালক্ষেপ নয়, বিন্দুমাত্রও ঔদাসীন্য নয়৷ দীর্ঘ ২০০ বছরের লুপ্ত স্বাধীনতা যদি আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারি তবে রবীন্দ্রনাথের হারানো নেবেলও আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারব৷ এ ব্যাপারে আমরা আশাবাদী৷ তবে এ ব্যাপারে বাঙালী জাগরণ চাই৷ বাঙালীদের এই ব্যাপারে গণ উদ্যোগ চাই৷ রবীন্দ্রনাথ বিশ্ববন্দিত কবি হলেও তিনি আমাদের বাঙলারই ভূমিপুত্র৷ তাঁকে ঘিরে আমাদের গর্ব ও আবেগের অন্ত নেই৷
সরকার বা প্রশাসন যদি উদাসীন থাকে বা এই ব্যাপারে শীতঘুমে আচ্ছন্ন থাকে তাহলে তাঁদের জাগানোর দায়িত্ব আমাদেরই৷ আর একটা কথা সরকার বা প্রশাসন যদি আগামী দিনেও রবীন্দ্রনাথের নোবেলের ব্যাপারে উদাসীন থাকে তাহলে মনে রাখতে হবে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা একদিন এ ব্যাপারে গণরোষ, বিক্ষোভ, ধিক্কার প্রদর্শন করবে৷ তারা সমবেত হয়ে একদিন সবার ঊধের্ব গলা তুলে বলবে ---
‘‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’’
- Log in to post comments